প্রতিবছর বিশ্বখ্যাত টাইম ম্যাগাজিন ‘গ্লোবাল হিরো অব দি এনভায়রনমেন্ট’ অ্যাওয়ার্ড ঘোষণা করে। ২০০৭ সালের ২৫ অক্টোবর সেই হিরোদের তালিকায় উঠে আসে বাংলাদেশের এক বিজ্ঞানীর নাম। তিনি যুক্তরাষ্ট্রের জর্জ মেসন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. আবুল হুসসাম। ভূগর্ভস্থ আর্সেনিকযুক্ত পানি পরিশোধন যন্ত্র ‘সনো ফিল্টার’ আবিষ্কারের জন্য ‘গ্লোবাল হিরো অব দি এনভায়রনমেন্ট’ অ্যাওয়ার্ড পান বাংলাদেশের এই বিজ্ঞানী।ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৭৫ সালে তিনি রসায়নে স্নাতক সম্পন্ন করেন এবং একই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৭৬ সালে স্নাতকোত্তর করেন। ১৯৮৬ সালে পেনসিলভানিয়ার ইউনিভার্সিটি অব পিটার্সবার্গ থেকে অর্জন করেন পিএইচডি ডিগ্রি। ইউনিভার্সিটি অব মিনেসোটার রসায়ন বিভাগ থেকে পোস্ট ডক্টরাল ট্রেনিং সম্পন্ন করেন তিনি। ১৯৮৫ সাল থেকে কাজ করছেন জর্জ মেসন বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন ও প্রাণরসায়ন বিভাগে। তিনি সেখানকার অধ্যাপক। এ ছাড়া তিনি রিসার্চ ফেলো হিসেবে কাজ করেছেন জর্জটাউন বিশ্ববিদ্যালয় এবং কেস ওয়েস্টার্ন রিজার্ভ বিশ্ববিদ্যালয়ে। ড. হুসসাম এই বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্ডারগ্র্যাজুয়েট ও গ্র্যাজুয়েট লেভেলে পড়ান কোয়ান্টিটেটিভ কেমিক্যাল অ্যানালাইসিস, ইনস্ট্রুমেন্টাল অ্যানালাইসিস, ইলেকট্রো-অ্যানালাইটিক্যাল কেমিস্ট্রি এবং থিওরি অব অ্যানালাইটিক্যাল প্রসেস বিষয়ে।
আর্সেনিক সনো ফিল্টার আবিষ্কার এর গবেষণা প্রক্রিয়া শুরু হয় পরিমাপের মাধ্যমে । যেহেতু বাংলাদেশের প্রায় সব মানুষই পান করার জন্য ভূগর্ভস্থ পানির উপর নির্ভর করে এবং সেই পানিতে আর্সেনিকের উপস্থিতি পাওয়া গেছে এর প্রেক্ষিতে আর্সেনিকের পরিমাণ নির্ণয়ের মাধ্যমে গবেষণা প্রক্রিয়া শুরু হয়। এর পরের ধাপে এই ভূগর্ভস্থ আর্সেনিক কিভাবে দূর করা যায় তা নিয়ে গবেষণা শুরু হয়। আর্সেনিক শোধনের সহজ উপায় হিসেবে এমন একটি পদার্থ খুঁজে বের করতে তিনি উদ্যোগী হন যা এই আর্সেনিককে শোষণ করবে। এর প্রেক্ষিতে তিনি লৌহ বা আয়রন ভিত্তিক পদার্থ আবিষ্কার করেন যা আর্সেনিককে শোষণ করতে সক্ষম। এর উপস্থিতিতে ভূগর্ভস্থ পানি ফিল্টার করলে তা হবে আর্সেনিক মুক্ত। এটি ‘ Composite Iron Matrix ‘ নামে পরিচিত। এই পদার্থের উপর ভিত্তি করেন আবুল হুসসাম আর্সেনিক সনো ফিল্টার আবিষ্কারে সফলতা পান।
