সাদাত হোসাইন নিজেকে বলেন গল্পের মানুষ। তার কাছে চারপাশের জীবন ও জগৎ, মন ও মানুষ সবই গল্প । গল্প বলার সেই আগ্রহ থেকেই একের পর এক লিখেছেন-তুমুল জনপ্রিয় সব উপন্যাস। নির্মাণ করেছেন, স্বল্প ও পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র, তথ্যচিত্র, টিভি ফিকশন। নিজের অভ্যস্ত পরিসরের পাশাপাশি শুরু করেছেন, মৌলিক থ্রিলার রেজা সিরিজ, কিশাের উপন্যাস, শিশুদের জন্য বই ইত্যাদি। জিতেছেন জুনিয়র চেম্বার ইন্টারন্যাশনাল অ্যাওয়ার্ড, বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির শ্রেষ্ঠ স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্রকার পুরস্কার, এসবিএসপিআরপি ফাউন্ডেশন সাহিত্য পুরস্কার, ভারতের চোখ সাহিত্য পুরস্কার, শুভজন সাহিত্য সম্মাননা।। ‘২০১৯-এ জিতেছেন এক্সিম ব্যাংক-অন্যদিন । হুমায়ুন আহমেদ সাহিত্য পুরস্কার। ২০২১-এ পেয়েছেন অন্যদিন সম্ভাবনার বাংলাদেশ (কথাসাহিত্য) সম্মাননা ও Marvel of Tomorrow Influencers Award. জিতেছেন আইএফআইসি ব্যাংক-কালি ও কলম সাহিত্য পুরস্কার ২০২১ জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগ। থেকে স্নাতকোত্তর সাদাত হােসাইনের জন্ম ১৯৮৪ সালের ২১ মে, মাদারীপুর জেলার কালকিনি থানার কয়ারিয়া গ্রামে।
লেখালেখিতে সাদাত হোসাইনের পথচলা খুব বেশি দিনের না। ২০১৫ সালে প্রকাশিত হয় তার প্রথম উপন্যাস আরশিনগর৷ বেস্ট সেলার বইগুলোর তালিকায় যেখান সব সময় নন ফিকশন বইগুলো ছিল সেখানে ২০১৭ সালে প্রথম সাদাত হোসাইনের লেখা জায়গা পায়৷ ২০১৮ সালেও তার বই বেস্ট সেলার এর তালিকায় উঠে আসে৷ ২০১৯ সালে এ অবস্থান আরো এগোয়৷ ফিকশন বই গুলোর মধ্যে বেস্ট সেলার লিস্ট এ ১০ টি বইয়ের মধ্যে ৪ টি বই তার। বেস্ট সেলারের তালিকায় তার লেখা ফিকশন বইগুলোর জায়গা পাওয়াটাকে তিনি দেখেন ইতিবাচক দিক হিসেবে৷কারণ মানুষ এখনো এই বইগুলো পড়ে যা নতুন আশার আলো দেখায়৷
আলোকচিত্রী সাদাত হোসাইন এখন পুরোপুরি একজন লেখক। তিনি নিজেকে সফল মনে করেন কারণ তিনি একজন পরিতৃপ্ত ও সন্তুষ্ট মানুষ। তার কাছে এটিই সফলতার মাপকাঠি। তার লেখা লেখির অনুপ্রেরণা হিসেবে কাজ করে তার হতাশাগুলো। যতবারই তিনি হতাশ হয়েছেন ততবারই কাজের মাধ্যমে সফলতার খোঁজ করেছেন। এই হতাশাই তাকে বারবার পুনর্জন্ম দেয়৷ ছোটবেলা থেকে লেখার জন্য তাকে সবাই নিরুৎসাহিত করত। এখন পর্যন্ত তাকে সমালোচনা শুনতে হয়৷তাই তিনি কোনো মানুষের কাছে থেকে নিজের লেখালেখিতে অনুপ্রেরণা খুজে পান না৷ তবে যারা তার লেখা ভালবাসে তাদের এই ভালবাসাকে অনুপ্রেরণা হিসেবে দেখেন৷ লেখালেখিতে তার বাবা মা সরাসরি অনুপ্রেরণা না হকেও তাদের থেকে যে জীবনদর্শন পেয়েছেন তা তাকে আরো বেশি সৃষ্টিশীল করে তুলেছে৷ তবে তিনি মনে করেন একজন সৃষ্টিশীল মানুষ কখনো পরিতৃপ্ত হতে পারে না।
