সুর হলো এমন এক জাদু, যে জাদু সকল শ্রেণী পেশার মানুষকে বস করে ফেলতে পারে। সুরের মাধ্যমে মানুষ নিজেকে অন্য এক জগতে আবিষ্কার করতে পারে। আর যারা এই সুরের সাধনা করেণ তাঁরা একেকজন জাদুকর। আজ এমনই এক জাদুকরের কথা বলবো যার জাদুর ছোঁয়ায় ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের জগতে যোগ হয়েছে এক অনন্য মাত্রা। তিনি বিশ্বরেকর্ড অর্জনকারী […]

রাগে – অনুরাগে: পন্ডিত গীতেশ মিশরা

সুর হলো এমন এক জাদু, যে জাদু সকল শ্রেণী পেশার মানুষকে বস করে ফেলতে পারে। সুরের মাধ্যমে মানুষ নিজেকে অন্য এক জগতে আবিষ্কার করতে পারে। আর যারা এই সুরের সাধনা করেণ তাঁরা একেকজন জাদুকর। আজ এমনই এক জাদুকরের কথা বলবো যার জাদুর ছোঁয়ায় ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের জগতে যোগ হয়েছে এক অনন্য মাত্রা। তিনি বিশ্বরেকর্ড অর্জনকারী এবং স্বনামধন্য ও জনপ্রিয় শাস্ত্রীয় সংগীত সাধনাকারী উস্তাদ ও পন্ডিত গীতেশ মিশরা। প্রয়াত পন্ডিত মহেশ মিশরার যোগ্য উত্তরসূরি পন্ডিত গীতেশ মিশরা ছোটবেলা থেকেই বেড়ে উঠেছেন বাদ্যযন্ত্রের সাথে। তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বি.কম ও এম.কম পাশ করেন। এছাড়াও, তিনি অল ইন্ডিয়া রেডিও ও দূরদর্শনের নিয়মিত সংগীত শিল্পি ছিলেন। ফোর্ট ফাউন্ডেশন এ আইটিসির গবেষক ছিলেন তিনি। পন্ডিত কুমার প্রসাদের তত্ত্বাবধানে তিনি আইটিসিতে কাজ করতেন। এছাড়াও পন্ডিত গীতেশ মিশরা বিভিন্ন স্কুল কলেজেও শিক্ষকতা করেছেন। বর্তমানে ‘The ARDEE School, Gurgaon এ কর্মরত আছেন এবং তাঁর নিজস্ব মিউজিক্যাল একাডেমি রয়েছে।

গুণী এই সংগীত বিশেষজ্ঞের হাতেখড়ি ঠিক কখন হয়েছে তিনি নিজেও বলতে পারেন না। জন্মের পর থেকেই গান বাজনার সাথে বড় হয়েছেন তিনি। গান-বাজনা তার পারিবারিক সূত্রে পাওয়া। তবে যদি নিতান্তই প্রাতিষ্ঠানিক হাতেখড়ির হিসেব বলতে হয় তবে ৬ বছর বয়সে তাঁর আনুষ্ঠানিক গান চর্চা শুরু হয়েছে বলা যেতে পারে। ৬ বছর বয়সে তিনি তাঁর বাবার সাথে শ্রীমতী গীর্জা দেবীর জন্মদিনের অনুষ্ঠানে যান এবং সেখানে গান গেয়ে সকলের মন জয় করে নেন। এরপর থেকেই তাঁর বাবা ভাবলেন ছেলেকে হয়তো গান শেখানো যায় আর সেখান থেকেই মূলত আনুষ্ঠানিক ভাবে গানের জগতে প্রবেশ হয় উস্তাদ গীতেশ মিশরার।

পন্ডিত গীতেশ মিশরার অনুপ্রেরণা কারা এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি জানান তাঁর মা-বাবা’ই তার সংগীত জীবনের প্রথম গুরু ও অনুপ্রেরণা। তবে বাবা পন্ডিত হবার সুবাধে অনেক গুণী সংগীতজ্ঞের সান্নিধ্য লাভ করেছিলেন পন্ডিত গীতেশ মিশরা। তাঁর শৈশব ও কৈশোর কাটে নামীদামী সংগীতজ্ঞদের সাথে। তাঁরাও পন্ডিত গীতেশ মিশরার অনুপ্রেরণার আরেকটি জায়গা। তাঁর প্রধাণ গুরু তাঁর বাবা হলেও তাঁর জীবনে পন্ডিত কুমার প্রসাদ, পন্ডিত রামাশাস্ত্র, পন্ডিত জাগদীশ, পন্ডিত গৌতম, ওস্তাদ শাফী আহমেদের অবদান অনস্বীকার্য বলে মনে করেন তিনি।

