১৯৯৮ সালে ‘বোধ’ নাটক দিয়ে স্ক্রিপ্ট রাইটার হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন চয়নিকা চৌধুরী। এরপর ২০০১ সালে ‘শেষ বেলায়’ নাটকের মধ্য দিয়ে নির্মাতার খাতায় নাম লেখান। গেল বছরের ১৭ সেপ্টেম্বর তিনি তার ক্যারিয়ারের ২০ বছর পার করেন। এই ২০ বছরের ক্যারিয়ারে চয়নিকার নির্মিত এখন পর্যন্ত প্রায় ৪০০টির মতো নাটক বিভিন্ন টেলিভিশনে প্রচারিত হয়েছে। বাংলাদেশের প্রথম নারী হিসেবে তিনিই সবথেকে বেশি নাটক ও ধারাবাহিক নির্মাণ করেছেন, যা এখন পর্যন্ত তার দখলে। নির্মাতা কাজের স্বীকৃতি হিসেবে চয়নিকা চৌধুরী বেশ কিছু পুরস্কারও পেয়েছেন। এর মধ্যে রয়েছে- ২০০৩ সালে কালচারাল রিপোর্টার্স অ্যাওয়ার্ড এবং ২০০৪ সালে কালচারাল জার্নালিস্ট ফোরাম অব বাংলাদেশের সেরা সমালোচক পুরস্কার। এ ছাড়া ২০১০ সালে চাড়ুনীড়ম ইনস্টিটিউট অব অ্যাক্টিং অ্যান্ড রিসার্চ থেকে বিশেষ পুরস্কার পান তিনি।
আড্ডার শুরুতেই চয়নিকা চৌধুরী তার নিজের করোনা অভিজ্ঞতা নিয়ে বলেন। তিনি করোনা মহামারীকে অদৃশ্য শত্রুর সাথে তুলনা করেন যার সাথে বুদ্ধি এবং সচেতনতা দিয়ে লড়াই করতে হয় । এর সাথে নিজের করোনা আক্রান্ত হওয়ার সময়গুলোতে তার সন্তানদের ভালবাসা নিয়েও বলেন।
চয়নিকা চৌধুরী তার নাট্য ও চলচ্চিত্র নির্মাণ নিয়ে গল্পের শুরুতে বলেন ,তার স্বপ্ন ছিল একজন রবীন্দ্র সংগীত শিল্পী হওয়ার। সংগীত বা গানের পরিবেশেই তার বেড়ে ওঠা। রবীন্দ্র সংগীতে তার আদর্শ হিসেবে মিতা হক,রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যা,সঞ্জিতা খাতুনদের কথা বিশেষভাবে উল্লেখ করেন।পাশাপাশি তার মা এর অনুপ্রেরণার কথাও বিশেষভাবে স্মরণ করেন। শান্তি নিকেতন থেকে ফেরার পর মাত্র ১৯ বছর ২ দিন বয়সে তার বিয়ে হয়। এরপর পরিবারকে সময় দিতে গিয়ে আর শান্তি নিকেতনে ফেরা হয়নি তার।
একটি দীর্ঘ বিরতির পর লেখালেখি শুরু করেন চয়নিকা চৌধুরী। তার পরিচালনায় আসা লাইট এন্ড শটের মুজিবুর রহমানের হাত ধরে। তবে সে নাটকটি আর প্রচারিত হয় নি। তার প্রথম প্রচারিত নাটক এক জীবনে,যা বিটিভিতে প্রচারিত হয় ২০০১ এ৷ সেই থেকেই পরিচালক হিসেবে তার পথচলা শুরু। এই নাটকের জন্য তিনি তার বোন তমালিকার কাছে বিশেষভাবে কৃতজ্ঞ।
চয়নিকা চৌধুরী এখনো বিভিন্নভাবে তার পেশাগত জীবনে চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হচ্ছেন বলেও জানান। নাটক প্রচারের নিশ্চয়তাকেই বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখেন তিনি । এ পর্যায়ে এসেও তার নাটকগুলো প্রচারিত হওয়ার জন্য প্রিভিউ কমিটিতে জমা দিতে হয় বলেও জানান। তবে এই চ্যালেঞ্জগুলোই তাকে অনেক কিছু শিখিয়েছে, তিনি অনেক বেশি আত্মবিশ্বাসী হয়েছেন বলেই তার বিশ্বাস।