গবেষণার শুরুতে আবুল হুসসামের লক্ষ্য ছিল ভূগর্ভস্থ পানি থেকে আর্সেনিক দূরীকরণের মাধ্যমে তা পানযোগ্য করে তোলা। সে লক্ষ্যেই তার আবিষ্কার। এখন পর্যন্ত ৪০০০ এর বেশি ফিল্টার চালু রয়েছে। এগুলোর মেয়াদ ১৫ বছরের মত হবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন তিনি। যে সকল অঞ্চলে ভূগর্ভস্থ পানিতে আর্সেনিকের পরিমাণ বেশি সেখানে এই ফিল্টার ব্যবহার করে বিষাক্ত পানিকে পানযোগ্য করে তোলা হচ্ছে এবং মানুষ তা পান করছে। তবে এর সফলতা নিয়ে এখন পর্যন্ত কোনো পোক্ত পরিসংখ্যান পাওয়া যায় নি। তবে বিজ্ঞানী আবুল হুসসাম এতটুকু নিশ্চিত করতে পেরেছেন যে আর্সেনিক বিষের ফলে উদ্ভূত রোগের বিস্তার আর হবে না।
এসিড রেইন সম্পর্কে আবুল হুসসাম বলেন, যে সকল অঞ্চল বিশেষত শিলকারখানা সমৃদ্ধ অঞ্চলগুলোতে যেখানে কয়লার ব্যবহার অতিমাত্রায় হয় সেখানে এই এসিড রেইন এর প্রকোপ দেখা যায়। কয়লার ধোঁয়ায় থাকে সালফার ডাই অক্সাইড। এটি যখন পানির সাথে বিক্রিয়া করে তখন উৎপন্ন করে সালফিউরিক এসিড। বৃষ্টির পানির সাথে এটি যখন ভূপৃষ্ঠে পতিত হয় তখনই এই বৃষ্টিকে এসিড রেইন বলা হয়৷ তবে বাংলাদেশে এই এসিড রেইনের প্রকোপ লক্ষ্য করা যায়নি কারণ বাংলাদেশে এ ধরণের কোনো শিল্প কারখানা নেই। শিল্প বিপ্লবের সময় এবং এই শিল্প বিপ্লবের কারণেই এসিড রেইনের উদ্ভব হয়েছিল। এসিড রেইনের কারণে পানির পি এইচ ফ্যাক্টর অর্থাৎ পানির অম্লতার পরিমাণ বেড়ে যায়। পানির এই অম্লত্ব বৃদ্ধি পাওয়া প্রাণীজগতের জন্য ক্ষতিকর। তবে প্রযুক্তিগত উৎকর্ষ সাধনের ফলে এই এসিড রেইনের প্রকোপ কমতে শুরু করেছে। এখন দেশগুলো বা শিল্পগোষ্ঠী গুলো ‘ইপিএ গাইডলাইন ‘ মেনে চলে যা আশেপাশের জলাশয়ের পানির পিএইচ এর পরিমাণ নির্ণয় করে বলে সে অঞ্চলে এসিড রেইনের উপস্থিতি আছে কি না।
আবুল হুসসাম একসময় বিজ্ঞান সাময়িকীতে বাংলায় লিখতেন। তবে এখন আর বাংলার লেখালেখি হয়ে ওঠে না। তবে তিনি সবসময় বাংলার বিজ্ঞান চর্চায় ইচ্ছুক এবং গবেষণাতে তিনি এখন ভীষণ মনযোগী। তিনি ব্যক্তিজীবনে একজন সাহিত্য অনুরাগী মানুষ। তবে এখনো গল্প কবিতা লেখা হয়ে ওঠেনি আবুল হুসসামের। ব্যক্তিজীবনে আবুল হুসসাম বিয়ে করছেন নিজের পছন্দের মানুষকেই তবে পারিবারিকভাবেই৷ আবুল হুসসামের স্ত্রী ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একই বিভাগের শিক্ষার্থী ছিলেন৷
