আজকে একজন জাদুকরের সাথে গল্প করেছিলাম। হ্যাঁ, তিনি জাদুকর বটে তবে একটু অন্যরকম জাদুকর। যার জাদুর ছোঁয়ায় বাংলাদেশের চলচ্চিত্র ও বিজ্ঞাপন জগতে যোগ হয়েছে অনন্য মাত্রা। যিনি একধারে একজন বিজ্ঞাপন নির্মাতা, চলচ্চিত্র পরিচালক, টিভি নাটক পরিচালক ও ওয়েব সিরিজ নির্মাতা। বিজ্ঞাপন জগতের নির্মাতাদের নাম নিলে প্রথম সারিতে যিনি অবস্থান করেন তিনি আর কেউ নন, তিনি হলেন স্বনামধন্য চলচ্চিত্র পরিচালক অমিতাভ রেজা চৌধুরী। ১৯৭৬ সালে এই গুণী নির্মাতার জন্ম হয় তাঁর নানা বাড়ি ব্রাহ্মণবাড়িয়াতে। তাঁর পৈতৃক বাড়ি মূলত কিশোরগঞ্জ এবং তিনি বেড়ে উঠেছেন রাজধানী শহরেই। ঢাকার বিএএফ শাহীন স্কুল ও কলেজ থেকে পড়াশোনা শেষ করে উচ্চশিক্ষার উদ্দেশ্যে তিনি পাড়ি জমান ভারতে। সেখানে তিনি ভারতের বিখ্যাত পুনে ইনস্টিটিউটে অর্থনীতি বিভাগে ভর্তি হয়েছিলেন। কিন্তু, চলচিত্রের প্রতি প্রবল আকর্ষণ থাকায় তিনি নিজের ক্লাস ছেড়ে ফিল্মের শিক্ষার্থীদের সাথে আড্ডা দিতেন, তাদের ক্লাসে গিয়ে বসে থাকতেন। অবশেষে পড়াশোনা শেষ না করেই দেশে ফিরে আসেন তিনি। দেশে ফিরে এসে নিজের স্বপ্ন বাস্তবায়নে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। বর্তমানে পর্দায় কাজের পাশাপাশি তিনি ফিল্ম প্রোডাকশন বিষয়ের ওপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে খন্ডকালীন শিক্ষক হিসেবে শিক্ষকতা করছেন।
কিভাবে সিনেমা জগতে প্রবেশ সেই প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে চমৎকার কিছু অজানা তথ্য জানান তিনি। ছোটবেলা থেকেই সাহিত্য ও সিনেমার প্রতি প্রবল জোক ছিলো অমিতাভ রেজার। সত্যজিৎ রায় ছিলেন তাঁর আদর্শ। প্রচুর বই পড়ার কারনে জীবনের একটা পর্যায়ে কার্ল মার্কসের ভক্তই হয়ে যান তিনি। রাজনীতির জোক মাথায় চেপে বসে। সমাজ পরিবর্তনের নেশায় মগ্ন হয়ে যান তিনি। আর এই নেশাকে আরও পরিপক্ব করে তুলেন তার চাচা কমরেড আইযুব রেজা চৌধুরীর সান্নিধ্য। অমিতাভ রেজা চৌধুরীও চেয়েছিলেন রাষ্ট্র ও সমাজের পরিবর্তন। কিন্তু শারীরিকভাবে অসুস্থ্য হওয়ার পর থেকে এই পরিবর্তনের জন্য প্রত্যক্ষভাবে আর লড়াই করতে পারেননি তিনি। পড়াশোনার পর রাজনীতি চর্চাও আর সম্ভব হয়নি তাঁর। তাই তিনি সমাজ পরিবর্তনের হাতিয়ার হিসেবে সিনেমাকেই বেছে নেন। বই, রাজনীতি আর সিনেমাপ্রীতিই তার সিনেমা জগতে আসার মূল কারণ।
