আজকের আড্ডা ছিল এমন একজন মানুষের সাথে যিনি পাশ্চাত্যের খ্যাতির উচ্চ শিখরে থেকেও মাতৃভূমির টানে দেশে ফিরে এসেছেন অবলুপ্ত প্রায় পোশাক শিল্পকে বিশ্ব দরবারে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করতে৷ তিনি আর কেউ নন, আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন মডেল, ফ্যাশন ডিজাইনার, উদ্যোক্তা ও সর্বোপরি বাংলাদেশের গর্ব – বিবি রাসেল। চট্টগ্রামের মেয়ে বিবি রাসেল কামরুন্নেসা সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় ও আজিমপুরের গার্হস্থ্য অর্থনীতি কলেজে পড়াশোনা শেষে পাড়ি জমান ইংল্যান্ডে। লন্ডনের কলেজ অব ফ্যাশন অ্যান্ড ডিজাইন থেকে পড়াশোনা শেষ করে যাত্রা শুরু করেন মডেলিং পেশায়। মডেলিংয়ের বর্ণাঢ্য জীবনে তিনি ভোগ ও কসমোপলিটনের মত জনপ্রিয় ম্যাগাজিনের টপ মডেল ছিলেন এবং টয়োটা ও জাগুয়ারের মত ব্র্যান্ডের জন্যও মডেলিং করেছেন। বিদেশের আকাশচুম্বী তারকা খ্যাতিকে পাশে রেখে দেশীয় পোশাকের নব যুগের সূচনার স্বপ্নে বাংলাদেশে ফিরে আসেন ১৯৯৪ সালে। ফিরে আসার পর থেকে এখন পর্যন্ত তিনি কাজ করে চলেছেন বাংলার গ্রামে-গঞ্জে তাঁতী ও বুনন শিল্পীদের সাথে এবং গড়ে তুলেছেন ‘বিবি প্রোডাকশন’ নামে নিজস্ব একটি ব্র্যান্ড। সৃষ্টি করেছেন দেশীয় পোশাকশিল্পের অনন্য সৃষ্টি গ্রামীণ চেক ও গামছা এবং নতুন প্রাণ দিয়েছেন ঐতিহ্যবাহী খাদি ও মসলিন কাপড়ের। অক্লান্ত পরিশ্রমের স্বীকৃতি হিসেবে তিনি বাংলা একাডেমীর সম্মানিত ফেলোশিপ, এল ম্যাগাজিনের বর্ষসেরা নারী ও বেগম রোকেয়া পদকসহ দেশে বিদেশে বহু সম্মাননা অর্জন করেছেন। তার ফ্যাশনকে ইউনেস্কো নাম দিয়েছে ‘ফ্যাশন ফর ডেভেলপমেন্ট’ হিসেবে।
কথার শুরুতেই বিবি আপা তার কাজ নিয়ে বলেছিলেন, যার যাত্রা শুরু একদম গ্রাম থেকে। বলছিলেন কীভাবে গ্রামবাংলার মানুষের সাথে তার জীবন মিশে আছে। করোনা মহামারীতে তাঁতী ও বিভিন্ন হস্তশিল্পে জড়িত মানুষদের কষ্টের গল্প বলছিলেন। তার সময় কি করে যায় এ প্রশ্নের জবাবে তিনি জানান যে কাজ করার স্পৃহা, পোশাক শিল্প নিয়ে নানা ধরনের গবেষণা, আর গ্রাম-বাংলার মানুষের সাথে কাজ করেই তার জীবন কেটে যাচ্ছে। পরিবেশ দূষণের গুরুত্বপূর্ণ দিক তুলে ধরে তিনি কৃষি ও তাঁতের পাশাপাশি সহাবস্থানের মাধ্যমে পরিবেশ বাঁচানোর কথা জানান। তার এই দীর্ঘদিনের যাত্রায় তার চেষ্টা ছিল গ্রামের সাধারণ মানুষকে বোঝানো যে কোনো জাতির জন্য শিক্ষা ও স্বাস্থ্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই দুটি