সত্যের সন্ধান তো অনেকেই করতে চায়. কিন্তু প্রকৃত সত্যান্বেষী সবাই হয়ে উঠতে পারে না। এর জন্য অনেক ত্যাগ ও সাধনার প্রয়োজন হয়। তবে যারা পারে তারাই হয় স্মরণীয় ও বরণীয়। অনেকেই এই সত্য সন্ধানকে পেশা ও নেশা উভয়ভাবেই গ্রহণ করে মানুষের মন জয় করে নিয়েছেন। আজকে এমন একজন মানুষকে উপস্থাপণ করবো যিনি এই সত্যের সন্ধানকে শুধু পেশা হিসেবে নয়, রীতিমতো নেশা হিসেবে নিয়ে আপন গতিতে এগিয়ে যাচ্ছেন। তিনি হলেন স্বনামধন্য ও জনপ্রিয় সাংবাদিক খালেদ মুহিউদ্দীন। খালেদ মুহিউদ্দীন একজন বাংলাদেশী সাংবাদিক ও লেখক যিনি বর্তমানে জার্মানভিত্তিক আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম ডয়েচে ভেলে বাংলা বিভাগের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। তিনি বাংলাদেশ সরকারি কর্ম কমিশনের বিসিএস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন এবং বিশ্ব ব্যাংকের পরামর্শক ছিলেন।
দর্শকপ্রিয় টকশো উপস্থাপক সাংবাদিক খালেদ মুহিউদ্দীন ১৯৭৪ সালের ১৬ই সেপ্টেম্বর ঢাকায় জন্মগ্রহণ করেন। তার পৈতৃক নিবাস কুমিল্লায়। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ থেকে স্নাতক সম্পন্ন করেছেন এবং যুক্তরাজ্যের ওয়েস্ট মিনিস্টার বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এম.এ ডিগ্রী লাভ করেছেন।
সাংবাদিকতা দিয়েই খালেদ মুহিউদ্দীনের পেশা জীবন শুরু হলেও তিনি বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিসে কিছুদিন দায়িত্ব পালন করেন। কিন্তু তার সাংবাদিকতার নেশা তাকে সেখানে বেশিদিন টিকতে দেয়নি। তাই লোভনীয় এই চাকরি ছেড়ে দিয়ে তিনি আবার যোগ দেন সাংবাদিকতায়। এছাড়াও তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের খন্ডকালীন শিক্ষক হিসেবে কিছুদিন শিক্ষকতা করেছেন।
জনপ্রিয় এই সাংবাদিক বিভিন্ন প্রিন্ট মিডিয়া ও ইলেক্ট্রনিক মিডিয়াতে সাংবাদিক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। তিনি দৈনিক প্রথম আলোর নগর পাতা সম্পাদক ও পত্রিকাটির সিনিয়র রিপোর্টার হিসেবে আইন, আদালত ও খনিজ সম্পদ বিষয়ে প্রতিবেদন লিখতেন। কিছুকাল তিনি অনলাইন সংবাদপত্র ও বেসরকারি সংবাদ সংস্থা বিডিনিউজ ২৪.কম এ বার্তা সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেছেন। সাপ্তাহিক কাগজ ও মিডিয়া ওয়াচের সম্পাদকের দায়িত্বও পালন করেছেন তিনি। বেশকিছু দিন তিনি ‘দৈনিক আমাদের অর্থনীতি’র সম্পাদক ও ইন্ডিপেনডেন্ট টিভিতে নির্বাহী সম্পাদকের দায়িত্বও পালন করেছেন। ইন্ডিপেন্ডেন্ট চ্যানেলের সবচেয়ে জনপ্রিয় টকশো ‘আজকের বাংলাদেশ’ এর উপস্থাপক হিসেবে তিনি জনগণের প্রশংসা কুড়িয়েছেন। দীর্ঘ ২০ বছরেরও বেশি সময় ধরে সাংবাদিকতা পেশার সাথে যুক্ত আছেন তিনি।
সাংবাদিকিতার অভিজ্ঞতা কেমন এই প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে তিনি বলেন, বাংলাদেশে সাংবাদিকতার পথ কখনোই মসৃণ নয় এবং এখানে আপনাকে অনেক উত্থান পতনের মধ্য দিয়ে যেতে হবে। তত্ত্বাবোধায়ক সরকারের আমলে একবার তিনি সাংবাদিকতা থেকেও অবসর নিয়েছিলেন। একটি বিশেষ সংবাদ মুছে ফেলার জন্য তাকে উপর মহল থেকে অনেক চাপ প্রয়োগ করা হয়েছিলো কিন্তু তিনি সেই সংবাদ রেখে দিয়েছিলেন। তার মনে হয়েছিলো সাংবাদিকতার সাথে থাকতে গেলে তাকেও ওদের সাথে তাল মিলিয়ে চলতে হবে এবং সেজন্যই তিনি স্বেচ্ছায় অবসরে গিয়েছিলেন। পরে অবশ্য ২০০৮ সালে নির্বাচন হবার পর আবার তিনি সাংবাদিকতা পেশায় ফিরে আসেন।
