এদেশের গণমানুষের মানসপটে সুচিকিৎসা ও সুস্বাস্থ্যের মত শব্দগুলোর সাথে যে নামটি ওতপ্রোতভাবে জড়িত, তা হল ডা: জাফরুল্লাহ চৌধুরী। “গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র” এর প্রতিষ্ঠাতা ডা: জাফরুল্লাহ চৌধুরীর ১৯৪১ সালের ২৭ ডিসেম্বর। তাঁর শিক্ষাজীবন কর্মজীবনের মতোই উজ্জ্বল। তিনি এমবিবিএস করেছেন ঢাকা মেডিকেল কলেজ থেকে এবং ইংল্যান্ড থেকে করেছেন পিএইচডি। আবার দেশের ভয়াল সময়ে বীরদর্পে ঝাঁপিয়ে পড়তে দ্বিধা করেননি রণক্ষেত্রে। তাই তো ডাঃ জাফরুল্লাহ চৌধুরী এদেশের ইতিহাসের এবং বর্তমানের সাথে সর্বময় জড়িত একটি নাম। এই মহান ব্যক্তিত্বের সঙ্গে “কবিতার সাথে” আয়োজনের একান্ত আড্ডায় উঠে এল তাঁর বর্তমান জীবন, করোনা পরিস্থিতি এবং আমাদের দেশ ও সমাজ নিয়ে নানা গুরুত্বপূর্ণ তথ্য তথা উপদেশও।
করোনা প্রতিষেধক ও এর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া ইত্যাদি নিয়ে বলতে গিয়ে তিনি বললেন, এসব নিয়ে ভয় পাওয়ার কিছু নেই, এগুলো সাধারণ এলার্জি জনিত পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া। বরং তিনি গর্ব করে বলেন যে, যেখানে অনেক দেশের মানুষকে ভ্যাক্সিনের ব্যাপারে বুঝাতে হয়, আমাদের দেশের মানুষরা নিজে থেকেই বুঝতে এবং সে অনুযায়ী কাজ করতে পারে। নিজের মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলো স্মরণ করে তিনি বলেন, বিলেতে থাকার কারণে ৭ই মার্চের ভাষণ তখন শোনা হয়নি তাঁর। কিন্তু একদিন তিনি বিদেশে বসেই পান বঙ্গবন্ধুর অসম সাহসের সাক্ষাৎ। যখন সাংবাদিক প্রশ্ন করেন যে পাকিস্তানীদের হাতে খুন হওয়ার ভয় আছে কিনা, বঙ্গবন্ধু উত্তর দেন, ৭ কোটি বাঙ্গালি মেরে ফেলার মত বুলেট কি তাদের আছে? ডাঃ জাফরুল্লাহর ভাষ্যমতে, সেই কথা শোনার পরেই তাঁর নিজের সকল সন্দেহ, বিভ্রান্তি উবে যায়। তারপর যখন ২৫ মার্চের ভয়াবহতার খবর পান বিদেশে বসে, তখনই আঁকড়ে ধরে দেশপ্রেম ও দায়িত্ববোধ। বিলাত ও আমেরিকার সমমনা বাঙ্গালি ছাত্র-ছাত্রীদের নিয়ে এপ্রিলের মাঝামাঝি গঠন করেন বাংলাদেশ মেডিকেল এসোসিয়েশন। যুদ্ধ নিয়ে বলতে গিয়ে বলেন, আমরা মূলত যুদ্ধ করেছি তিন জায়গায়, একটা ভারতে, যেখানে আমরা আমাদের অনেক ব্যবস্থা গড়ে তুলেছিলাম, দ্বিতীয় যুদ্ধ ছিল দেশের অভ্যন্তরে এবং তৃতীয় ফ্রন্টটি ছিল ইউরোপে এবং আমেরিকায়, যেখানে বিচারপতি আবু সাইদ চৌধুরীর হাত ধরে চলেছে কূটনৈতিক এক যুদ্ধ। এই বীর মুক্তিযোদ্ধা মনে করেন, এই প্রবাসী বাঙ্গালীদের কল্যাণে এবং আবু সাইদ চৌধুরীর নেতৃত্বেই আমরা বঙ্গবন্ধুকে জীবিত ফেরত আনতে পেরেছিলাম।
