স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তীতে বাংলাদেশের জয় যেন শুধু স্থল বা জল পথেই সীমাবদ্ধ না থাকে, স্বপ্ন যেন আকাশ ছাড়িয়ে মহাকাশ ছুঁতে পারে সেই চেষ্টায় একাগ্রচিত্তে কাজ করেছেন একদল মানুষ। বলছি মহাকাশে বাংলাদেশের নিশান উড়ানো দেশের প্রথম স্যাটেলাইট – ‘বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১’ এর কথা। যার মাধ্যমে আন্তর্জাতিক যোগাযোগ ও ব্রডকাস্টিংয়ে আমাদের পরনির্ভরশীলতা কমে এসেছে। এই স্বপ্নযাত্রার বৈদেশিক পরামর্শক, শফিক চৌধুরীকে নিয়ে আমার আজকের আড্ডা। ৫০ বছরের বেশি সময় ধরে কর্পোরেট বিশ্বের নানা বিষয়ের ওপর পারদর্শীতা অর্জন করেছেন জনাব শফিক চৌধুরী। চট্টগ্রামের ছেলে শফিক চৌধুরি পড়াশোনা জীবনের শুরুতে ছিলেন বাংলাদেশের ক্যাডেট কলেজে, সেখান বিদেশে পাড়ি জমিয়ে পড়াশোনা করেছেন বার্মিংহাম ইউনিভার্সিটি, জর্জ ওয়াশিংটন ইউনিভার্সিটি ও হার্ভার্ডের মত বিশ্বসেরা প্রতিষ্ঠানে।
কিছুদিন পূর্বেই হার্টের অপারেশন হয়েছে শফিক চৌধুরীর। অসুস্থ্যতা সত্ত্বেও আগের মতই নিজের কর্মতৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছেন তিনি। তিনি জানান একজন সায়েন্টিস্ট হিসেবে বিজ্ঞানের ওপর আস্থা রেখে অপারেশন পরিচালনার ভার ছেড়ে দেন রোবটের ওপর। এই পদ্ধতিতে মাত্র ৬ সপ্তাহের মধ্যে সম্পূর্ণ সুস্থতা লাভ করে স্বাভাবিক কর্মজীবনে ফিরে আসেন তিনি।
এবার আমার ও প্রায় সকলের মূল আগ্রহ বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট সম্পর্কে জনাব শফিক এ চৌধুরীর কাছে জানতে চাইলাম। ‘ভারতীয় আইএসআরও’ বা ইলোন মাস্কের ‘স্পেস-এক্স’ আমাদের মাথার উপর কাজ করে যাওয়ার পরেও, ৩০০ মিলিয়ন ডলারের বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইটের কি আদৌ প্রয়োজন ছিল কিনা সে বিষয়ে উনার মতামত জানতে চাইলে প্রথমেই জনাব শফিক চৌধুরী জানালেন তিনি নিজেই বেশ অবাক হয়েছিলেন বাংলাদেশের মতো ছোট দেশে স্যাটেলাইটের কথা শুনে। দেশীয় না হয়ে আঞ্চলিক একটি স্যাটেলাইট হিসেবে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইটের যাত্রা শুরু হয় বলে জানান তিনি। এর ফলে বিদেশী নির্ভরশীলতা কমে এসেছে এবং দেশের অর্থ দেশেই থাকছে বলে অভিমত জানান তিনি। ব্যবসায়িক লাভের পাশাপাশি গৌরবের দিক থেকে চিন্তা করলেও এটি বিশ্বের দরবারে বাংলাদেশকে অনন্য একটি পর্যায়ে পৌছে দিয়েছে বলে মনে করেন তিনি। গার্মেন্টস শিল্পে বাংলাদেশ বিশ্ববাজারে শীর্ষ অবস্থানে আছে এ বিষয়টি উল্লেখ করে তিনি জানান এভাবে আমাদেরকে সকল ক্ষেত্রেই এগিয়ে যেতে হবে।
