আজকে এমন একজন মানুষের সম্পর্কে জানাবো যিনি দীর্ঘদিন বিদেশে অবস্থান করেও মন থেকে প্রবাসী হতে পারেননি। তিনি এমন একজন মানুষ যাকে দেখলে এবং কাছে থেকে জানলে মনে হবে ঠিক যেনো দশভূজা। নিজের সংসার ও ক্যারিয়ার সবকিছু আগলে রেখে দেশ ও দশের জন্য যিনি নিবেদিত প্রাণ। তিনি একাধারে কবি, দ্বিভাষিক, লেখক, সংগঠক, গল্পকথক ও যুক্তরাজ্যের অন্যতম […]

কবি ও কবিতারা: শামীম আজাদ

আজকে এমন একজন মানুষের সম্পর্কে জানাবো যিনি দীর্ঘদিন বিদেশে অবস্থান করেও মন থেকে প্রবাসী হতে পারেননি। তিনি এমন একজন মানুষ যাকে দেখলে এবং কাছে থেকে জানলে মনে হবে ঠিক যেনো দশভূজা। নিজের সংসার ও ক্যারিয়ার সবকিছু আগলে রেখে দেশ ও দশের জন্য যিনি নিবেদিত প্রাণ। তিনি একাধারে কবি, দ্বিভাষিক, লেখক, সংগঠক, গল্পকথক ও যুক্তরাজ্যের অন্যতম বিখ্যাত বাঙ্গালি কবি। তিনি আর কেউ নন, আমাদের সবার প্রিয় শামীম আজাদ।
ব্রিটিশ বাংলাদেশী এই সাহিত্যিক ১৯৫২ সালে ১১ নভেম্বর তাঁর বাবার কর্মস্থল ময়মনসিংহে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পৈত্রিক নিবাস সিলেটে। তিনি জামালপুর স্কুল থেকে মাধ্যমিক শেষ করেন। ১৯৭৯ সালে কুমুদিনি সরকারি কলেজ থেকে উচ্চমাধ্যমিক পাশ করেন এবং ১৯৭২ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক ও ১৯৭৩ সালে স্নাতকোত্তর শেষ করেন। শিক্ষাজীবন থেকেই তিনি কবিতা ও শিল্প-সাহিত্যের নানা অঙ্গনে কাজ করেছেন।

শামীম আজাদের সান্নিধ্যে গেলে বুঝা যায় তিনি কতটা অমায়িক একজন মানুষ। বিচিত্রায় কাজ করার সুবাধে শামীম আপার কাছাকাছি যাওয়ার সুযোগ হয়েছিলো আমার। শামীম আপা এমন একজন মানুষ যিনি নিজের ভেতরের নারী সত্তাকে খুব স্পষ্টভাবে প্রকাশ করেন। একজন নারী হিসেবে অনেকেই নিজের কথা, নিজের অনুভূতির কথা বর্ণনা করতে সংকোচ বোধ করেন; কিন্তু এক্ষেত্রে শামীম আজাদের বর্ণনা খুবই সহজাত এবং সাবলীল।

শামীম আজাদ ঢাকা কলেজের শিক্ষক হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেছিলেন। তারপর জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন সাংবাদিক ও উপস্থাপক হিসেবে। উপস্থাপনার গুণটি তিনি তাঁর বাবার কাছ থেকে লাভ করেছেন। সর্বোপরি, বাংলাদেশের সংস্কৃতি ও ফ্যাশন শিল্পে তাঁর অনন্য অবদান রয়েছে। প্রিন্ট মিডিয়া ছাড়াও রেডিও ও টেলিভিশনেও কাজ করেছেন। তিনি একজন সমাজসেবী ও আমাদের নারী সমাজের জন্য এক বলিষ্ঠ কন্ঠস্বর। আমাদের মুক্তিযুদ্ধেও তাঁর গুরুত্বপূর্ণ অবদান আছে। লেখালেখি ছাড়াও নানা তৎপরতার মাধ্যমে সবার মাঝে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও ইতিহাস তুলে ধরেছেন তিনি। বাংলাদেশের স্বাধীনতার স্মারক বিজয়ফুল কর্মসূচির প্রতিষ্ঠাতা তিনি; যা পুরো বিশ্বে ডিসেম্বরে পালিত হয়। তিনি তার লেখনীতে চিরায়ত বাংলার শ্বাশ্বত রুপ আধুনিক প্রেক্ষাপটে তুলে ধরেন। বাংলাদেশের মতো তিনি তাঁর বহুমূখী কাজের ধারা প্রবাস জীবনেও অব্যাহত রেখেছেন।

