সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান একজন বাংলাদেশি আইনজীবী ও পরিবেশকর্মী। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের বন ও পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের “পরিবেশ পুরস্কার” এবং প্রথম বাংলাদেশী হিসেবে “গোল্ডম্যান এনভায়রনমেন্টাল প্রাইজ” অর্জন করেন। ২০০৯ সালে তিনি টাইমস সাময়িকীর “হিরোজ অফ এনভায়রনমেন্ট” খেতাব লাভ করেন। এছাড়া তিনি ২০১২ সালে রামোন ম্যাগসেসে পুরস্কার পান। তিনি শিক্ষাজীবন শেষে ১৯৯৩ খ্রিষ্টাব্দের জুলাই মাসে যোগ দেন বাংলাদেশ পরিবেশ আইনজীবী সমিতি (বেলা)-তে। বেলা-ও তখন মাত্র যাত্রা শুরু করেছে। এরপর ১৯৯৭ খ্রিষ্টাব্দে বেলা’র সংগঠক ও প্রধান জনাব মহিউদ্দিন ফারুক মৃত্যুবরণ করলে রিজওয়ানা ‘কমনওয়েলথ বৃত্তি’র সুযোগ হাতছাড়া করে বেলা’র প্রধান নির্বাহীর দায়িত্ব নেন। বেলা’র হাত ধরেই লড়ে চলেন পরিবেশের ক্ষতিসাধনকারী নানা চক্র আর ব্যবসায়ীর বিরুদ্ধে। তার এ লড়াই এখনো চলমান।
বৈশ্বিক উষ্ণায়ন এবং জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে এক প্রশ্নের প্রেক্ষিতে রিজওয়ানা হাসান বলেন, বৈশ্বিক উষ্ণতার দিকে তাকালে দেখা যাবে ২৫ বছর আগে রাষ্ট্রগুলো তাপমাত্রা বৃদ্ধিকে একটি নির্ধারিত মাত্রায় আটকাতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হয়েছিল। ২০১৫ সালেও প্যারিস চুক্তিতে রাষ্ট্রগুলো বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধি ২ ডিগ্রি সেলসিয়াসের ভেতরে রাখতে অঙ্গীকারবদ্ধ হয় এবং তাপমাত্রা বৃদ্ধির এ হার ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসে রাখার জন্য তারা সর্বাত্মক চেষ্টা করবে বলে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হয়। এ উদ্দেশ্যে রাষ্ট্রগুলো কী পরিমাণ গ্রীন হাউস গ্যাস নিঃসরণ করবে তার একটি রূপরেখা প্রণয়ন করে। তবে প্যারিস চুক্তির মাধ্যমে রাষ্ট্রগুলো আইনগত বাধ্যানুগতা থেকে বেরিয়ে আসে এবং গ্রীন হাউস নিঃসরণ মাত্রা ঐচ্ছিকভাবে নির্ধারণের সুযোগ পায়। তবে বর্তমানে তাপমাত্রা বৃদ্ধির হার ১.৫ ডিগ্রিতে আটকে রাখার লক্ষ্যমাত্রার ধারে কাছে নেই রাষ্ট্রগুলো। যদি সকল রাষ্ট্র তাদের প্রতিশ্রুতি শতভাগ পালন করে তবুও এই তাপমাত্রা বৃদ্ধি ৩.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসে গিয়ে ঠেকবে। জাতিসংঘের বিশেষায়িত সংস্থাগুলোর ধারণা তাপমাত্রা বৃদ্ধির এ হাত এই শতাব্দীর শেষে ৭-১২ ডিগ্রি সেলসিয়াস হবে। যদি তাপমাত্রা ২ ডিগ্রি সেলসিয়াসের উপরে যায় তাহলে ৫২ টি দ্বীপরাষ্ট্র মানচিত্র থেকে চিরতরে হারিয়ে যাবে এবং বাংলাদেশের তিন ভাগের একভাগ ভূমি সাগরে তলিয়ে যাবে। তবে এত বড় ঝুঁকির ব্যাপারে বিশ্ব নেতাদের কোনো গঠনমূলক ভূমিকা পরিলক্ষিত হচ্ছে না।