তাঁর গল্পে গল্পে উঠে আসে কীভাবে মুক্তিযুদ্ধের সময় কাছ থেকে দেখা মানুষের দুঃখ-দুর্দশা, আশা, আকাঙ্ক্ষা সব কিছু ভেতর থেকে নাড়া দিয়েছিল তাকে। সেই অনুপ্রেরণা থেকেই ৪৮০ বেডের “বাংলাদেশ হাসপাতাল” প্রতিষ্ঠা করেছিলেন যা চিকিৎসা দিয়ে গেছে দুর্গতদের ও আহত মুক্তিযোদ্ধাদের। জেনারেল ওসমানীর কথা উল্লেখ করে তিনি জানান সে সময়ে তাঁর বীরগাঁথা গল্প তাকে ব্যাপক অনুপ্রেরণা ও উৎসাহ দিয়েছিল। অনেক বাধাবিপত্তি পেরিয়ে অবশেষে অসংখ্য বাঙ্গালি ইচ্ছুক নারীদেরকে তিনি রূপান্তর করেছিলেন একদল দক্ষ নার্সে। তখনই তাদের চিন্তাধারায় দেশের জন্য একটি উন্নত স্বাস্থ্যব্যবস্থা গড়ে তোলার স্বপ্ন বাসা বাঁধে যার মূল চাবিকাঠি হবে নারীরা।
ডাঃ জাফরুল্লাহ জানান “গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র” নামটা স্বয়ং বঙ্গবন্ধুর দেয়া এবং নামের পাশাপাশি তিনি এ হাসপাতালে ৩১ একর জমি দিয়েছিলেন এদেশের প্রান্তিক মানুষের সুচিকিৎসা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে। নিজের আদর্শের সাথে মিল না থাকায় ও নিজের কাজ বাধাগ্রস্ত হবে এই চিন্তায় তিনি মেজর জিয়ার মন্ত্রীসভায় মন্ত্রীত্বের প্রস্তাবও ফিরিয়ে দিয়েছিলেন এবং হাসপাতালের জন্য দেয়া ব্ল্যাঙ্ক চেক তিনি প্রত্যাখ্যান করেছেন।
সাম্প্রতিক ভাস্কর্যবিরোধী আন্দোলনের প্রেক্ষিতে তিনি বলেন, ভাস্কর্য তো এদেশে নতুন কিছু নয়। তাহলে হঠাৎ এখন কেন একদল কট্টরপন্থীর উদ্ভব হচ্ছে? তিনি মনে করেন এর পেছনে বড় একটি কারণ হল পশ্চিমা বিশ্বের বিরুদ্ধে আমাদের রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের আত্মসম্মানবোধের অবস্থান। তিনি বলেন, বিশ্বের সকল মুসলিম দেশেই ভাস্কর্য আছে। এই মহান চিকিৎসক বরং মনে করেন, এ ধরনের কর্মকান্ড থেকে বেরিয়ে এসে আমাদের উচিৎ আধুনিক জগতের সাথে চিন্তা করা, মানুষের ক্ষুধা নিবৃত করার চেষ্টা করা, বিভিন্ন মাদরাসায় যে কিছু সংখ্যক মানুষ বলৎকার কিংবা নির্যাতনের মত অপরাধে লিপ্ত সেগুলো সমাধান করা, শিক্ষাব্যবস্থা এমন করা যাতে এগুলো একদমই না ঘটে। এছাড়া পোশাক, পর্দা, সংস্কৃতির মত বিতর্কগুলোকেও সরিয়ে রেখে সুন্দর এবং সুস্থ্য সমাজ ব্যবস্থার দিকে ধাবিত হওয়ার জন্য আমাদের কাজ করা উচিৎ বলে তিনি মনে করেন। তাঁর মতে, মেয়েদের আগ্রগতি না হলে দেশের আগ্রগতি হবে না।