নির্মাতা হিসেবে অমিতাভ রেজা চৌধুরী ১৫০০ এরও অধিক টেলিভিশন বিজ্ঞাপন নির্মাণ করেছেন। শুরুর দিকে তিনি চলচ্চিত্র নির্মাণ করেননি। টিভিসি ও নাটকের মধ্য দিয়ে ধীরে ধীরে অভিষেক ঘটে তাঁর। একুশে টেলিভিশন তার এই অভিষেকের সবচেয়ে বড় জায়গা ছিলো। ২০০১ সালে ‘ঘর’ নাটক নির্মানের মধ্য দিয়ে তিনি নাট্য নির্মাণ শুরু করেন। বর্তমানে তাঁর ‘Half Stop Down’ নামক একটি প্রোডাকশন হাউজ রয়েছে। এই প্রোডাকশন হাউজ মূলত টিভিসি নির্মানের জন্য হলেও তার বিখ্যাত ‘আয়নাবাজি’ চলচ্চিত্রটি এই হাউজ থেকেই নির্মিত হয়েছে।
বিজ্ঞাপন নির্মাতা হিসেবে অমিতাভ রেজা চৌধুরী যেমন সফল ব্যক্তিত্ব তেমনি চলচ্চিত্রকার হিসেবেও কুড়িয়েছেন বিশেষ খ্যাতি। আয়নাবাজির মাধ্যমে চলচ্চিত্র জগতে আত্মপ্রকাশ করেন তিনি। ২০১৬ সালে আয়নাবাজিতে করেছেন বাজিমাত। অতীতের সকল রেকর্ড ভেঙ্গে নতুন ইতিহাস গড়েছেন। জনপ্রিয়তার তুঙ্গে উঠে বেশ প্রশংসা কুড়ানোর পরপরই ২০২১ সালে সফলভাবে মুন্সিগিরি এবং ২০২৩ সালে সবচেয়ে বেশি সাড়াজাগানো চলচ্চিত্র ‘রিক্সা গার্ল’ নির্মান করেন। তার এই নবনির্মিত সিনেমাটি শুধু দেশ নয় দেশের গন্ডি পেরিয়ে আমেরিকার ২১ টি রাজ্যেও দর্শকপ্রিয়তা পেয়েছে। অমিতাভ রেজা এই চলচ্চিত্রটি নিয়ে বলেন, সিনেমাটি ইংরেজি ভাষায় নির্মাণ করার প্রধান কারণ হলো আমেরিকানরা সাবটাইটেলে সিনেমা দেখেন না, তাই তাদের কাছে যেন নিজের ভাষার চলচ্চিত্র মনে হয় তাই রিক্সা গার্ল চলচ্চিত্রে তিনি ইংরেজি ভাষা ব্যবহার করেছেন। বর্তমানে দেশীয় ভাষায় রুপান্তরের কাজ চলছে বলেও জানিয়েছেন তিনি।
বর্তমানে বাংলা চলচিত্রের হালচাল জানতে চাইলে শুরুতে তিনি কিছু সীমাবদ্ধতার কথা বললেও পরবর্তীতে বেশ আশার আলো দেখান। অমিতাভ রেজা বলেন, এদেশের শিল্পীরা অনেক মেধাবী, চলচ্চিত্রকাররা অসম্ভব মেধাবী এবং এখানে কাজ করার জন্য অনেক পরিশ্রমী কর্মী আছে। তাঁর মতে কাজের প্রতি নিবেদিত এমন মানুষগুলোর জন্যই এখনও দেশের চলচ্চিত্র শিল্প মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে। তবে শ্যুটিং স্পটগুলোর অত্যন্ত বেহাল দশা বলে জানিয়েছেন তিনি। সেখানে শিল্পীদের জন্য যথাযথ ওয়াশরুম ব্যবস্থা থাকেনা এবং এর ফলে অনেক শিল্পীর ইউরিন ইনিফেকশনের মত ভয়াবহ সমস্যা হয়েছে বলে অভিযোগ করেছেন তিনি। তিনি আরও জানান শিল্পী, নির্মাতা ও কলাকুশলীরা একটা সিনেমা বা নাটক তৈরি করতে গিয়ে গরমে-ঘামে ভিজে পরিশ্রম করে কাজ করেন। কিন্তু, তবুও চিত্রনাট্যকাররা সঠিকভাবে টাকা পাননা এবং সরকারের দিক থেকেও কোনো ঠিকঠাক অনুদান নেই। পর্যাপ্ত সুযোগ সুবিধা পেলে বাংলা সিনেমা শিল্প