কামাল হোসেন বাংলাদেশের একজন বিশিষ্ট আইনজীবী, রাজনীতিবিদ এবং মুক্তিযোদ্ধা। সচরাচর তাকে “ডঃ কামাল হোসেন” হিসাবে উল্লেখ করা হয়। তিনি বাংলাদেশের সংবিধান প্রণেতাদের মধ্যে অন্যতম। বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পর ১৯৭২-এর ৮ই জানুয়ারি জাতির পিতার সাথে তিনিও কারাগার থেকে মুক্তি পান এবং জাতির পিতার সাথেই ১০ জানুয়ারি লন্ডন হয়ে বাংলাদেশে প্রত্যাবর্তন করেন। বাংলাদেশের রাজনীতিতে তিনি সর্বদাই সোচ্চার। তিনি ব্যক্তিগত সততা, ন্যায্যতা, মানবাধিকার ও গণতন্ত্রের প্রবক্তা হিসাবে বিশেষভাবে সম্মানিত । ১৯৭০ সালের পাকিস্থানের জাতীয় পরিষদ নির্বাচনে পূর্ব পাকিস্তান থেকে আওয়ামীলীগের প্রার্থী হিসেবে জয়ী হয়েছিলেন। ১৯৭২ সালে স্বাধীন বাংলাদেশের সংবিধান রচনা কমিটির চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।১৯৭২ সালে আইনমন্ত্রী এবং ১৯৭৩ থেকে ১৯৭৫ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ড. কামাল হোসেন জাতিসংঘের স্পেশাল রিপোর্টারের দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি বিভিন্ন আন্তর্জাতিক কর্মকাণ্ডে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন । আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্যও ছিলেন কামাল হোসেন। ১৯৯২ সালে আওয়ামী লীগ থেকে বেরিয়ে এসে ১৯৯৩ সালে গঠন করেন গণফোরাম। তিনি গণফোরামের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি।
বাংলাদেশের রাজনীতি ও গণফোরাম প্রসঙ্গে ড.কামাল হোসেনের অভিমত হল, এটি মানুষের জন্য সুযোগ। যারা সুযোগ কাজে লাগাতে চায় তারা এগিয়ে আসবে এবং সুস্থ রাজনীতির সাথে জড়িত সকলেই এগিয়ে আসবে এবং গণফোরাম তাদের জন্য মাধ্যম হিসেবে কাজ করবে৷ গণতন্ত্রের সংকটময় সময়ে সবথেকে বেশি জরুরি গণমানুষের ঐক্য এবং সুস্থ রাজনৈতিক মূল্যবোধ যার মাধ্যমেই কেবল সুস্থ রাজনীতিকে লালন করা সম্ভব। আর এই অবস্থা সবার কাছে গ্রহণযোগ্য হলেই শুধুমাত্র বর্তমান অবস্থার গুণগত উন্নতি সম্ভব৷এক্ষেত্রে সবথেকে বড় নিয়ামক হিসেবে কাজ করবে রাজনৈতিক সহাবস্থান , ঐক্য এবং ইচ্ছাশক্তি।
নিরপেক্ষ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য জনগণকেই ঐক্যবদ্ধ হয়ে দাবি জানাতে হবে। আর এর মাধ্যমেই তৈরি হবে সুন্দর একটু পরিবেশ যেখানে অবাধ, নিরপেক্ষ ও সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজন সম্ভব হবে৷তবে এক্ষেত্রে দলগুলোর ভূমিকাও গুরুত্বপূর্ণ। যদিও দলগুলোর আলাদা এজেন্ডা থাকে তবুও জনগণের স্বার্থে তাদের নিজেদেরও মৌলিক বিষয়গুলোতে ঐক্যমত্যে পৌঁছাতে হবে৷