বিষয় তার তৈরি সকল পণ্যে প্রাকৃতিক ফাইবার ব্যবহার করে যাওয়ার বড় অনুপ্রেরণা। আড্ডায় বিবি আপা আমাদের সাথে ভাগাভাগি করে নিলেন তার স্পেনের একটি স্মৃতি। আপা জানালেন কিভাবে স্পেনের মানুষেরা তার কাজ ও বাংলাদেশের হস্তশিল্পি তাঁতীদের প্রশংসা করেছেন এবং আপার কাজের অনন্যতা ও বিশুদ্ধতা কিভাবে তাদের মনে বিশেষ জায়গা করে নিয়েছে। উদ্যোক্তা বিবি রাসেলের সাধারণ মানুষকে সম্পৃক্ত করে দরিদ্রতা থেকে মুক্তির সংগ্রামের এই যাত্রার ভূয়সী প্রশংসা করেছে স্পেনের জনগন।
লন্ডন কলেজ অফ ফ্যাশান থেকে গ্রাজুয়েশন শেষ করার পর বিবি রাসেলকে দেখা গেছে ভোগ, কাসমোপালিটান, হারপাস বাজার, ভ্যালিচিনো ও নানা বড় প্রতিষ্ঠানের হয়ে র্যাম্পে ক্যাটওয়্যাক করতে। তাই জানতে চেয়েছিলাম এই ঝলমলে চাকচিক্যে ভরা জীবন ফেলে বাংলাদেশে আসার অনুপ্রেরণা কী? তাঁর ছিল খুবই সরল উত্তর, তার অনুপ্রেরণার উৎস গ্রাম- বাংলার সাধারন মানুষ। তিনি এটাও বলেন যে মূল শিক্ষাটা নিজের ঘরের। ছোটদের বেড়ে ওঠার ক্ষেত্রে বাড়ির শিক্ষার গুরুত্বের কথা তুলে ধরে তিনি তাঁর ফ্যাশাব ডিজাইনে পড়ার পিছনে বাবা-মায়ের আস্থা ও অবদানের কথা মনে করিয়ে দেন। তিনি আরও জানান ছোটবেলার স্বপ্ন লালন করে যাওয়ার কথা, তার সাথে তার স্বপ্নের বেড়ে ওঠা। স্বপ্ন পূরণের আত্নতৃপ্তির সুর ছিল তার কন্ঠে। আরো বলছিলেন ওয়ার্ল্ড মিডিয়ার কথা, যারা তাকে ফিচার করেছেন, গল্প তুলে ধরেছেন তাদেরকে সরাসরি সাপোর্টার মনে করেন তিনি। পৃথিবীর প্রায় সব দেশ যেখানে শিল্পের মর্যাদা ও খ্যাতি আছে, সেসব জায়গা থেকে এ অঞ্চলের একজন শিল্প অনুরাগী হিসেবে দাওয়াত পান তিনি। আদর আপ্যায়নের শেষে তিনি কোনো পারিশ্রমিক ছাড়াই এসব মানুষদের জন্য কনসালটেন্সি করেন। তাঁর খ্যাতির জন্য অনেকেই তাঁকে বিদেশে নিয়ে যেতে চান। কিন্তু কৃতজ্ঞ চিত্তে তিনি জানান যে, যাদের জন্য তিনি বিবি রাসেল হয়েছেন তাদের ছেড়ে তিনি কোথাও যাবেন না।
বিবি রাসেল তাঁর পেশা সম্পর্কে বলতে গিয়ে জানান এই পেশার মাধ্যমে তাঁর বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ঘুরে দেখার সুযোগ হয়েছে। অন্য দেশের ভাষা, কৃষ্টি ও সংস্কৃতি সরাসরি দেখার সুযোগ হয়েছে তাঁর। এভাবে আন্তঃদেশীয় সাংস্কৃতিক মেলবন্ধনের মধ্য দিয়ে সব দেশের মধ্যে নিজের কাজের অনন্য দিক ও এ অঞ্চলের পোষাক ও ফ্যাশনের বিশেষত্ব তুলে ধরা যায় বলে মনে করেন তিনি৷ হারিয়ে যাওয়া খাদি কাপড়কে যেভাবে তিনি নতুন করে দেশের মানুষের কাছে আবার ফিরিয়ে এনেছেন একইভাবে