দেশ ও জাতির জন্য আরও অনেক কিছু করতে পারতো বলে মনে করেন তিনি। তিনি তরুন পরিচালকদের সম্ভাবনার কথা বলেন এবং তাদের মেধা ও পরিশ্রমের প্রশংসা করেন। বিশেষ করে বর্তমান সময়ে তরুন নির্মাতাদের শার্টিকাপ ও জাগো বাহের মত ওয়েব সিরিজগুলো তাঁর ভাল লেগেছে বলে জানিয়েছেন তিনি। তিনি বলেন, “নতুনদের থেকেই এখন যা পারছি শিখছি, তাদের থেকে অনেক কিছু শেখার আছে”।
সিনেমা নিয়ে অমিতাভ রেজা চৌধুরীর হতাশার জায়গা হলো সিনেমার সেন্সরবোর্ড। তিনি এটিকে চলচ্চিত্র বিকাশের পথে বাঁধা হিসেবে মনে করেন এবং অন্য কিছুতে সেন্সরবোর্ড না থাকলেও চলচ্চিত্রে সেন্সর আছে বলা জানান তিনি। কোন বই যদি খুব বেশি উগ্রতা না ছড়ায় বা রাষ্ট্রবিরোধী না হয়, সেগুলোর জন্যও কোন সেন্সরবোর্ড নেই অথচ সিনেমার জন্য সেন্সরবোর্ডের নেমে আসে বলে অভিযোগ করেছেন তিনি। তিনি আরও বলেন, সিনেমা রাষ্ট্রের জন্য, রাষ্ট্রের চিন্তার জন্য। একমাত্র সিনেমাই পারে সমাজকে তৈরি করতে, জনগনকে এক করতে এবং জনগনের মাঝে অনুভূতি সৃষ্টি করতে। সিনেমা হলো রাষ্ট্রের এক ধরণের ক্ষমতা আর এই ক্ষমতাকে রাষ্ট্র পরিচালকরা ভয় পান। ব্রিটিশরাও রাষ্ট্রের এই ক্ষমতাকে ভয় পেতো, তাই তারা ১৯১৮ সালে সিনেমায় সেন্সরবোর্ড আরোপ করেছিলো। আর রাষ্ট্র পরিচালকরাও এখন চলচ্চিত্রের এই ক্ষমতাকে ভয় পান, তাই তারা এখনও সেন্সরবোর্ড রেখেছে। রাষ্ট্রের উচিত সিনেমাকে উন্নত করা এবং এর উন্নয়নের জন্য কাজ করা। তিনি হতাশার সাথে জানান যে, রাষ্ট্র চলচ্চিত্র শিল্প নিয়ে ভাবে না এবং এটিকে যথাযথ মূল্যায়ন করে না। যার ফলে চলচ্চিত্র শিল্প যেভাবে চলার কথা ছিল সেভাবে নিজেদের মতো সঠিকভাবে কাজ করতে পারছেনা; যা অত্যন্ত হতাশাজনক।
সিনেমা হলগুলো বর্তমান দুর্দশা কাটিয়ে সামনের দিনগুলোতে আবার ঘুরে দারাতে পারবে কিনা এ বিষয়ে আলোচনা করতে গিয়ে তিনি জানান, বর্তমানে দর্শকদের মাঝে চলচ্চিত্র উপভোগ করার ধরণে পরিবর্তন এসেছে। বর্তমানে মানুষ সিনেমা হলের চেয়ে মোবাইল বা ব্যাক্তিগত ডিভাইসে সিনেমা বেশি দেখছেন। শুধু বাংলাদেশে নয়, ভারত ছাড়া মোটামুটি পৃথিবীর সব দেশেই এই প্রবণতা দেখা যাচ্ছে যে মানুষ সিনেমা হলে কম যাচ্ছে। ফলে, সময়ের পরিবর্তনে সিনেমা হলের ভবিষ্যৎ উন্নয়ন হওয়ার সম্ভাবনা কম বলে মনে করেন তিনি। বর্তমান বাস্তবতাকে বিবেচনায় রেখেই সামনের দিকে বিকল্প মাধ্যমগুলোকে ব্যবহার করে চলচ্চিত্র নির্মানের দিকে অগ্রসর হতে হবে বলে অভিমত প্রকাশ করেন তিনি।