মুহিউদ্দীনকে প্রশ্ন করেছিলাম, দেশ ছেড়ে থাকতে খারাপ লাগা কাজ করে কি না? জবাবে তিনি বলেছেন, যতই দেশের বাইরে থাকুক না কেন, দেশ দেশই। দেশের জন্য অবশ্যই খারাপ লাগা কাজ করে। তবে তিনি এটিও জানান যে দেশে থেকে থেকে তিনি ক্লান্ত হয়ে যাচ্ছিলেন। এই ক্লান্তি যাতে আর না বাড়ে সেইজন্যই তাঁর দেশ ছেড়ে চলে আসা। তবে তিনি এটাও বলেছিলেন, বাক স্বাধীনতার ক্ষেত্রে তার উপর কখনও কেউ হস্তক্ষেপ করতে পারেনি বা করেনি। যেকোনও টকশোতে তিনি নিজের মতো করে প্রশ্ন করেছেন।
গণতান্ত্রিক দেশ হিসেবে বাংলাদেশকে মূল্যায়ন করতে বলা হলে তিনি বলেন, “গনতন্ত্রের উপযুক্ত সংজ্ঞায়ন করার উপায় হলো সেই দেশের নির্বাচন। নির্বাচনের হিসেব ধরলে বাংলাদেশ গণতন্ত্রের পরীক্ষায় পাশ করে না”। এইযে আমরা এতো উন্নয়নের কথা শুনি, দেশে আসলেই উন্নয়ন হচ্ছে কি না এই বিষয়ে তিনি বলেন, বাংলাদেশের উন্নয়ন হয়েছে এতে কোন সন্দেহ নেই। বিগত বছরগুলোর সাথে তুলনা করলেই বুঝা যায় বাংলাদেশ বর্তমানে কতোটা এগিয়ে আছে। দেশের পোষাক শিল্প, টেলিফোন, বাজার ব্যাবস্থা সবকিছুর দিকে দৃষ্টিপাত করলে দেখা যায় বাংলাদেশের আসলেই অনেক উন্নতি হয়েছে। তবে এই কৃতিত্ব কার এই বিষয়ে তিনি কোন মন্তব্য করেননি। তবে তাঁর আক্ষেপের জায়গাও আছে বলে জানান তিনি। তাঁর আক্ষেপের জায়গাগুলো হলো, অর্থ লোভীদের অর্থ পাচার করা। দেশের টাকা চুরি করে নিজেদের স্বার্থ উদ্ধার করাটা অনেক বড় অন্যায়ের জায়গা বলে মনে করেন তিনি। তাছাড়া শ্রম শোষণ সমাজে অনেক বৈষম্য সৃষ্টি করছে বলে জানান তিনি এবং লুটপাটের জন্য তাদের বিচার হওয়া উচিত বলে মনে করেন তিনি। তবে তিনি এটিও মনে করেন, যেহেতু আমাদের দেশের সবচেয়ে বড় আয়ের উৎস হলো রেমিট্যান্স আর বাইরের দেশেও শ্রমিকের অনেক চাহিদা, সেক্ষেত্রে আমাদের সরকারের উচিত উপযুক্ত প্রশিক্ষণের মাধ্যমে বাংলাদেশের নাগরিকদের বিদেশের শ্রমবাজারে প্রবেশ করানো।
খালেদ মুহিউদ্দীন পেশায় কেবল সাংবাদিক নন তিনি একজন লেখকও বটে। এ পর্যন্ত তাঁর ৯ টি লেখা প্রকাশিত হয়েছে। তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো, কন্ট্রোল সি কন্ট্রোল ভি, এক মিলেনিয়াম আগের গল্প, কয়েকজন আমি, আমিনুল্লাহর একদিন। তাছাড়া অধ্যাপক আসাদুজ্জামানের সাথে যৌথভাবে ‘যোগাযোগের ধারণা’ ও ‘যোগাযোগের তত্ত্ব’ শিরোনামে দুটি বই রয়েছে তার, যা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠ্য বই হিসেবে পড়ানো হয়।
তার চোখে বর্তমানে সেরা সাংবাদিক কে এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি জানান “তথ্য প্রযুক্তির ফলে সাংবাদিকতার গুণগত, মাণগত ও অবস্থানগত পরিবর্তন হয়েছে। তবে নিজের দেশে ওইরকম ভালোলাগার মতো কাউকে এখনো পর্যন্ত চোখে পড়েনি তার। তবে তিনি ইংরেজি পত্রিকার কয়েকজন সাংবাদিকের নাম বলেন। বিশেষ করে স্টিভ সেভার্ড, জেরেমি প্যাক্সম্যান, এন্ডারসন কুপার, স্টিভেন কলভিয়ার এবং টিভি হোস্ট এলেন ডিজেনারাসের নাম বলেন।
দেশের গন্ডি পেরিয়ে বিদেশের মাটিতে প্রশংসা কুড়ানো এই সাংবাদিক মন খারাপের সময় বহুমূখী কাজ করতে ভালোবাসেন। একইসাথে একাধিক কাজে তার মন ভালো হয় বলে জানিয়েছেন তিনি। তবে তিনি স্বপ্ন নিয়ে কখনও খুব বেশি ভাবেননি বরং নিজেকে স্রোতে ভাসিয়ে দিয়েছেন। গতানুগতিক জীবনযাপনেই অভ্যস্ত তিনি। মৃত্যুর পরেও তিনি বিশেষ কিছু চান না বলে জানিয়েছেন এবং তিনি মনে করেন মানুষ তাঁর কথা মনে রাখার মত তেমন কিছুই তিনি করেন নি। তিনি মনে করেন মৃত্যুর পর স্মরণীয় হবার কোন সুযোগই তাঁর নেই। বিনয়ী ও চমৎকার উপস্থাপনার এ মানুষটি মৃত্যুর পর কী হবে তা নিয়ে না ভেবে বরং বর্তমানেই সজহভাবেই বেঁচে থাকতে চান বলে জানিয়েছেন।