প্রবাসে গিয়ে কিভাবে এতোটা সহজে মিশে গিয়েছেন তিনি এমন প্রশ্নের জবাবে বলেন, আমরা এমন এক দেশের মানুষ আমাদের বেশি কিছু নেই, খুব কম নিয়ে আমরা বিদেশে যাই। কিন্তু যতটুকু নিয়ে যাই তা খুব শক্তভাবে হাতের মুঠে আগলে ধরে রাখি। এই করতে করতে সময় চলে যায়। তারপর মুঠো খুলে দেখি যা ছিলো তা অচল হয়ে যায়, তা আর কাউকে দিতে পারিনা। তবে দরিদ্র মানুষের আরও বেশি করে দেওয়ার ক্ষমতা রাখা উচিত তাহলেই সে সবকিছু পাবে। কারন তার এমনিতেও বিশেষ কিছু নেই তাই ব্যবহার দিয়ে, নিষ্ঠা দিয়ে, শ্রম দিয়ে, অধ্যাবসায় দিয়ে সবার সাথে মিশে যেতে হবে। তিনি আরও বলেন, তিনি ইংরেজদের মতো না। আমাদের দেশের কোন কিছুই ইংরেজি ভাষায় নেই। তবে নিজেকে তুলে ধরতে, প্রতিযোগিতামূলক জায়গায় টিকে থাকতে তাঁর গল্পগুলোকে, ৭১ এর গল্পগুলোকে, গৌরবকে ভাষার মাধ্যমে প্রকাশ করতে হবে। তিনি মনে করে বাংলাদেশের প্রচুর বিষয়বস্তু ও কাঁচামালের খনি আছে যা অব্যবহৃত হয়ে আছে; উনি সেগুলোরই সঠিক ব্যাবহার করতে চাচ্ছেন। তিনি নিজেকে খুবই নগণ্য একজন মানুষ হিসেবে ভাবেন। তাঁর জায়গায় সেলিনা হোসেন বা রুবি হলে আরও ওপরে উঠে যেতে পারতো বলে মনে করেন তিনি। তিনি কেবল নিজের প্লেটটা সাজিয়ে মানুষের সামনে তুলে ধরার চেষ্টা করছেন।

স্টোরিটেলিং এর ধারণা কিভাবে মাথায় আসলো তার বর্ণনা দিতে গিয়ে তিনি বলেন, তিনি ইংরেজি, বাংলা, বিজ্ঞান সব পড়ান। তবে তিনি যখন বাংলা গল্প বলতেন তখন বাচ্চাদের মুখভঙ্গি বদলে যেতো। তখন থেকে তিনি অনুভব করলেন তিনি ভালো গল্প বলেন।

কাজের অভিজ্ঞতার কথা বলতে গিয়ে বলেন, বিশ্বজুড়ে মেয়েরা অধিক প্রতিযোগিতা করে। বাইরের দেশের মেয়েরা নিজেদের একটু স্বাধীন মনে করে তাই নিজেদের মতো কাজ করতে পারে। ছেলেরা না বদলালে মেয়েরা কিভাবে পারবে? প্রতিরোধের মুখে নানাভাবে রপ্ত করতে করতে মেয়েরা প্রতিষ্ঠিত হয়। দেখা যায় পুরুষদের মৃত্যুর হার বেশি, বেশি রোগে আক্রান্ত থাকে, প্রেশার, স্ট্রোক এসব ছেলেদের বেশি হয় কারন তারা প্রকাশ করতে পারে না।তা রা একাকী বাঁচতে পারে না কিন্তু নারীরা একাকী বেঁচে থাকতে পারে, সে সংসারে মৃত্যু অবধি একটা ভূমিকা রেখে যায়। এটাকে তিনি বলেন প্রকৃতির শোধ। এতো কষ্ট সহ্য করার পর নারীদের এটা ভ্যাকসিনের মতো কাজ করে। কান্না করে মেয়েরা হালকা হয়ে আবার কাজে নেমে পড়ে। কিন্তু পুরুষরা প্রকাশ করে না, ফলে এগুলো তাদের অসুখ হয়ে যায়, বুকের মাঝে চাপা পড়ে থাকে। মেয়েরা টিকে থাকে বেশি, আনন্দ ভাগ করে বেশি, দুঃখ ভাগ করে বেশি; মেয়েরা জীবনকে উপভোগ করতে পারে বেশি। জীবনের বর্নাঢ্য জিনিসগুলো মেয়েরাই উপভোগ করতে পারে।