প্রিয় অভিনেতার কারা এমন প্রশ্নের জবাবে অমিতাভ রেজা চৌধুরী জানান তাঁর সবচেয়ে প্রিয় অভিনেতা হলেন হুমায়ূন ফরিদি। এছাড়াও চঞ্চল চৌধুরী তাঁর অত্যন্ত পছন্দের একজন অভিনেতা। চঞ্চল চৌধুরীকে তিনি মাটির মানুষ হিসেবে অভিহিত করেন এবং একজন শক্তিমান অভিনেতা হিসেবে আখ্যা দেন। মোশাররফ করিম, মেহজাবিন, তিশা, নিশো, জয়া আহসান, ফজলুর রহমান বাবু, পংকজ, অশোক, মমোসহ অসংখ্য অভিনেতা আছেন বাংলাদেশে যাদেরকে তিনি গুণী ও প্রতিভাবান অভিনেতা হিসেবে মনে করেন।
অমিতাভ রেজা চৌধুরী নিজের স্বপ্নকে বাস্তবায়ন করতে গিয়ে বিভিন্ন পুরষ্কারে ভূষিত হয়েছেন। তিনি আয়নাবাজি চলচ্চিত্রের জন্য শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র পরিচালক বিভাগে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরষ্কার ও মেরিল-প্রথম আলো পুরষ্কার অর্জন করেছেন। এছাড়াও তিনি ‘একটি ফোন করা যাবে প্লিজ’ ও ‘সারফেস’ – এ দুটি নাটকের জন্য ২ বার সেরা নাট্য নির্দেশক বিভাগে মেরিল-প্রথম আলো সমালোচক পুরস্কার অর্জন করেন। এছাড়াও, প্রামাণ্য চিত্রের জন্য তিনি ক্রোয়েশিয়ার জাগরেভ ট্যূর ফিল্ম উৎসবে পুরষ্কার লাভ করেন। সম্প্রতি, আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে তাঁর নব-নির্মিত ‘রিক্সা গার্ল’ সেরা ছবির পুরষ্কার অর্জন করেছে। খ্যাতিমান এই নির্মাতার ছবিটি প্রেসকট আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে ‘সেরা ফিচার ফিল্ম’ বিভাগে বিজয়ী হয়েছে।
মৃত্যুর পর পৃথিবীর মানুষের মাঝে কী হিসেবে থাকতে চান এমন প্রশ্নের জবাবে অমিতাভ জবাব দেন তিনি দেশের মেহনতি জনতা, সাধারণ জনগন, ও খেঁটে খাওয়া মানুষের পাশে দাঁড়ানোর মত কাজ করেই তাদের মাঝে বেঁচে থাকতে চান। দেশ ও দেশের মানুষের প্রতি অকৃত্রিম প্রেম ও কিছু করতে চাওয়ার আকুলতা প্রকাশ পেয়েছে তাঁর কথায়। আলোচনার শেষ দিকে এসে তিনি সবাইকে অনুরোধ করেন যাকাত বা টাকা দিয়ে মানুষকে সাহায্য না করে এমন কিছু করা যাতে তাদের আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন ঘটে।
স্বপ্নের জাদুকর অমিতাভ রেজা চৌধুরী তার চাওয়াগুলো স্বপ্নের মতো করেই বাস্তবায়ন করতে যাচ্ছেন। সবসময় তিনি বড় কিছু করার চিন্তা করেছেন। দেশের জন্য ও দেশের নিপীড়িত মানুষের জন্য সমাজকে পরিবর্তন করতে চেয়েছেন। সুন্দর সমাজ গড়ার জন্য তিনি হাতিয়ার হিসেবে সিনেমাকেই বেছে নিয়েছেন তাই শারীরিক সকল প্রতিবন্ধকতাকে ছাড়িয়ে গুটি গুটি পায়ে তাঁর স্বপ্নের দিকে এগিয়ে যাচ্ছেন।