সাইফুর রহমান একজন বাংলাদেশী-আমেরিকান তড়িৎ প্রকৌশলী। তিনি বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৭৩ সালে ব্যাচেলর ডিগ্রি অর্জন করেন এরপর স্টেট ইউনিভার্সিটি অব নিউ ইয়র্ক থেকে ১৯৭৫ সালে মাস্টার্স এবং ভার্জিনিয়া টেক থেকে ১৯৭৮ সালে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন। তিনি ১৯৭৮ সালের সেপ্টেম্বর থেকে ১৯৭৯ সালে অগাস্ট পর্যন্ত টেক্সাস এ অ্যান্ড এম ইউনিভার্সিটি এর সহকারী অধ্যাপক হিসেবে কর্মরত ছিলেন। তিনি ১৯৭৯ সালের সেপ্টেম্বরে ভার্জিনিয়া পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট এবং স্টেট ইউনিভার্সিটিতে সহকারী অধ্যাপক হিসেব যোগদান করেন। ১৯৮৩ সালের সেপ্টেম্বরে সহযোগী অধ্যাপক এবং ১৯৮৭ সালের সেপ্টেম্বরে অধ্যাপক পদে উন্নীত হন। তিনি ১৯৯৪ সালের জানুয়ারিতে সেন্টার ফর এনার্জি অ্যান্ড দ্য গ্লোবাল এনভায়রনমেন্ট প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯৯৮ সালের সেপ্টেম্বরে প্রতিষ্ঠা করেন অ্যাডভান্সড রিসার্চ ইনস্টিটিউট। তিনি ১৯৯৬ সালের সেপ্টেম্বর থেকে ১৯৯৯ সালের সেপ্তেম্বর পর্যন্ত ন্যাশনাল সায়েন্স ফাউন্ডেশনের ইলেক্ট্রিকাল অ্যান্ড কমিনিকেশন সিস্টেমস ডিভিশনের কর্মসূচী পরিচালক হিসেবে কর্মরত ছিলেন।
ড. সাইফুর রহমানের জন্ম ঢাকার এলিফেন্ট রোড এ। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের অনেক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাই তিনি নিজের চোখে দেখেছেন যার মধ্যে ছিল ঊনসত্তরের গণ অভ্যুত্থান, ভারত পাকিস্তান যুদ্ধ বা একাত্তরে আমাদের মুক্তির সংগ্রাম। তিনি সাত মার্চে বঙ্গবন্ধুর ভাষণের সময় রেসকোর্স ময়দানে ছিলেন, ছিলেন ষোল ডিসেম্বর পাকিস্তান সেনাবাহিনীর আত্মসমর্পণের সময়। এর মাঝে ২৬ মার্চ সকালে দেখেছেন লাশের মিছিল। সেদিন পড়ে গিয়েছিলেন পাকিস্তান বাহিনীর রাইফেলের সামনেও। ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের দিন ছিলেন সেই জনযাত্রায়।
পূর্বতন শিক্ষাব্যবস্থার সাথে বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থার পার্থক্য হিসেবে ড. সাইফুর রহমান দেখেন শিক্ষার্থীদের ফোকাস বা লক্ষ্যে৷ একসময় শিক্ষার মূল লক্ষ্য ছিল জ্ঞান অর্জন করা আর কালের ফেরে তা এখন হয়ে গেছে ফলাফল নির্ভর। এখন সবাই শুধু ফলাফলের পেছনে ছোটে জ্ঞান হয়ে পড়েছে গৌণ৷ তিনি তার নিজের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বুয়েটের শিক্ষার মান নিয়ে কোনো সন্দেহের অবকাশ দেখেন না । তবে শিক্ষা গ্রহণ শেষে তারা কি করছে এটি একটি বড় প্রশ্ন৷ উপরের সারির শিক্ষার্থীদের ভাল করা নিয়ে কোনো প্রশ্ন না থাকলেও মাঝের সারির শিক্ষার্থীরা কি করছে এটি একটি ভাবনার বিষয়৷ তবে আইটি সেক্টরের উন্নতিতে এখন অর্থ উপার্জনের একটি উপায় হয়েছে বলে মনে করেন তিনি। তিনি শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যত নিয়ে ভারতের উদাহরণ টেনে বলেন সেখানে প্রতিবছর অনেক প্রকৌশলী বের হলেও চাকরির সুযোগ পায় না। কারণ তারা ঠিকভাবে শিখে আসে না। এজন্য তিনি জ্ঞান অর্জনে গুরুত্বারোপ করেন ।
তড়িতাহত হয়ে বাংলাদেশে প্রতিবছর অনেক মানুষ প্রাণ হারান। বজ্রপাতে এখন অহরহ মৃত্যুর ঘটনা শোনা যায়। এর কারণ হল বৃক্ষ নিধন। কারণ বিদ্যুৎ সবসময় উঁচু স্থানে আঘাত করে। গাছ পালা নিধনের ফলে এখন মানুষ হয়ে পড়েছে পুরোপুরি অরক্ষিত। এছাড়াও পর্যাপ্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থার অভাবে বা মানুষের অসচেতনতায় বিদ্যুৎপৃষ্ট হয়ে মৃত্যুর ঘটনাও অনেক দেখা যায়। এ থেকে উত্তরণের জন্য সচেতনতা ও শিক্ষার গুরুত্ব অপরিসীম।