সাংস্কৃতিক পরিবর্তনকে তিনি একটু অন্যভাবে দেখেন। তিনি বলেন, শুধু স্থানীয় নয়, পুরো দেশময়, বিশ্বময় রাজনীতির অংশ আমরা। এতগুলো মুসলিম দেশ, অমুসলিম দেশ সবাই নিজের নিয়মে চলে। আমরা শুধুমাত্র অন্য দেশের মতো হতে চাই, অন্যকে অনুকরণ করতে চাই, অন্যদের মতো হতে চাই। এভাবে নিজের নিজস্বতা হারিয়ে ফেলি আমরা। আর এই বিষয়টি স্থানিক নয় বিষয়টি পুরোপুরি কালিক। কালের কারনে আমরা এই জায়গায় এসে পৌঁছেছি বলে মনে করেন তিনি। তিনি মনে করেন পুরোপুরি বৈশ্বিক রাজনীতির কারনে আমাদের দেশের মূল যে জায়গা ছিলো সেখান থেকে আমরা আজ বিচ্যুত হয়ে গিয়েছি। এর কারণ হিসেবে এককভাবে কাউকে দোষারোপ করা যায় না বলে জানান তিনি। এজন্য প্রথমত তিনি নিজের প্রজন্মকে দায়ী করেন। মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবোধ, মূল্যবোধ এগুলো কখনো কথা বা বক্তৃতার মাধ্যমে শেখানো যায় না বলে বিশ্বাস করেন তিনি। তাঁর মতে কালের বিবর্তনে ১৯৭৫ সালের পর হাওয়া উল্টোদিকে বইছে। তাই বর্তমানে একটা আহাজারি দেখতে পাওয়া যায় বাংলাদেশে। পত্রিকা থেকে শুরু করে সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম সব জায়গায় আমরা আমাদের ঐতিহ্যকে হারিয়ে ফেলেছি। তিনি আফসুস করে বলেন, বর্তমানে আমরা এমন একটি সংস্কৃতি ও সভ্যতাকে ধারণ করছি যা আমাদের বাঙ্গালি সংস্কৃতি ও ধর্মকে একটা বিরোধের জায়গায় এনে দাঁড় করিয়েছে, কিন্তু দুটোর মধ্যে তো প্রকৃতপক্ষে কোন ধরণের বিরোধ নেই। এর কারণ হিসেবে তিনি নিজের অভিজ্ঞতা থেকে বলেন, একটা পরিবারে যখন ভাষা শিক্ষা দেওয়া হয় তখন দুটো ভাষাকে খুব গুরুত্ব দেওয়া হয়। একটা ইংরেজি যার মাধ্যমে উপার্জন করতে পারবে আর একটা আরবি যার মাধ্যমে পরকালের জান্নাত পাবার লোভ রয়েছে। কিন্তু যে ভাষা জন্মের পর অনায়াসেই বলতে পারা যায় সে ভাষার মর্যাদা আমরা দেই না। অথচ সেই ভাষার মাধ্যমেই বিশ্বের নানান বিষয় বোঝার ব্যবস্থা ছিলো। এই ভাষার সাথেই রয়েছে আমাদের সংস্কৃতি। আমরা আমাদের নিজের ভাষাকে রেখে অন্য ভাষার প্রতি যেই প্রীতি প্রকাশ করছি তার ফলে তো আমাদের স্বকীয়তা হারাবেই। অন্য ভাষাকে কেন্দ্র করে আমাদের যেই লোভ সেই লোভ তো নিজের ভাষাকে কেন্দ্র করে দেখানো হচ্ছে না। আমরা নিজেদের অবহেলা করে বড় হতে শিখছি এবং সেজন্যই আজকের এই অবস্থা।