বর্তমানে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট -১ এর সামার্থের পঞ্চাশ শতাংশ ব্যবহৃত হচ্ছে কিন্তু তবুও নতুন করে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট -২ নির্মান প্রস্তুতির যৌক্তিকতা কতটুকু এ সম্পর্কে তিনি জানান এখন প্রথম স্যাটেলাইটের সামার্থ্যের পঞ্চাশ শতাংশের বেশিই ব্যাবহৃত হচ্ছে। বর্তমানে বাংলাদেশের ৩৬ টি টিভি স্টেশন এটি ব্যবহার করছে। স্যাটেলাইট ডিজাইনের খুঁটিনাটি সম্পর্কে আলোচনার সময় তিনি জানান, এর ডিজাইনে তারা ৪টি বিম ব্যবহার করেছেন। একটি বাংলাদেশের জন্য; যেটার পাওয়ার অনেক বেশি। যার মাধ্যমে মাত্র ৫০ সেন্টিমিটার এন্টেনা দিয়ে টিভি দেখা যাবে৷ আরেকটি বিমের কথা জানালেন, যা সার্কভুক্ত দেশগুলো কাভার করে, আরেকটি ইন্দোনেশিয়া ও অন্যটি ফিলিপাইন কাভার করে বলে তিনি জানান। সমস্যার কথায় তুলে ধরেন, বাংলাদেশের কারো তেমন স্যাটেলাইট নিয়ে জ্ঞান ছিল না। একদল তরুণকে স্যাটেলাইট সম্পর্কে আরো বিস্তারিত জানার সুযোগ করে দিয়ে বিদেশ পাঠানো হয়। তাদেরও একটু সময় লেগেছে সব কিছু ভালোভাবে বুঝতে। মাত্র ৩-৪ বছর হয়েছে, আরও সময় আছে বলে তিনি উল্লেখ করেন। বর্তমানে ইন্দোনেশিয়া ও ফিলিপাইনে কিছু ট্রান্সপন্ডার বিক্রির কথা চলছে বলে তিনি জানান। বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-২ এর বিষয়ে তিনি বলেন, এটি একটি রাজনৈতিক স্ট্যান্ড। বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট- ২, যেটি নিয়ে আলাপ আলোচনা চলছিল সেটি বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট ১ এর মতো না বলে জানান তিনি। ‘বিএস-২’ মূলত হবে আর্থ অবজারভেশন স্যাটেলাইট।
জনাব শফিক এ চৌধুরীর কাছ থেকে আমরা জানলাম, পৃথিবী যেমন ঘোরে, স্যাটেলাইট তেমন ঘোরে। বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট নর্থ সাউথ পোলে ঘোরে। কয়েকটি কন্সিলেশন থাকলে প্রতি ৪/৬ ঘন্টা করে ছবি তুলতে পারে এই ধরনের স্যাটেলাইট। যার মাধ্যমে কেউ অসুদপায়ে বর্ডার ক্রস করছে কি না, নদীর পানির ওঠা নামা খুব সহজে দেখা যাবে বলে তিনি জানান। এইটা নিয়ে গভর্মেন্ট টু গভর্মেন্ট আলোচনা চলছিল কিছুদিন, রাশিয়া সরকারের সাথে মূলত। এটা নিয়ে টাকা পয়সার কোনো সম্পর্ক থাকবে না, সেই বিষয়েও আমাদের জানান, মূলত একপ্রকার লেনদেন। জনাব শফিক জানালেন, ইউক্রেন যুদ্ধের পর মাননীয় প্রধানমন্ত্রী সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, ওই চুক্তিটা হবে না। এর ফলশ্রুতিতে দ্রুত সময়ের মধ্যে যে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-২ হচ্ছে না, তা তিনি পরিষ্কার ভাবে বুঝিয়ে বললেন। তবে আগামী নির্বাচনের আগে বর্তমান স্যাটেলাইটের সর্বোৎকৃষ্ট ব্যবহার নিশ্চিত হবে বলে তিনি আশাবাদ ব্যাক্ত করেছেন।