সাদাত হোসাইনের জন্ম মাদারীপুরের প্রত্যন্ত এক গ্রামে। যেখানে বিদ্যুৎ ছিল না। স্কুলের পাঠ্য বইয়ের বাইরে অন্য কোনো বই পড়ার সুযোগ ও ছিল না৷ তবে তার সবসময় গল্পের প্রতি আগ্রহ ছিল। তিনি সবসময় তার দাদা দাদি অথবা নানা নানির কাছে গল্প শুনতে চাইতেন। একসময় তিনি তার বয়সী শিশুদের নিজেই গল্প শুনাতে শুরু করেন এবং আবিষ্কার করেন তিনি গল্প বানাতে পারেন। তার বাবা যে শাড়িগুলো তার মা এর জন্য আনতেন তা পত্রিকায় মুড়িয়ে দেওয়া হত । সেই পত্রিকাগুলো তিনি সংগ্রহ করতেন ও পড়তেন৷ একদিন তিনি দেখেন সাদাত হোসাইন নামের এক শিশুর লেখা সেখানে ছাপা হয়েছে৷ তিনিও খুব করে চাইতেন তার নাম ছাপার অক্ষরে দেখতে৷ এরপর তিনি কোনো গল্পের একটি অংশ পড়ে বাকিটা নিজের মত করে বানাতেন৷ এভাবেই তার গল্প লেখার যাত্রাটা শুরু হয়৷ এই ছোট ছোট ঘটনাগুলোই তাকে একজন গল্পকার বানিয়েছে বলে তিনি মনে করেন৷
সাদাত হোসাইনের মতে মানুষ হল নক্ষত্রের মত৷নক্ষত্রগুলোর দূরত্ব অসীম। কিন্তু দূর থেকে আমরা মনে করে তারা পাশাপাশি। মানুষ ঠিক তেমনি। জনসমুদ্রে থাকা মানুষ দিনশেষে নিঃসঙ্গ। বিষাদের সময় একা কান্না করে মানুষ। এই অপ্রকাশিত অনুভূতি গুলোই মানুষকে করে তোলে নক্ষত্রের মত একা। অস্পর্শ অনুভূতিগুলোই মানুষকে করে তোলে একা। সাদাত হোসাইন লেখালেখি করেন নিজের ভাবনা ও পাঠকের চাওয়া মিলিয়েই। একসময় তিনি লেখালেখি করতেন শুধু নিজের ভাবনা থেকে তবে এখন তিনি একজন পুরোদস্তুর লেখক। তাই তাকে পাঠকের চাহিদাও মাথায় রাখতে হয়৷।
লেখক সাদাত হোসাইন ডকুমেন্টারি বা সিনেমাতেও নিজের প্রতিভার সাক্ষর রেখেছেন৷ গহীনের শব্দ তার প্রথম সিনেমা। এছাড়াও কিছু ডকুমেন্টারির কাজ করেছেন। তার ইচ্ছা নিজের বিখ্যাত চরিত্র রেজা কে নিয়ে সিনেমা বানানোর। ভাল মানের বিনিয়োগ পেলে তিনি নতুন সিনেমায় কাজ করতে আগ্রহী। তার মতে বাংলাদেশের নাটক অনেক সমৃদ্ধ। তবে বাজেট কম থাকায় নির্মাতারা খুব বেশি চরিত্র নিয়ে কাজ করতে পারেন না। তবে ভাল নির্মাতারা অনেক কাজ করছেন যা সবার মন ছুয়ে যাচ্ছে। এর পাশাপাশি সাদাত হোসাইন ওয়েব ফিল্ম এও কাজ করতে চান। এ খাতে তিনি অপার সম্ভাবনা দেখেন৷ তবে চলচ্চিত্র জগৎ নিয়ে তিনি হতাশার কথা ব্যক্ত করেন।
তিনি যে কাজ করে আনন্দ পান, যে কাজগুলো অন্যের ক্ষতি ডেকে আনে না তিনি সেই কাজ গুলোই করেন। তার পছন্দের কাজ গল্প বলা তাই যে কোনো মাধ্যমে সুযোগ পেলে তিনি গল্প বলতে চান তা সে সিনেমা, নাটক, ওয়েব ফিল্ম বা উপন্যাসের মাধ্যমেই হোক। তার পছন্দের উপন্যাসগুলোর মধ্যে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় রচিত পুতুল নাচের ইতিকথা, চতুষ্কোন তার প্রিয়। এছাড়া সমরেশ মজুমদারের যুগ যুগ জিয়ো তার পছন্দের৷ তিনি শিশির মুখোপাধ্যায়ের অন্ধ ভক্ত। এছাড়াও সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, শাহেদুজ্জামান ও হুমায়ুন আহমেদ তার প্রিয় লেখক। এছাড়াও থ্রি কমরেডস তার অন্যতম প্রিয় বই। তার প্রিয় সিনেমাগুলোর মধ্যে সাইকো, ভার্টিগো, দা বাইসাইকেল থিফ, নো কান্ট্রি ফর ওল্ড ম্যান ইত্যাদি তার পছন্দের সিনেমা। এছাড়াও বাংলাদেশের মাটির ময়না, জয়যাত্রা তার পছন্দের সিনেমা। তিনি মোস্তফা সারওয়ার ফারুকির একজন বড় ভক্ত।
লিখেছেনঃ রোমান উদ্দীন