ধর্মের মতো করে আমাদের দেশপ্রেমের শিক্ষাও দেওয়া উচিত বলে মনে করেন তিনি এবং এর জন্য আমাদের ঘর ও বিদ্যালয়কে সবচেয়ে উপযুক্ত জায়গা হিসেবে বিবেচনা করেন তিনি। তাঁর মতে এই দুটি জায়গা আমাদের সামাজিকীকরণের সূত্রপাত। খাবার টেবিলে পিতামাতা যদি কেবল দেশ নিয়ে হতাশার গল্প না করে দেশের ভালোভাবে তুলে ধরতে পারেন, দেশ প্রেমের গল্প করেন, তাহলে এমন অসুস্থ সংস্কৃতি থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব। তিনি বাংলা ভাষার বিশেষজ্ঞ হিসেবে নানা জায়গায় কাজ করেছেন। এক্ষেত্রে তিনি নিজ অঞ্চল সিলেটের উদাহরণ দেন। তিনি বলেন ভাষার ক্ষেত্রে সিলেটের মানুষ অনেক সংঘবদ্ধ। তারা নিজের ভাষাকে খুব সুন্দরভাবে উপস্থাপন করেন একে অপরের সাথে। আমরা যা করি তাই আমাদের কর্মফল। আমরা তেমনই পাবো ঠিক যেমনটা করবো। তাই সংস্কৃতির এমন পরিবর্তন না চাইলে নিজের দেশকে, দেশের ভাষাকে, নিজের সংস্কৃতিকে ভালোবাসতে জানতে হবে এবং উপলব্ধি করতে হবে হবে অভিমত প্রকাশ করেছেন তিনি।

শামীম আজাদের পরবর্তী পরিকল্পনা কী এমন প্রশ্ন করলে তিনি বলেন, আপাতত তিনি নিজের আত্মকেন্দ্রিক উপন্যাস শেষ করবেন। ‘আমার কৃষক ও বিশ্ববিদ্যালয়ের স্মৃতি’ নামক দুটি লেখা তিনি প্রথমে শেষ করতে চান। এছাড়াও তাঁর ৬ টি অপ্রকাশিত পান্ডুলিপি রয়েছে সেগুলো তিনি শেষ করতে চান। এর পাশাপাশি তিনি দুঃখ প্রকাশ করে জানান, বর্তমান সময়ে প্রকাশকরা খুবই মানহীন বই প্রকাশ করছেন যা তাঁকে ব্যাথিত করে। তিনি কেবল দেশেই নন দেশের গন্ডি পেরিয়ে বিদেশের মাটিতেও সমাদৃত হয়েছেন। অ্যাথেন্সের এগোরা পারটিক রেসিডেন্সি হিসেবে তিনি নিয়োগ লাভ করেন। বিশ্ব সাহিত্য কেন্দ্র লন্ডন ও ব্রিটিশ বাংলাদেশি পয়েট্রি কালেকটিভের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ার তিনি। এছাড়াও, পূর্ব লন্ডনের শিল্পি সংস্কৃতি চর্চার বৃহৎ প্রতিষ্ঠান রিচমিক্সের ট্রাস্ট এবং লন্ডনের এক্সাইল রাইটার্স এর নির্বাহী কমিটির সদস্য তিনি। ২০ শতাব্দীর ব্রিটিশ এশীয় এই লেখক ২০২০ সালে আর্ট ইন দ্যা কমিউনিটি পুরষ্কারে ভুষিত হন।

মৃত্যু পরবর্তী জীবনে কিভাবে স্মরণীয় হতে চান এই প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, কিচ্ছু চাওয়ার নেই। মৃত্যুর পর তিনি থাকবেন না, কি হচ্ছে দেখবেন না। তাই তার এসব নিয়ে কোন ভাবনা নেই। তবে তার জীবদ্দশায় মানুষ তাকে প্রয়োজনীয় ভাবুক এটাই তিনি চান। তিনি বলেন, আমি যতদূরে যাই বাংলাদেশ ততদূরে যায় অর্থাৎ তাঁর যত অর্জন সব বাংলাদেশ নির্ভর। তার সকল কবিতা বাংলাদেশের।