আমেরিকার আলাস্কাতে শফিক চৌধুরীর ‘আলাস্কা ডাটা বোর্ড’ নামে আরেকটি স্যাটেলাইট প্রজেক্ট রয়েছে। এটি ইলন মাস্কের স্পেস এক্সের সাথে তার প্রতিযোগিতা শুরু করবে কিনা বা মাথার ওপর স্টারলিংকের ৫৫টি স্যাটেলাইট থাকার পরেও এ প্রজেক্টের উদ্দেশ্য কী এসব বিষয়েও আলাপ করেছেন তিনি। তিনি জানান, ইলন মাস্ক অত্যন্ত উন্নত চিন্তার মানুষ এবং তার সবার কাছে ইন্টারনেট পৌছে দেয়ার চিন্তার প্রশংসা করেন তিনি। নিজের প্রজেক্টের বিষয়ে বলতে গিয়ে জনাব শফিক বলেন, স্টারলিংক সার্বজনীন নয়, তার প্রজেক্টটি এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। তার মতে, আলাস্কার মত বসবাসের জন্য কষ্টকর স্থানে সবার কাছে ইন্টারনেট পৌছে দিতে পারলে তা ঐ অঞ্চলের মানুষের অনেক উপকারে আসবে এবং শহরের বিকেন্দ্রীকরণের মধ্য দিয়ে বিভিন্ন অঞ্চলে উন্নতি ঘটবে।
স্যাটেলাইট ডিজাইনের পাশাপাশি বিভিন্ন খাতেই পদচারনা রয়েছে শফিক চৌধুরীর। বর্তমানে তিনি ও তার ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অফ হেলথ’র (এইআইএইচ) ডাক্তার বন্ধুসহ এডিএবিএটিই নামের একটি ক্লিনিক্যাল ডিভাইস নিয়ে কাজ করছেন। এ ডিভাইসের মাধ্যমে মেডিক্যাল ট্রায়ালে ব্যবহৃত বানরগুলোকে মেরে না ফেলে দ্বিতীয়বার ব্যবহার করা যাবে বলে জানান তিনি। বর্তমানে এটি পরীক্ষামূলক পর্যায়ে আছে বলে জানান তিনি। এছাড়াও, কোভিডের সময় থেকে তিনি নতুন মাল্টি পেশেন্ট ভেন্টিলেটর উদ্ভাবনের কাজ করে আসছেন। এটিও একটি মেডিক্যাল ডিভাইস যা দিয়ে একসাথে চারজন রোগীকে অক্সিজেন সাপ্লাই দেয়া যাবে বলে জানান তিনি।
দশ বছর পরে শফিক চৌধুরী তার জন্মভূমি বাংলাদেশকে কোথায় দেখতে চান এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি দেশের জনশক্তি নিয়ে ইতিবাচক প্রত্যাশা ব্যাক্ত করেন। তিনি দাবি করেন বাংলাদেশের মানুষ অত্যন্ত বুদ্ধিমান এবং সঠিক দিক নির্দেশনা পেলে এ দেশের তরুনরা অনেক দুর এগিয়ে যাবে। তবে গার্মেন্টস শিল্পের ওপর অতিমাত্রায় নির্ভরশীল হওয়া থেকে বেরিয়ে এসে বিভিন্ন খাতে বিনিয়োগ ও দৃষ্টি দেয়ার জন্য পরামর্শ দেন। তিনি মনে করেন, কোনো একটা খাত নিয়ে কাজ করতে গেলে সে বিষয়ের ওপর স্পেশালাইজড শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করা জরুরী।