সংবিধান রচনায় কোনো পরিবর্তন সম্পর্কে কামাল হোসেন বলেন, এ বিষয়ে সবার আগে জনগণের মতামত প্রয়োজন তারা যদি মনে করে কোনো পরিবর্তন প্রয়োজন সেক্ষেত্রে জনমত যাচাই বাছাই এর মাধ্যমে বিশেষজ্ঞদের মত একত্রিত করে সংবিধানের পরিবর্তন আসতে পারে৷
সমাজতন্ত্রের মূল চেতনার সাথে সমসাময়িক সমাজতন্ত্রের ব্যবধান এখনকার বিশ্বাস ও কার্যকলাপে। যারা সত্যিকারের সমাজতন্ত্র ও সাম্যে বিশ্বাস করে তাদের সাথে বৈষম্য লালনকারী গোষ্ঠীর মৌলিক চেতনাতেই বিস্তর ফারাক লক্ষ্যনীয়। আর বর্তমানে এটাই দেখা যাচ্ছে।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে অনেক কাছে থেকে দেখেছেন ড. কামাল হোসেন। বঙ্গবন্ধু সবসময় ভাবতেন জনগণ কি চিন্তা করে এবং তাদের চাহিদা সম্পর্কে। তিনি এ বিষয়গুলোই সবসময় তুলে ধরতেন এবং এর উপর ভিত্তি করেই বৃহৎ ঐক্য গড়ে তুলতেন। যারা কারণে সবাই সুসংহত হতে পারত৷ এই ঐক্যের রাজনীতির কারণেই বঙ্গবন্ধু নির্বাচনে বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করেন৷ তিনি মানুষকে বিশ্বাস করে। ঝুঁকি নিতেন। তিনি সবাইকে খুব সহজেই নিজের আপনজন করে নিতে পারতেন। বঙ্গবন্ধুর কাছে সবাই বিশেষ গুরুত্ব পেতেন। তিনি সবার চাহিদার কথা শুনতেন তাদের সাথে আলোচনা করতেন। এই সবার সাথে সম্পর্ক গড়ার সফলতাই শেখ মুজিবুর রহমানকে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তৈরি করেছে। তিনি ছিলেন একজন অনন্যসাধারণ মানুষ যিনি সবার চাওয়া পাওয়াকে গুরুত্ব দিতেন। তিনি ছিলেন জনগণের একজন।
বঙ্গবন্ধু অসাধারণ বৈশিষ্ট্যগুলোই দলমত নির্বিশেষে সবার কাছে ‘আমার নেতা’ হিসেবে পরিচয় করায়। বঙ্গবন্ধুর ব্যক্তিত্ব, বক্তব্য এবং সবাইকে ঐক্যবদ্ধ করার ক্ষমতার কারণে তিনি দলীয় গন্ডি থেকে বেরিয়ে একজন জাতির পিতা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে। বর্তমানে নেতৃত্বে এই জিনিসের ঘাটতি আছে বলে মনে করেন ড. কামাল হোসেন।
তবে আমাদের উচিত আশাবাদী হওয়া। কারণ জাতীয় ঐক্যের কথা বঙ্গবন্ধু সবসময় বলেছেন এবং জাতি হিসেবে আমরা সংকটের সময় ঐক্যবদ্ধ হতে পারি যার বহু ইতিহাস রয়েছে৷ এর ভিত্তিতেই বঙ্গবন্ধু নির্বাচন আদায় করেছেন। তবে বর্তমান প্রেক্ষাপটে দলীয় বিভাজনের কারণে এ ধরণের ঐক্য কঠিন। কিছু দল তবুও চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। আর সুস্থ, দুর্নীতিমুক্ত রাজনীতির জন্য দরকার জনগণের ঐক্য ও তাদের একীভূতকরণ।