বাংলাদেশ প্রযুক্তিখাতে এগিয়েছে তবে পুরোপুরি সেই স্রোতের সাথে তাল মেলাতে পারছে না। এর কারণ হিসেবে তিনি মনে করেন, প্রতিটি দেশেই অবকাঠামো ও প্রক্রিয়া গুরুত্বপূর্ণ কোনো খাতে উন্নতির জন্য৷ যুক্তরাষ্ট্রে আইটি সেক্টরের উন্নতির পেছনে সেখানের পরিবেশের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। এই পরিবেশের কারণে কোনো খাত অগ্রসর হয়৷ এছাড়াও যুক্তরাষ্ট্রে মেধার একটা সম্মেলন দেখা যার কারণে অন্য অনেকেই কাজ করতে আগ্রহী হয়৷ এই ক্রমাগত ধারাই তাদের আরো এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। প্রযুক্তিখাতে উন্নয়নের জন্য সরকারের উচিত একটা পরিবেশ তৈরি করা যেখানে এই খাত এগিয়ে যাওয়ার মত সব উপাদান পাবে৷ এক্ষেত্রে বাংলাদেশ সরকার দক্ষিণ কোরিয়ার মডেল অনুসরণ করতে পারে।
বাংলাদেশে বিভিন্ন সেক্টর যেমন কয়লা, গ্যাস, নিউক্লিয়ার এনার্জি, সোলার পাওয়ার,উইন্ড পাওয়ার ইত্যাদি থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন হচ্ছে বা উৎপাদনের প্রক্রিয়া চলছে। তবে এই সেক্টর গুলোর ব্যবস্থাপনাও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। স্মার্ট গ্রিড দিয়ে যা খুব সহজেই করা সম্ভব৷ যেমন, আকাশে মেঘ থাকলে সোলার প্যানেল বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে পারে না। তবে এখানে স্টোরেজ ব্যাটারি যুক্ত থাকলে তা কিছুক্ষণের জন্য হলেও বিদ্যুৎ সরবরাহ নিরবিচ্ছিন্ন রাখতে পারবে৷ তবে বাংলাদেশে স্মার্ট গ্রিড এর পুরোপুরি বাস্তবায়ন সময় সাপেক্ষ ব্যাপার। কারণ এজন্য কোথায় কাজ শুরু হবে, কোন পর্যায়ে বেসরকারি সংস্থাগুলো যুক্ত হবে, কোথায় সামর্থ্য আছে বা নতুন করে প্রয়োজন তা নির্ণয় করা জরুরী। এছাড়াও এই সিস্টেম চালু রাখা বা এরজন্য প্রয়োজনীয় সম্পদ ও বিনিয়োগের ধারাবাহিকতাও গুরুত্বপূর্ণ।
স্মার্ট গ্রিডের বাস্তবায়ন সম্ভব হলে তা ব্ল্যাক আউট রোধেও কার্যকর ভূমিকা রাখতে সক্ষম বলে মনে করেন তিনি। ব্ল্যাক আউটের কারণ হিসেবে আভ্যন্তরীণ সিস্টেম এ নেটওয়ার্ক এর সমস্যা দায়ী। তবে স্মার্ট গ্রিডের মাধ্যমে চলমান সময়েই এ সমস্যাগুলো বের করা সম্ভব এবং যে স্থানে সমস্যা তা পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন করে ব্ল্যাক আউটের সম্ভাবনা কমানো যায়। এই বিষয়টিতে স্মার্ট গ্রিড গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে৷
ব্যক্তিজীবনে অনেক বিখ্যাত মানুষের সান্নিধ্যে তিনি এসেছিলেন। তিনি বিশ্বাস করেন সফল হতে সবার একজন আদর্শ দরকার৷ তিনি ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার অনুপ্রেরণা পেয়েছেন তার দাদার কাছে। তিনি মনে করেন সফলতার পেছনে অনেক ধাপ রয়েছে। সবার একটি লক্ষ্য ঠিক করে তার জন্য পরিশ্রম করা গুরুত্বপূর্ণ । পরিশ্রমের ধাপ পেরোলেই কেবল সফলতা ধরা দেয়। তবে সফল হওয়ার ক্ষেত্রে পরিবারের ভূমিকাও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বলে তিনি মনে করেন।
অবসর সময়ে কবিতা পড়তে ভালবাসেন তিনি। নটরডেম কলেজে পড়ার সময় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঞ্চয়িতা বইটি কিনেছিলেন।এখনো বইটি তার নিত্যসঙ্গী। কাজের ফাকে তিনি এখনো কবিতা পড়েন। একসময় তারাশঙ্কর, শরৎচন্দ্র ও হুমায়ুন আহমেদের উপন্যাস পড়তেন নিয়মিত। তবে কাজের কারণে এখন আর উপন্যাস পড়া হয় না তার। তার স্বপ্ন সম্পর্কে বলেন, বিপদগ্রস্ত কেউ তার মাঝে বা তাকে দেখে নতুন পথের দিশা বা আশার আলো খুঁজে পেলেই তিনি নিজেকে সার্থক মনে করবেন। তিনি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করেন, ‘ keep the hope alive ‘ এই মন্ত্রে।
লিখেছেনঃ রোমান উদ্দিন