পন্ডিত গীতেশ মিশরা বেনারাস ঘারানায় একজন শাস্ত্রীয় সংগীত বিশেষজ্ঞ। তবে তিনি একাধারে খেয়াল, তারানা, ঠুমরি, টপ্পা, দাদরা এবং ভজন ঘারানায় বিশেষজ্ঞ। তিনি গানের জগতে এক আমূল পরিবর্তন এনেছেন। তিনি বিশ্বাস করেন প্রতিটা মানুষের গান শোনা ও সেই গান বোঝার অধিকার রয়েছে। তাই তিনি প্রতিটা ঘারানাকে সম্মান করেন এবং সকল অলংকার নিয়ে বিশ্লেষণ করেন। আধুনিক বাদ্যযন্ত্র নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে গিয়ে তিনি তৈরি করেছেন নিজস্ব পরিচয়। তিনি বলেন আগে শ্রোতাদের পরিমাণ ছিল সীমিত, এখন জনসংখ্যা, সংস্কৃতি ও সভ্যতার বিকাশের সাথে সাথে শ্রোতার সংখ্যাও বৃদ্ধি পেয়েছে। তবে, সব শ্রোতার গানের পছন্দ এক নয়। স্থান, কাল, পাত্র ভেদে গানের পছন্দেরও পরিবর্তন হয়। যেমন ক্লাসিক্যাল সবাই বুঝবে না। এজন্য লেভেল অব আন্ডারস্ট্যান্ডিং প্রয়োজন। কিন্তু তাই বলে যারা বুঝবে না তাদের বঞ্চিত করার অধিকার আমাদের নেই। এই দৃষ্টিকোন থেকে তিনি সকল প্রকার ঘারানা, অলংকার ও সুরকে ভালোবাসেন। তিনি আরও বলেন সুরই সব এবং সুরই স্থায়ী; কেবল ধরণে তার পরিবর্তন হয়। যেমন ঠাকুরেরই বান্দেশ এক ধরণে গাইলে হয় ধ্রুপদ, অন্য ধরণে গাইলে খেয়াল, একটু পরিবর্তন করলে ধুনরী, গজল, সুফী, কাওয়ালী। কোনটাকেই আমরা বাদ দিতে পারি না। গান একটা ভাষা, এই ভাষাকে যদি আমরা শ্রোতাদের মাঝে পৌঁছে দিতে পারি তবে সেটিই আমাদের সার্থকতা বলে মনে করেন তিনি।

পন্ডিত গীতেশ মিশরার মিউজিক্যাল একাডেমী ‘গুরুদাহো ডেইলি এনসিআর’। সেখানে তিনি ছাত্রদের সংগীতের শিক্ষা দেন। তিনি ছাত্রদের সুবিধার্থে সংগীতের অ-আ-ক-খ নিয়ে “গানের ধারাপাত” নামে একটি বই লিখেছেন। সেখানে ২০০ টিরও বেশি অলংকার রয়েছে বলে নিশ্চিতে করেছেন তিনি।

পন্ডিত গীতেশ মিশরা খুব চমৎকারভাবে আমাদের ভারতীয় শাস্ত্রীয় সংগীতের ইতিহাস তুলে ধরেন। শাস্ত্রীয় সংগীত সুবিশাল এক গানের জগৎ। এই সংগীতের ঐতিহ্য প্রায় ৫ হাজার বছরের; সেই ইরান ও মুঘোল শাসন আমল থেকে শুরু। ভারতীয় শাস্ত্রীয় সংগীতে তানসেনের অবদান স্বীকার করেন তিনি। সেই সাথে তানসেনের গুরু স্বামী হরিদাশ জ্বী এবং তাঁরও গুরুদের অবদানের কথা স্মরণ করেন। তখনকার সংগীত মূলত ঠাকুকের সাথে মিশে যাওয়ার সংগীত। তানসেন গান গাইলে নাকি আগুন জ্বলে উঠতো, বৃষ্টি হয়ে যেতো এতোটা ভক্তি নিয়ে গাইতেন তিনি। ভারতমুনীও খ্রীষ্টপূর্ব ৪০০ অব্দে ভারতনাট্যতে লিখে গিয়েছিলেন এই গল্প। গানের আদ্যোপান্ত বর্ননা করতে গিয়ে উস্তাদ গীতেশ মিশরা মনে করিয়ে দেন যে, গানের ইতিহাস অনেক লম্বা। শুরুর দিকে বেদের মন্ত্রের উচ্চারণ হতো, সামবেদ পুরোটাই গান ছিলো। তখন সবাই গেয়ে গেয়ে পড়তো। মুনী, ঋষিরা এসব বেদ গাইতেন আর সাধারণ মানু্ষ গাইতো ফোক গান। সেই সময়ে বীণা আর বাঁশি ছিলো উল্লেখযোগ্য বাদ্যযন্ত্র। শিবকেও গানের স্রষ্টা বলা হতো তার হাতের ডাম্বুর জন্য। তারপর ধ্রুপদ গান শুরু করলেন তানসেন। ধ্রুপদ এমন এক ধরণের গাইকী যার বিশেষত্ব হলো বিভিন্ন তালের মাধ্যমে গাওয়া হতো। ধ্রুপদের মাঝে অনেকক্ষণ আলাপ হতো। কোন ধরণের বাদ্যযন্ত্র বাজবে না, শুধু আলাপ হবে। ধ্রুপদে ফাঁখাওয়াজ নামে একটি বাধ্যযন্ত বাজতো। কিন্তু ধ্রুপদ অনেক কঠিন একটি সাধনা বলে জানিয়েছেন তিনি। সবাই বুঝতো না এই গায়কী। তখনকার রাজদরবারে চলতো এই গায়কী। তাই পরবর্তীতে ধ্রুপদের একটি হালকা সংস্করণ হিসেবে আসলো খেয়াল। খেয়ালের মাঝে অনেক রূপ রয়েছে। মুসলিমরা এটাকে কাওয়ালীতে রুপদান করেছিলেন তখন। তবে খেয়াল গায়কীর সময় অনেক গায়ক থাকতো এবং তাদের মাঝে প্রতিযোগীতা হতো যেখানে একজন আরেকজনকে হারানোর জন্য অংশগ্রহণ করতো। ফলে গানের যথার্থতা আর থাকতো না, অনেক শব্দ হতো সেখানে যার ফলে গানটা আর উপভোগ করা যেতো না। তখন ধীরে ধীরে খেয়াল গায়কীর পরিবর্তে একটু সাধারণ হিসেবে আসলো ঢুনরী গাইকী। তারপর ঢুনরী থেকে টপ্পা ও আরও নানা ধরণের গাইকী আসলো। তিনি বলেন বর্তমানে শিওলিয়ান নামে একটা গাইকীর প্রচলন রয়েছে। সময়ের সাথে সাথে মানুষের রুচির পরিবর্তন হয়, সেই সাথে পরিবর্তন ঘটে সংস্কৃতির। যেহেতু গান সংস্কৃতিরই একটি অংশ তাই গানেরও ধরণের পরিবর্তন হয়। এই পরিবর্তনকে তিনি খুব স্বাভাবিক ভাবেই দেখছেন।