ড. কামাল হোসেন লেখাপড়া করেন সেন্ট জেভিয়ার্স হাইস্কুলে। সেখানকার পরিবেশ, বন্ধুত্ব, ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ও নীতির কারণে অনেক কিছুই অর্জন করতে পেরেছেন এবং গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে পদক্ষেপ নিতে পেরেছেন। গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোতে নীতিগত ঐক্যমত থাকলে অনেক কিছুই অর্জন সম্ভব। যারা বিভক্তিতে বিশ্বাস করে এবং এর মাধ্যমে অর্জন করতে চায় তাদের ব্যাপারে সকলের সচেতন থাকা উচিত বলে তিনি মনে করেন৷
রাজনীতি সবথেকে বড় সফলতা হিসেবে কামাল হোসেন দেখেন আমাদের স্বাধীনতা আন্দোলনের সফলতাকে। তবে রাজনীতিতে অনেক বিষয়ে ব্যর্থতাও দেখেছেন। রাজনীতিকে অবাধ দুর্নীতি ও সাম্প্রদায়িকতা থেকে যে মুক্ত করা সম্ভব হয়নি এটিকে তিনি বড় ব্যর্থতা হিসেবেই দেখেন।
ড. কামাল হোসেনের বিশ্বাস, ভবিষ্যতে সকলেই সুস্থ রাজনীতি ও আদর্শকে কেন্দ্র করে একীভূত হবে। সংঘাতবিহীন বহুদলীয় গণতন্ত্র থাকবে। সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জনকারী দল ক্ষমতায় থাকবে এবং একদলীয় শাসন থাকবে না। তিনি মনে করেন ১৯৭০ এ আমরা এমন সাফল্য অর্জন করতে পেরেছি। তবে এরপর থেকে বহুবার আমরা একদলীয় গণতন্ত্রের রোগে আক্রান্ত হয়েছি। এ ব্যাপারে সচেতনতা একান্ত কাম্য। তিনি আরো মনে করেন, অতীতের রাজনীতি এবং সুস্থ রাজনৈতিক ধারা সম্পর্কে নতুন প্রজন্মকে কিভাবে বোঝানো হচ্ছে এটা গুরুত্বপূর্ণ।
দুর্নীতি আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে একটি সামাজিক রোগ। এর নিরাময়ে সরকারকে কোনো বলিষ্ঠ ভূমিকা নিতে দেখা যায়নি। দুর্নীতিকে তারা নিজেদের স্বার্থে কাজে লাগায় এবং সমর্থন করে এতে করে দুর্নীতি আরো ব্যাপক আকার ধারণ করে৷ এর নিরসনে সুস্থ রাজনীতির ভূমিকা অপরিসীম।
ড. কামাল হোসেন আইনের প্রশিক্ষণ নিতেন হুসেন শহীন সোহরাওয়ার্দীর কাছে। সেখানেই বঙ্গবন্ধুর সাথে সখ্যতা গড়ে ওঠে এবং পরবর্তীতে বঙ্গবন্ধুর প্রচুর সান্নিধ্যও তিনি লাভ করেন। তিনি বঙ্গবন্ধু বিভিন্ন বিষয় নিয়ে অনেক প্রশ্ন করতেন। ড. কামালের সাথে শেরে বাংলার দেখা হলেও ঘনিষ্ঠতা ছিল না।
ড. কামাল বলিষ্ঠ নতুন প্রজন্ম তৈরি করতে চান। তবে বর্তমান প্রেক্ষাপটে সঠিক দিক নির্দেশনা গ্রহণের মত অবস্থায় নতুন প্রজন্ম নেই বলেই তার ধারণা৷ তবে তিনি চে্ষ্টা চালিয়ে যেতে চান৷নতুন প্রজন্মকে তিনি উচিত কথা বলার, ঐক্যবদ্ধ থাকার, মানুষের জন্য কাজ করার এবং সর্বক্ষেত্রে উচিত অনুচিত সম্পর্কে অবগত থাকার উপদেশ দেন। তিনি আশা করেন সবাই সুস্থধারায় সৎ সাহস নিয়ে দেশের জন্য কাজ করবে।