ডাঃ জাফরুল্লাহকে জিজ্ঞেস করা হয় তাঁর অনন্য কাজ – ১৯৮২ সালের ওষুধনীতি নিয়ে এবং এর বর্তমান প্রায়োগিক আবস্থা নিয়ে। তিনি জানান, এর সাথে আরও জড়িয়ে আছে সাদাত চৌধুরীর নাম। তৎকালীন সময়ে “বিচিত্রা”র অবদান তিনি উল্লেখ করেন শ্রদ্ধাভরে। তিনি জানান, ১৯৭৪ সালে দেশের “ওষুধ সাম্রাজ্যে”র বিরুদ্ধে তাঁরা সম্মিলিতভাবে সরকারকে বোঝান, যেটি ছিল তাদের ’৮২ এর জাতীয় ওষুধনীতির ভিত্তি। তারপর ৮২ এর এই উদ্যোগ পুরো পৃথিবীর সামনে এক নতুন বাস্তবতা তুলে ধরে, জানিয়ে দেয় কীভাবে ওষুধ মানুষের কাছে সহজলভ্য করে তোলা যায়। গ্রামের অশিক্ষিত মেয়েদেরকেও কীভাবে প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ দিয়ে তাঁরা অপারেশন করার মত দক্ষ করে তুলতে পেরেছেন, সেটিকে তিনি নিজের বড় একটি অর্জন হিসেবে দেখেন। এই যে চিকিৎসাক্ষেত্রের বড় একটি কুসংস্কারকে ভাঙা, এটাকে বিরাট একটি সাফল্য হিসেবে বিবেচনা করেন তিনি। দেশের গণতন্ত্র নিয়ে কথা বলতে গিয়ে তিনি স্মরণ করেন বঙ্গবন্ধুর কথা, যিনি আজীবন গণতন্ত্রের জন্য লড়াই করে শেষকালে এসে বাকশাল প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, ডাঃ জাফরুল্লাহ যেটার ঘোরবিরোধী ছিলেন।
কথায় কথায় উঠে আসে ডাঃ জাফরুল্লাহ চৌধুরীর ব্যক্তিজীবনের গল্প – শৈশব, পরিবার ইত্যাদি। তিনি জানান, তাঁর ডাক্তার হওয়ার পেছনে সবচেয়ে বড় অবদান তাঁর মায়ের। তাঁর মা তাকে বলতেন মানুষের দুর্দশা, চিকিৎসাহীন ভাবে মারা যাওয়া নিয়ে কিছু করতে। সে জন্যেই হয়ত তাঁর জীবনের বড় অংশ আবর্তিত হয়েছে তাঁর আপাত “অশিক্ষিত” মাকে ঘিরেই। সেই মা দেখে গিয়েছেন ছেলের স্বপ্নের বাস্তবায়ন – গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র। গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের রয়েছে নিজস্ব পুকুর, খামার, মাঠ, যেখানে সবাইকে দৈনিক অন্তত এক ঘন্টা কাজ করতে হয় বলে জানান তিনি। ডাঃ জাফরুল্লাহ এর কারণ হিসেবে উল্লেখ করেন, যাতে করে ডাক্তাররা কৃষকদের কষ্টের জীবন সম্পর্কে জানতে পারেন, যাতে করে তাঁরা জনগণের আরও কাছে যেতে পারেন।