নিজের বেড়ে ওঠা ও বিজ্ঞানী হওয়ার পিছনের তিনি সবথেকে বড় কৃতিত্ব দেখেন তার বাবা মা এর। আবুল হুসসামের বিজ্ঞানী হওয়া বা পড়াশোনা করার কারণ হিসেবে তিনি তার পিতার কথা উল্লেখ করেন। বাম ঘরানার রাজনীতির সাথে যুক্ত ছিলেন আবুল হুসসামের পিতা। তার পিতার চিন্তা ধারা তার ছোট ভাইয়ের অর্থনীতি পড়ার কারণ বলেও জানান তিনি। আব্দুল্লাহ আল মুতী শরফুদ্দীনের লেখা বিজ্ঞান বিষয়ক বইগুলো থেকে ছোট ছোট পরীক্ষাগুলো হাতে কলমে করে সন্তানদের দেখাতেন তিনি। এই পরীক্ষাগুলো না বাড়ির পরিবেশ আবুল হুসসামের বিজ্ঞানী হওয়ার পিছনে বড় ভূমিকা রেখেছে৷ তিনি রসায়ন পড়তে উদ্বুদ্ধ হন নিজের পিতার পেশার কারণে।
আবুল হুসসামের স্কুল জীবনের শিক্ষক ফজলুর রহমান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক প্রফেসর গিয়াসউদ্দিন আহমেদ ও আমির হোসেনকে আদর্শ মনে করেন তিনি। এই মানুষগুলোর থেকে তিনি শুরু থেকেই প্রভাবিত ছিলেন৷ তিনি মনে করেন কাদের সান্নিধ্যে কাজ করছেন এটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
নতুন প্রজন্মের উদ্দেশ্যে আবুল হুসসাম বলেন, নিজের পেশার প্রতি প্যাশন থাকাটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। যে কাজ করতে হবে তা প্রথমে ভালো করে শেখা উচিত৷ তাহলে প্রাথমিকভাবে অর্থ না থাকলেও কাজে আনন্দ পাওয়া যাবে, ভাল করে কাজটা শেখা যাবে৷নতুন নতুন কাজ সম্পর্কে জানতে হবে এবং শিখতে হবে নিজের উদ্যোগে। নিজের উদ্যোগ বা ইচ্ছা না থাকলে সাফল্য পাওয়া সম্ভব হবে না৷তিনি বলেন, কোনো কাজ নিবিড়ভাবে দশ বছর করলে সেই ধারায় বিখ্যাত হওতা সম্ভব।
কুষ্টিয়ার মানুষ হলেও আবুল হুসসামের উপর রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বা লালন ফকির কারোই প্রভাব নেই। ছেলে বেলায় তিনি বহুবার লালনের দর্গায় গেছেন৷ ছেলে বেলায় বাড়িতে কোনো অতিথি এলেই তিনি তাদের শিলাইদহ কুঠি বাড়ি এবং মোহিনী মিল ঘুরিয়ে নিয়ে আসতেন৷ তিনি প্রচুর সাহিত্যকর্ম অধ্যয়ন করেন। ররবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের বইগুলো তার বিশেষ পছন্দের৷ একসময় সংগীত এর তালিম ও নিয়েছেন এবং নিজেও শিখেছেন।
তিনি সবসময় বিশ্বাস করেন সাহিত্য ও বিজ্ঞান বাংলায় চর্চা করা উচিত। ১৯৭৩ সালে বিখ্যাত বিজ্ঞানী সত্যেন বোস ও নিজের লেখা চিঠিতে বাংলায় বিজ্ঞান চর্চার কথা বলেছেন। এ বিষয়ে আলোকপাত করে তিনি বিজ্ঞান সাময়িকীতে চিঠিও পাঠিয়েছিলেন। এর কারণ হিসেবে আবুল হুসসাম মনে করেন, বিজ্ঞান শেখা ও জানার বিষয় এবং তা নিজের মায়ের ভাষাতেই সবথেকে বেশি সম্ভব।