এইযে এতক্ষণ আমরা বিভিন্ন ঘারানার নাম শুনলাম এখন অনেকেই ভাবতে পারে ঘারানাটা আসলে কী? ঘারানার উদ্ভব কোথা থেকে এই প্রশ্নটিরও সহজ সুন্দর ও সাবলীল ভাষায় তিনি বলেন “ ঘারানার বিষয়টি মূলত স্থানিক। বর্তমানে আমরা চাইলে যেকোন দেশের, যেকোন ভাষার গান শুনতে পারি। কিন্তু আগে এমন ছিলো না। এখন ভিডিও ও অডিও রেকর্ড আছে আমরা কিছু শিখতে চাইলেই পারি। নিয়মিত চর্চা করতে পারি দেখে দেখে কিন্তু আগে এমন কোন সুবিধা না থাকায় মানুষ সবসময় উস্তাদদের কাছে যেতে পারতো না। যেমন ধরা যাক, কেউ যদি দূর দেশ থেকে এক প্রকার গান শিখে আসে পরবর্তীতে সে যখন চর্চা করতে চায় তখন তার স্মৃতি থেকে করতে হয়। কেননা সে চাইলেও আর যেতে পারে না। তখন স্মৃতিতে যা থাকে তাই সে ডেলিভারি করে। এজন্য গানের ডেলিভারির ধরণ পাল্টে যায়। তৃতীয় কোন ব্যক্তি যদি এই গান শুনে তাহলে দুজনের গান তার কাছে দুইরকম লাগবে। তবে কেউ কিন্তু ভুল করছেন না, কেননা এখানে ব্যকরনগত কোনো ভুল নেই। এইযে এখানে একই গানের ডেলিভারির ধরণ আলাদা এটাই হলো ঘারানা”।

পন্ডিত গীতেশ মিশরা নিজে বেনারাস ঘারানার হলেও তিনি সকল ঘারানা আয়ত্ব করার চেষ্টা করেন এবং সংগীতে নতুন এক ধারার সৃষ্টি করেন। তাঁর কাছে গানের দর্শন হলো ক্রিয়েটিভ এক্সপ্রেশন। বিশেষজ্ঞরাই গবেষণা করে এসব নতুন নতুন সুর সৃষ্টি করবে। পন্ডিত গীতেশ মিশরা গানের জগতে এই অবদানের জন্য সুর সিংগার সামসেদ অর্গানাইজেশন থেকে ‘সুরমনি’ উপাধি লাভ করেছেন। তাছাড়া গানের প্রতি তার প্রজ্ঞার জন্য মানুষ তাকে ‘পন্ডিত’ আখ্যা দেন। তিনি চান তাঁর মৃত্যুর পর মানু্ষ তাকে সাধক হিসেবে মনে রাখুক। গানের প্রতি তার যে প্রজ্ঞা মানুষ তাকে গায়ক বা সংগীত বিশেষজ্ঞ হিসেবে মনে না রাখলেও মানুষ তাঁর সাধনার স্বীকৃতি দিক। তিনি এমন একজন বিয়নী মানুষ যিনি খ্যাতির পেছনে ছুটেন না। তিনি সাধক হয়েই মানুষের মাঝে বেঁচে থাকতে চান।