বাংলাদেশের মত দেশগুলো সবথেকে বেশি ক্ষতির সম্মুখীন হলেও বৈশ্বিক তাপমাত্রা হ্রাস বা গ্রীন হাউস গ্যাসের নিঃসরণ কমানো নির্ভর করে উন্নত দেশগুলোর উপর। তবে বাংলাদেশের জন্য শিক্ষণীয় বিষয়গুলো হল, আমাদের কাছে এখন পোক্ত বৈজ্ঞানিক ধারণা এবং বিকল্প উন্নয়ন মডেল আছে। আমরা জানি উন্নত বিশ্বের উন্নয়ন মডেল প্রকৃতির জন্য ভাল না। আমরা যদি এই চিরাচরিত উন্নয়ন মডেল অনুসরণ করি তাহলে আভ্যন্তরীণ পরিবেশ বিপর্যয়ের সম্মুখীন হওয়াত সমূহ সম্ভাবনা থাকে। কিন্তু দুঃখের বিষয় হল আমরাও সেই পুরোনো প্রকৃতিকে শোষণ করার যে উন্নয়ন মডেল তাই অনুসরণ করছি।
উন্নত দেশগুলোর প্রতিশ্রুতি নিয়ে তিনি আরো বলেন, বাংলাদেশের মত ক্ষতিগ্রস্থ দেশগুলোকে অভিযোজনের জন্য টাকা দেওয়ার কথা থাকলেও তা এখনো দেওয়া হয়নি। এরসাথে উন্নত দেশগুলো তাদের কার্বন নির্গমন হার কমাতে এখনো আগ্রহী না৷ এক্ষেত্রে বাংলাদেশের করনীয় সম্পর্কে রিজওয়ানা হাসান বলেন, বাংলাদেশের উচিত দেশিয় এবং আঞ্চলিক পর্যায়ে প্রস্তুতি রাখা। এছাড়াও ভারত ও চীনের সাথে থাকা যৌথ নদীগুলোর পানি বন্টন নিয়ে একটি সিদ্ধান্তে আসা। কারণ ভবিষ্যতে আমাদের দক্ষিণ এশিয়া সুপেয় পানির সংকটে পরবে। এ সমস্যা সমাধান হতে পারে একমাত্র ‘প্রকৃতির প্রতি দরদী’ উদ্যোগ গ্রহণ করলে। বাংলাদেশের জন্য আশংকার বিষয় হল আমরা অভিযোজনে এখনো অনেক পিছিয়ে আছি। বায়ু দূষণে আমরা এখন দিল্লীকেও ছাড়িয়ে যাই, নদী দূষণে আমাদের অবস্থান ৫ম, জলাশয় হারানোর দিক থেকে আমরা বিশ্বে প্রথম, আইনের শাসনে ১২৫ টি দেশের মধ্যে ১১৭ তম। ২০১৮ সালে এনভায়রনমেন্টাল পারফরমেন্স এ আমাদের অবস্থান ছিল ১৮০ টি দেশের মধ্যে ১৭৯ তম। এ বছর আমাদের অবস্থান ১৬২ তে দাঁড়িয়েছে।
নিজের এবং তার সংগঠন বেলা’র কাজের প্রতিকূলতা সম্পর্কে রিজওয়ানা হাসান বলেন, নারী হিসেবে তিনি সব সময় সামাজিকভাবে প্রতিকূলতার হন। এর কারণ হিসেবে তিনি মনে করেন সমাজ একজন নারীর নেতৃত্ব এখনো হুমকি হিসেবে দেখে। এর পাশাপাশি যাদের প্রাকৃতিক সম্পদের উপর দখল আছে তারাও নানান প্রতিকূল পরিবেশ তৈরি করে। এছাড়াও বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কাজে ন্যাস্ত স্বার্থগোষ্ঠী ও সরকারকে আলাদা করা যায় না। ক্ষমতাসীন গোষ্ঠীর কাছে থেকে বিভিন্ন সময়ে নানান হুমকির সম্মুখীন হতে হয়। এই হুমকিগুলো ব্যক্তিগত, পারিবারিক বা প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায় পর্যন্ত আসে৷ তবে এ সকল প্রতিকূলতার ক্ষেত্রে গ্রীন পিস বা বিভিন্ন আন্তর্জাতিক পরিবেশবাদী সংগঠনগুলো সহায়তা করে থাকে। জনমত গড়ে তোলার ক্ষেত্রে এ সংগঠনগুলো বিশেষ ভূমিকা রাখে।
একজন রিজওয়ানা হাসান এবং বেলা’র সার্থকতা সম্পর্কে তিনি বলেন, দূষণ প্রতিরোধে সফলতা নির্ভর করে রাষ্ট্রর সামগ্রিক অবস্থার প্রেক্ষিতে। তবে তাদের সব থেকে বড় সফলতার জায়গা ইস্যুগুলোকে বাচিঁয়ে রাখার ক্ষেত্রে তাদের ভূমিকা। পাশাপাশি আদালতের ইতিবাচক রায়, ক্ষেত্রবিশেষে সরকারের ব্যবস্থা গ্রহণ এবং তৎপরতাকে তিনি নিজেদের কাজের স্বার্থকতা হিসেবে দেখেন৷এছাড়াও আইনের শাসনের প্রক্রিয়াগুলো যে এখনো চলমান আছে এটিকেই তিনি নিজেদের সফলতা হিসেবে দেখছেন৷