মসলিনকেও ফিরিয়ে আনার ইচ্ছা আছে ওনার। তিনি জানান আসল মসলিনের ম্যাচের বক্সে ফিট হওয়ার গল্প তাঁকে অনুপ্রেরণা দেয়। মসলিনের কাপড়ের ওপর তাঁর গবেষণা ২৫ শতাংশ অগ্রগতির কথাও বলেন তিন এবং একইসাথে থেমে না থাকার ওপর জোর দিয়েছেন তিনি। সময়ের সাথে প্রযুক্তির উন্নতির মতো এই পোশাক ও হস্তশিল্পের এগিয়ে নেওয়ার জন্য তাগাদা দেন তিনি।
কথার মাঝে বিবি রাসেল দুঃখ প্রকাশ করে বলেছিলেন যে, প্রতিবছর বইমেলায় এতো বই প্রকাশ হওয়ার পরেও মসলিন নিয়ে গবেষণা ধর্মী বইয়ের বড় অভাব। তবে অনেক কষ্ট করে নানা রিসোর্স ব্যবহার করে জাদুঘর থেকে ফটোকপি করে পড়েছেন তিনি। মসলিন নিয়ে পরিকল্পনার কথা জানতে চাইলে তিনি জানান যে, তিনি সবসময় যেকোনো পরিকল্পনার দীর্ঘমেয়াদি টেকসইতার কথা বিবেচনায় রেখে কাজ করেন। তাই উনি ধীরে ধীরে সামনে এগিয়ে যাওয়ার পক্ষপাতি। এই প্রক্রিয়ার সাফল্যের উদাহারন হিসেবে তিনি তুলে ধরেন গামছার কথা।
বিদেশে পড়াশোনার কথায় জানালেন, পোস্ট বিলি করে, অতিরিক্ত কাজ করে নিজের পড়ার খরচ চালিয়েছেন তিনি।
তাঁর হাত ধরে তাঁতীদের পুনর্বাসন ও মৌলিক শিক্ষার কাজ চলছে। বিবি রাসেলের কাজের পরিধি শুধু বাংলাদেশেই সীমাবদ্ধ নয়, ভারতের লিলুয়া হোমসে নারীদের পুনর্বাসন থেকে শুরু করে এসিড ভিক্টিম নারী ও রোহিঙ্গা ক্যাম্পে শরনার্থী, সর্বত্রই আলোকবর্তিকা হাতে ছুটে চলছেন তিনি। লিলুয়া হোমসের কাজের অভিজ্ঞতার গল্প বলছিলেন। সেইসব নারীদের ক্ষমতায়ন, তাদেরকে জীবনের কঠিন বেড়াজাল থেকে বের করে দক্ষ করে রোজগারের জন্য গড়ে তোলার যাত্রার গল্প শুনছিলাম। আড্ডায় তাঁর সম্পর্কে আরেকটি বিষয় জানলাম, উনি দিনে মাত্র ৪ ঘন্টা ঘুমান। যদিও কোনো বিরক্তি নেই উনার এতে৷ বাজারে দোকানের সংখ্যার বিষয়ে তিনি একটা অসাধারণ যুক্তি দাড় করিয়েছেন। তিনি জানান একটি দোকানের ভাড়া দেয়ার বদলে উনি আরো কয়েকজন তাঁতীকে বাঁচাতে চান। তাই তার দোকানের সংখ্যা কম কিন্তু তার পরিবর্তে তার কাজের সংখ্যা বেশি। তিনি বলছিলেন তাকে নিয়ে বানানো ডকুমেন্টারি ও চলচিত্রের কথা। গাফফার চৌধুরী ছাড়া বাংলাদেশে কেউই তাকে নিয়ে কাজ করেননি। তবে বাংলাদেশের বাইরে এ সংখ্যাটা অনেক বড়। এক্ষেত্রে নিজের একটু নাম করে, দেশকে তুলে আনার স্বপ্ন দেখতে পারা মানুষটা আমাদের বিবি। তাকে নিয়ে বানানো চলচিত্রে যখন বলা হচ্ছে সামনে দশ বছরে আরো ১০০ বিবি রাসেল হবে, কিন্তু বিবি রাসেল নিজেই চান না৷ কারণ উনি চান না কেউ তার মতো কষ্টে পড়ুক।