শফিক চৌধুরী তার জীবনে বহু আইডিয়া ও প্রযুক্তি উদ্ভাবন করেছেন এবং এখনও করে যাচ্ছেন। তার কাজের অনুপ্রেরণা হিসেবে তিনি তার পছন্দের ব্যাক্তিত্ব বিল ক্লিনটনের জীবন থেকে পাওয়া একটি শিক্ষার কথা তুলে ধরেন। বিল ক্লিনটন থেকে তিনি শিখেছেন কিভাবে ব্রেনের দশটি ভাগকে কাজ ও সময় অনুসারে আলাদাভাবে ভাগ করে ব্যবহার করা যায়। তিনিও বিগত ১০ বছরে এটি রপ্ত করেছেন। এভাবেই তিনি একজন মাল্টি টাস্কিং মানুষ হিসেবে গড়ে উঠেছেন। কাজের ফাঁকে তিনি বাগান করতে পছন্দ করেন এবং রান্না বান্না করতে পছন্দ করেন। এছাড়াও, জনাব শফিক চৌধুরী অনুপ্রেরণা হিসেবে উল্লেখ করেছেন স্টিভ জবস, ইলন মাস্ক ও বিল গেটসের কথা। তাদের আবিষ্কার যেভাবে সময় বাঁচাচ্ছে ও সমাজের অগ্রগতিতে কাজ করছে তার প্রশংসা করেছেন তিনি।
সবার জীবনের শুরুটা গুরুত্বপূর্ণ। সেই জায়গাতে জনাব শফিকের কাছেও জানতে চাওয়া তার জীবনের শুরুর দিকের গুরুত্বপূর্ণ মানুষ সম্পর্কে। তিনি প্রথমেই জানালেন বাবা-মায়ের কথা। পাশাপাশি বললেন তার পরিবারের ঐতিহ্যের কথা, প্রায় ১৬০০ বছরের ইতিহাস। পরিবারে পড়ালেখার উপর জোর সবসময় ছিল বলে তিনি জানালেন। এখানে যেই বিষয়টি নজরকাড়ে, একসাথে খেতে বসে তার বাবার পড়ালেখা নিয়ে খোঁজ করা। তিনি তার বাবার এই উৎসাহের কথাটি বারবার করে উল্লেখ করেছেন।
আড্ডার মাঝে জনাব শফিক বলেছিলেন, রান্না করতে ভালোবাসেন, তাই জানতে চাওয়া কি ধরনের রান্না করা তার পছন্দের। এই প্রশ্নে যেন জনাব শফিক সাহেব একটু পুরাতন সময়ে ফিরে গিয়েছিলেন। পড়ালেখার সুবাদে বাড়ি ছাড়লেও মায়ের হাতের রান্না মিস করতেন তিনি। সাড়ে আঠারো বছরে বিদেশ পাড়ি জমানোর পর থেকেই নিয়মিত সাপ্তাহিক ছুটির দিনে দেশীয় রান্না করতেন তিনি। অনুষ্ঠান উপলক্ষে বিশেষ রান্না বা সাধারন যেকোনো রান্না করতে পছন্দ করেন তিনি। জনাব শফিক জানান যে দেশীয় চলচ্চিত্র দেখার তেমন একটা সুযোগ হয়ে ওঠেনা ওনার। তবে একটা সময় আরটিভি ও এনটিভিসহ বিভিন্ন চ্যানেলের অনুষ্ঠানগুলো উপভোগ করতেন তিনি। পাশাপাশি তার আলোচনায় উঠে আসে সরকারি কাজে বেতনের পাশাপাশি নির্দিষ্ট প্রজেক্টের লাভ্যাংশের অংশ কর্মরত ব্যক্তিদের সাথে শেয়ার করার মাধ্যমে বা অন্য কোনো ভাবে ইনসেনটিভ দেয়া প্রয়োজন।
ব্যক্তি শফিক চৌধুরী একজন বরেণ্য ও কৃতি মানুষ হিসেবে তার জন্মভূমি বাংলাদেশের জন্য কী কী অবদান রেখে যাচ্ছেন এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি ক্যাডেট কলেজের শিক্ষার্থীদের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও বুয়েটে ভর্তি হওয়ার পরিমান বাড়ানোর লক্ষ্যে একটি ই-লার্নিং সেন্টার গড়ে তোলার কথা জানান। পাশাপাশি ২০২২ সালে তিনি একই আদলে “স্যালুট টু বাবা” ই-লার্নিং সেন্টার গড়ে তুলেছেন স্কুলের শিক্ষার্থীদের জন্য। স্কিল উন্নয়নের জন্য উন্নত প্রযুক্তি ও বিভিন্ন কোর্সের জন্য কাজ শুরু করেছেন তিনি। অত্যন্ত বিনয়ী ও প্রচারবিমুখ শফিক চৌধুরী আশা রাখেন যেন তাঁর মৃত্যুর পরেও মানুষ তাঁকে একজন আদর্শ ও ভাল মানুষ হিসেবে মনে রাখেন।