হাতিরঝিলে বিজিএমইএ ভবন সম্পর্কে তিনি বলেন, ভবন নির্মাণের সময় বিজিএমইএ ঔদ্ধত্য দেখিয়েছে, তারা নিয়ম নীতির তোয়াক্কা না করেই এ ভবন নির্মাণ করে হাতিরঝিলের স্বাভাবিক প্রবাহ বাধাগ্রস্থ করেছে৷ এছাড়াও ব্রিটিশ আমলের আইন ও তার ব্যবহার নিয়ে রিজওয়ানা হাসান নিজের অবস্থান জানান৷ তার মতে বাংলাদেশ আইনের সংস্কারে পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের থেকে অনেক পিছিয়ে আছে। তবে কিছু ক্ষেত্রে আইনের পরিবর্তন আসলেও এসব ক্ষেত্রে ব্রিটিশ সংস্কৃতি থেকে আমরা বেরিয়ে আসতে পারি নি।
রিজওয়ানা হাসান সংসদে জলবায়ু ইস্যুর গুরুত্ব কতটুকু এ সম্পর্কে বলেন, বাংলাদেশের সংসদে জলবায়ু বা পরিবেশ নিয়ে আলোচনা সরকারের কাছে গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু হিসেবে বিবেচিত হয় না। তবে কিছু কিছু সাংসদ এ বিষয়ে কথা বলছেন এবং পরিবেশ রক্ষায় নিজেদের ভূমিকা রাখছেন। কিন্তু শুধুমাত্র পরিবেশকে প্রাধান্য দিয়ে কোনো আলোচনা সংসদে হয় না বা কোনো ধরনের আইন পাশ হয় না। তবে সংসদীয় কমিটিতে কোনো আইন উত্থাপিত হলে পরিবেশ নিয়ে কাজ করছেন এমন প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তিদের মতামতের জন্য আমন্ত্রণ জানানো হয়। তবে বেশিভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যায় কোনো প্রকার পরামর্শ আমলে নেওয়া হয় না।
সুন্দরবনের জীবনবৈচিত্র রক্ষা নিয়ে রিজওয়ানা হাসান এক প্রশ্নের উত্তরে বলেন, সুন্দরবনকে কোনো বিচ্ছিন্ন একটি বন হিসেবে দেখে এর রক্ষা করা সম্ভব হবে না। কারণ এক্ষেত্রে বনের পারিপার্শিক পরিবেশও প্রভাব ফেলে। রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্রের পরিবেশগত ঝুঁকির আশংকা ব্যক্ত করে তিনি বলেন, আমরা কোনোপ্রকার সুরক্ষা কার্যক্রম গ্রহণ করতে পারি নি। তিনি আমাদের দখলদারী মনোভাবকেও সুন্দরবনের জন্য হুমকি হিসেবে চিহ্নিত করেন। সুন্দরবন রক্ষায় ইউনেস্কোর কারিগরি পক্ষ বিভিন্ন সহায়তা প্রদাণ করলেও রাজনৈতিক পক্ষ থেকে কোনোরূপ সহযোগিতা এখনো আসে নি বলে তিনি জানান। এছাড়াও জাহাজ ভাঙা শিল্প এবং এরসাথে জড়িত শ্রমিকদের নিরাপত্তা নিয়ে নিজের হতাশার কথা জানান তিনি। এই শ্রমিকদের জন্য কোনো প্রকার শ্রম আইন মানা হয় না।
দেশের জন্য ও পরিবেশ রক্ষায় কাজ করতে আগ্রহী সকলের উদ্দেশ্যে তিনি বলেন, দেশের জন্য কাজ করতে চাইলে যেকোনো অবস্থানে থেকেই তা সম্ভব পাশাপাশি কোনো অবস্থাতেই দেশের সম্মান ক্ষুণ্ণ হতে দেওয়া যাবে না। বাংলাদেশের মানুষ প্রাণান্ত পরিশ্রম করছে উন্নয়নের জন্য। এই মানুষগুলোর জন্য, আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় কিংবা পরিবেশ রক্ষায় সকলে নিজের অবস্থান থেকে সর্বোচ্চ চেষ্টা করবে বলে তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেন।
লিখেছেনঃ রোমান উদ্দীন