বিবি রাসেল ও ডঃ ইউনুস একই এলাকার মানুষ, চট্টগ্রামে জন্ম। বাংলাদেশকে বিশ্বদরবারে তুলে ধরেছেন দুইজন। একজন গ্রামীণ চেক আরেকজন গ্রামীন ব্যাংক এর মাধ্যমে বাংলাদেশকে করেছেন সম্মানিত। বিবি রাসেল যদিও নিজেকে ডঃ ইউনুসের সাথে তুলনা করতে নারাজ। ডঃ ইউনুসকে তিনি মাইক্রো ক্রেডিট এর গডফাদার হিসেবে মন করেন৷ ডঃ ইউনুসের কাজ প্রসঙ্গে বলছিলেন গ্রামীন ব্যাংকের কাজ হয় অনেক বড় পরিসরে, আর তাদের তুলনায় তাদের কাজ নির্দিষ্ট একটি বিষয় নিয়ে। তিনি বলছিলেন কীভাবে তিনি নিজের অফিসের সকলকে হাতে ধরে কাজ শিখিয়েছেন৷ তিনি প্রত্যাশা করেন তাঁর মৃত্যুর পরে অফিসের লোকেরাই যেন এটি ধরে রাখতে পারেন।
বিবি রাসেল আত্মবিশ্বাসের সাথে জানান তার সবচেয়ে বড় শক্তি বাংলাদেশের ৫০ ভাগ জনগণ৷ বডিগার্ড ছাড়াও নির্বিঘ্নে তিনি দেশের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত ছুটে বেড়াচ্ছেন, ভালোবাসায় মিশে আছেন মানুষের সাথে। অনেক তাঁতীর ভারতে চলে যাওয়া নিয়ে প্রশ্ন করায় তিনি জানান, আমাদের চাইতে ওদের কোয়ালিটি বেশি ভাল। তিনি আক্ষেপ নিয়ে জানান বাংলাদেশে রিসোর্স সীমাবদ্ধ ও হাতে ধরা অল্প। তবে একইসাথে তিনি জানান বাংলাদেশের শিল্পীরা অনেক মেধাবী।
মডেলিং নিয়ে কথায় বলছিলেন, বাংলাদেশের মানদন্ডে বেখাপ্পা একটি মেয়ে বিদেশের ইন্ডাস্ট্রিতে প্রায় মধ্যমণি হয়ে উঠছিলেন। তিনি জানালেন বাংলাদেশি হিসেবে তাকে মডেলিং এ নেওয়ার জন্য বাংলাদেশের কাছে তিনি কৃতজ্ঞ। নোবেল পুরষ্কারের আশা করেন কি না, জানতে চাইলে তিনি বলেন বাংলার মানুষের ভালোবাসাই তার পুরষ্কার। পছন্দের ডিজাইনারের কথা জিজ্ঞেস করায় জানালেন একেকজন স্বতন্ত্র ভাবে তাদের ধারায় সুন্দর। তিনি অনেক তরুণদের নতুন নতুন কাজের প্রশংসা করলেন। তাদেরকে পরামর্শ দিয়েছেন তাদের সৃজনশীল কাজকে ধরে রাখার। তরুণদেরকে তাদের মেধার ব্যবহার করে শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখার তাগিদ দেন তিনি। পরবর্তী প্রজন্মকে অনেক গুরুত্ব দিয়ে বলেন যে তাদেরকে শিখতে হবে, জানতে হবে, সম্মান করতে হবে, নিজেদের কৃষ্টি সংস্কৃতি নিয়ে জানতে হবে। সম্মান নিয়ে একাগ্রচিত্তে সামনের দিকে এগিয়ে যেতে হবে। নিজের সম্পদ, ভাষ ও সংস্কৃতি নিয়ে প্রথম যেন তরুণরা গর্ব করে ও হতাশ না থাকে সেই উপদেশ দিয়েছেন তিনি। স্বমহিমায় আলোকিত এই সফল উদ্যোক্তা বিবি রাসেল আলোচনা শেষ করেন তরুণদের প্রতি বিশেষ আহ্বান জানিয়ে। তিনি প্রত্যাশা করেন ভবিষ্যতে তরুণদের ডিকশনারিতে “লোভ” শব্দটি যেন না থাকে।
—
Photo| Future Startup