চয়নিকা চৌধুরী কাজের ক্ষেত্রে সফল এবং সম্ভাবনাময় সকলকে নিয়েই কাজ করেন। নাট্য বা চলচ্চিত্র শিল্পের স্বার্থে তার নিজের দায়বদ্ধতার জায়গা থেকেই নতুনদের সুযোগ দেন তিনি। সুযোগ কাজে নতুন শিল্পীরাই তাদের দক্ষতা, মেধা এবং পরিশ্রম দিয়েই সবার মনে জায়গা করে নেন বলে মনে করেন তিনি।
চয়নিকা চৌধুরীর মা তাকে অনেক সিনেমা দেখিয়েছেন সেই ছোটবেলা থেকেই।অনেক ভাল সিনেমার সাথে তার পরিচয় হয় মা এর হাত ধরেই৷তিঞ্জ অপর্ণা সেন, ঋতুপর্ণ ঘোষ, মোস্তফা কামাল সৈয়দ ,হুমায়ুন আহমেদ, নওয়াজেশ আলী খান, বরকতউল্লাহ, জিয়া আনসারী , আখতার ফেরদৌস রানা, মোহন খানদের কাজ থেকে অনেক কিছু শিখেছেন বা শেখার চেষ্টা করেছেন৷ এসব গুনী পরিচালকদের পাশাপাশি সুবর্ণা মুস্তাফা ,ফেরদৌসী মজুমদার , শর্মিলী আহমেদ, ডলি জহুর, আবুল হায়াত, আব্দুল্লাহ আল মামুন এর মত গুণী অভিনেতাদের কাছে থেকেও তিনি শিখেছেন।
মাহফুজ আহমেদ, অপি করিম, তারিন, অপূর্ব, নুসরাত ইমরোজ তিশা, রিচি সোলায়মান, জাকিয়া বারী মম, আনিসুর রহমান মিলন, আফরান নিশো, মেহজাবিন চৌধুরী, তানজিন তিশা বা মনোজ কুমার – এদের সবার অভিনয় দক্ষতাই চয়নিকা চৌধুরীকে মুগ্ধ করে৷ তার বোঝাপড়া সবথেকে বেশি মাহফুজ আহমেদ আর হালের আপূর্বর সাথে। চলচ্চিত্র অভিনয় শিল্পীদের মধ্যে সিয়াম, পরীমনি আর শাকিব খানের অভিনয়ের প্রশংসা করেন তিনি।
সিনেমাতে কাজ শুরু করলেও নাটক তৈরি কখনো ছাড়তে চান না চয়নিকা। পাশাপাশি ওটিটি প্ল্যাটফর্মেও নিজেকে মেলে ধরতে চান তিনি। চলচ্চিত্রের সুদিন ফিরিয়ে আনতে ভাল নির্মাণ , অসাধারণ গল্প, দক্ষ অভিনয়শিল্পীর পাশাপাশি সিনেমা হল নির্মাণ এবং এই হলগুলোর পরিবেশের গুরুত্ব অপরিসীম বলে মনে করেন তিনি। চলচ্চিত্রের প্রাণ ফিরিয়ে আনতে নতুন সিনেমা হল নির্মাণে প্রধানন্ত্রীর উদ্যোগেকে ইতিবাচক হিসেবেই দেখছেন তিনি।
চয়নিকা চৌধুরী গুণী অভিনেত্রী সুবর্ণা মুস্তাফার কাজের ভক্ত। তার মতে সুবর্ণা মুস্তাফার কোনো বিকল্প নেই। তিনি তার ভুবনে অদ্বিতীয়। তবে হুমায়ুন ফরিদী এবং এস এম মোহসীন এর সাথে কাজ করতে না পারার আক্ষেপ সবসময় থেকে যাবে তার।
নিজের মূল্যায়নে চয়নিকা চৌধুরী নিজেকে সর্বোচ্চ নম্বরই দেন। এর কারণ হিসেবে তার কাজের প্রতি আত্মনিবেদন, ভালো কাজ করার ইচ্ছা, পরিশ্রম এবং নির্মাণ সংশ্লিষ্ট সকলের প্রতি তার ভালবাসাকে উল্লেখ করেন। তার নিজের করা কাজ গুলোর মধ্যে মায়া, বিকেলের আলো, তালপাতার পাখা, আবেগ, এসো হাত ধর, শেষ প্রাণে, দুই বোন, শেষের পরে, সোনার কাঠি রূপার কাঠি, সবুজ রুমাল, ইতি তোমার মা, নীল ফুল, আলো ছায়া বা ওপারে একা ইত্যাদি তার পছন্দের।
চয়নিকা চৌধুরী সবসময় ভালো নির্মানের চেষ্টা করেন অথবা বিপদে সবার পাশে দাঁড়ান – এই গুণ গুলোর কারণে বিচক্ষণতা সম্পন্ন মানুষ তাকে সবসময় মনে রাখবে বলেই তার বিশ্বাস। মানুষের প্রাণ থাকতে মানুষ প্রাপ্য প্রশংসা বা সম্মান পায় না এ নিয়েও আক্ষেপ ঝরে চয়নিকার কণ্ঠে।