ডাঃ জাফরুল্লাহ চৌধুরীর আরেকটি বিশাল কৃতিত্ব হল, কিডনি ডায়ালাইসিস এর মত ব্যয়বহুল একটি প্রক্রিয়াকে তিনি নিয়ে গিয়েছেন গ্রামের দরিদ্র জনগোষ্ঠীর হাতের মুঠোয়। এই ব্যবস্থা কেনো আরও প্রতিষ্ঠান নিতে পারছে না, এমন প্রশ্নের জবাবে বলেন, এ ব্যাপারে সরকারের কিছু দায়িত্ব রয়েছে যেগুলো সরকার পালন করছে না। যেমন, ’৮২ সালের ওষুধনীতিতে তাঁরা বলেছিলেন, ওষুধের মূল্যের ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠানের লাভ অবশ্যই দেখতে হবে, কিন্তু সেটি যাতে আকাশ্চুম্বী না হয়। এছাড়া অনেক দেশে কিডনি রোগীরা কিছু সুবিধা পেয়ে থাকেন, যেমন তাদের পরিবহন খরচ কিছুটা কম লাগে। কারণ এই চিকিৎসা প্রতি সপ্তাহে নিতে হয়। আমাদের দেশে রোগীরা চিকিৎসার সমপরিমাণ খরচ যাতায়াতে করতে করতে নিঃস্ব হয়ে যান বলে মন্তব্য করেন ডাঃ জাফরুল্লাহ চৌধুরী। তিনি বলেন, সরকারের উচিৎ এই খাতে আরও সুবিধা এবং ভর্তুকি প্রদান করা। ক্ষোভ প্রকাশ করেন যে, আমাদের মধ্যে দেশের জন্য দরদ নেই, আর যারা দেশ চালান, তাঁরা চিকিৎসা করান বাইরে গিয়ে। তিনি জানান, গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রে এক দিনে ২৮৫ জনের মত মানুষেরও ডায়ালাইসিস হয়, যার ৪০% ই ডায়ালাইসিস করান ৭০০-৮০০ টাকায়। এর প্রযুক্তিগত সুযোগ সুবিধাও সর্বোচ্চ মানের, যে কারণে তিনি নিজেও এখানে চিকিৎসা নেন। এমনকি আমেরিকা থেকে একজন বিশেষজ্ঞ ডাক্তার ৩-৪ মাস পর পর এসে সব কিছুর তদারকি করে যান বলে আমরা জানতে পারি ডাঃ জাফরুল্লাহ চৌধুরীর কাছে। তারপরও একটি বিরাট দুর্ভাগ্যের ব্যাপার হল, এখানে সরকারের তেমন কোনো সহযোগিতা নেই।
সবশেষে তিনি জানান, এই স্বাধীন বাংলাদেশের মানুষের মুখের হাসিটাই তিনি দেখতে চান। মানুষের সেবা করে যেতে চান। এত সহজে আমরা চাইলেই উন্নতি করতে পারি, কিন্তু দুর্নীতি, সরকারের ভুল চিন্তাভাবনা ইত্যাদির কারণে বরং বৈষম্য বাড়ছে, এই ব্যাপারটাই কষ্টদায়ক বলে উল্লেখ করেন ডাঃ জাফরুল্লাহ চৌধুরী। আক্ষেপ করে বলেন, পরিবর্তন এত সহজ, সেটা তিনি অনেক চেষ্টা করেও বোঝাতে পারছেন না মানুষকে। দেশের ধনীরা এবং দেশের বাইরে যারা আছেন, তারা এগিয়ে আসলেই আর কারও সাহায্য ছাড়াই গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র সফল হবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন তিনি। এই বয়সে এসেও নিজের আগে গণমানুষের চিন্তা করা এই মানুষটা যাতে আরও সফলতার সাথে এগিয়ে যান, এই প্রত্যাশা হৃদয়ের অন্ত্যস্থল থেকে। কারণ তাঁর সফলতার মাঝেই রয়েছে এদেশের সাধারণ মানুষের হাসি।