বাংলাদেশের গণ্ডি পেরিয়ে প্রথম বাংলাদেশী হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রে পূর্ণাঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের মালিক হয়েছেন চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (চুয়েট) সাবেক ছাত্র ইঞ্জিনিয়ার আবুবকর হানিপ। বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের ভার্জিনিয়ায় তার মালিকানাধীন ওয়াশিংটন ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি (ডব্লিউইউএসটি) বিদেশে উচ্চ শিক্ষার জন্য বাংলাদেশি শিক্ষার্থীদের আগ্রহের স্থান হয়ে উঠেছে। তিনে নিজে যখন আমেরিকায় গিয়ে চাকরির বাজারে হিমশিম খাচ্ছিলেন তখন প্রযুক্তিখাত […]

আবুবকর হানিপ: দ্য চেঞ্জ মেকার

বাংলাদেশের গণ্ডি পেরিয়ে প্রথম বাংলাদেশী হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রে পূর্ণাঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের মালিক হয়েছেন চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (চুয়েট) সাবেক ছাত্র ইঞ্জিনিয়ার আবুবকর হানিপ। বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের ভার্জিনিয়ায় তার মালিকানাধীন ওয়াশিংটন ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি (ডব্লিউইউএসটি) বিদেশে উচ্চ শিক্ষার জন্য বাংলাদেশি শিক্ষার্থীদের আগ্রহের স্থান হয়ে উঠেছে। তিনে নিজে যখন আমেরিকায় গিয়ে চাকরির বাজারে হিমশিম খাচ্ছিলেন তখন প্রযুক্তিখাত ও নিজেকে দক্ষ করে গড়ে তোলার গুরুত্ব বুঝতে পেরেছেন। সেখান থেকেই তার বাংলাদেশিদের আমেরিকার শিক্ষা ও চাকরি বাজারের মূলধারায় নিয়ে আসার চেষ্টা শুরু হয়। গত ১৭ বছরে ইঞ্জিনিয়ার আবুবকর হানিপ সাত হাজার বাংলাদেশিকে উচ্চ শিক্ষার পাশাপাশি দক্ষতা বিকাশে সহায়তা করেছেন এবং আমেরিকান সংস্থাগুলোতে চাকরি পেতে যোগ্য হিসেবে গড়ে তুলেছেন।

একসময় যারা বছরে আয় করতো কেবল ৪০ হাজার ডলার, তারা এখন বছরে গড়ে লাখ ডলার কিংবা তারও বেশী আয় করছেন। তার এই শিক্ষা কার্যক্রম শুরু হয়েছিল নিজের বাসায় শিক্ষার্থীদের প্রশিক্ষণ দেয়ার মাধ্যমে। তারই ধারাবাহিকতায় ২০০৮ সালে প্রতিষ্ঠিত ‘ইনোভেটিভ গ্লোবাল ইউনির্ভাসিটি’ বা ‘আই গ্লোবাল ইউনির্ভাসিটি’ নামক উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানটি তিনি ২০২১ সালে ১০০ কোটি টাকায় কিনে নেন এবং নাম দেন ‘ওয়াশিংটন ইউনিভার্সিটি অফ সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি’। এছাড়াও তিনি শিক্ষার্থীদেরকে কর্মমূখী শিক্ষা দেয়ার প্ল্যাটফর্ম হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেছেন “পিপল এন্ড টেক” যা শিক্ষার্থীদেরকে দক্ষতা বৃদ্ধিতে কাজ করে যাচ্ছে। বর্তমানে এটি বিশ্বব্যাপী প্রশংসিত ও সমাদৃত হয়েছে। ‘কবিতার সাথে’ অনুষ্ঠানে এই স্বপ্নবাজ ও সফল মানুষটি তার সফলতার নানা গল্প তুলে ধরেছেন।

তিনি বলেন, তিনি যখন ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ে আমেরিকায় গিয়ে ভালো চাকরি না পেয়ে গিফট শপে কাজ করা শুরু করেন, তখন বুঝতে পারেন চাকরির বাজার কতটা কঠিন। তারপর পুনঃরায় কম্পিউটার সাইন্সে ডিগ্রী নিয়ে ৬ মাস চাকরি খোঁজার পর যখন অবশেষে সফল হলেন, তখন সেখানে গিয়ে বাংলাদেশিদের অনুপস্থিতি দেখতে পান। সেখান থেকেই শুরু হয় তাঁর শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ কার্যক্রম। এমনকি, ট্যাক্সির গ্যারাজ চালানো একজন উচ্চশিক্ষিত বাংলাদেশীকে ৬ সপ্তাহ প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ দেয়ার পর তিনি ১ লক্ষ ডলারের চাকরি পান বলে জানান হানিপ। তার উদ্যোগগুলোর মূলে রয়েছে দক্ষতা বৃদ্ধি। আমেরিকার মত দেশে স্নাতক শেষে একজন শিক্ষার্থীর ৬০-৭০ হাজার ডলারের মতো শিক্ষাঋণ থাকে। এই ঋণের বোঝা মাথায় নিয়ে তারা যখন চাকরি পায়না, তখন হতাশা জেঁকে বসে। এছাড়া কর্পোরেট জগতে এন্ট্রি লেভেল চাকরির সুযোগও খুব সীমিত। এর পাশাপাশি, আমেরিকায় প্রতিবছর এইচ১বি ভিসায় প্রায় ৫০০০ দক্ষ কর্মী আনা হয় অন্য দেশ থেকে যেখানে আমেরিকাতেই অনেক নাগরিক স্নাতক এবং স্নাতকোত্তর করার পরও বেকার বসে থাকে। সেখান থেকেই তিনি একটি শিক্ষাব্যবস্থার কথা চিন্তা করলেন যেখানে প্রশিক্ষণকেও সমান গুরুত্ব দেয়া হবে। তার স্বপ্ন ছিল একসময় বাঙালিরা বিশ্ববিখ্যাত কোম্পানিগুলোর নেতৃত্ব দেবে। সে জন্যই তিনি বাঙালি শিক্ষার্থীদের জন্য প্রয়োজনীয় সুযোগ সৃষ্টির কাজ করে যাচ্ছেন। তাঁর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শিক্ষার্থীদের জন্য ১ মিলিয়ন ডলারের শিক্ষাবৃত্তির ব্যবস্থা রয়েছে। এছাড়া স্নাতক বা স্নাতকোত্তরের পর কোনো শিক্ষার্থী চাকরি না পেলে তার পুরো টিউশন ফি এর টাকা ফেরত দেয়ার উদ্যোগও তারা শীঘ্রই নেবেন বলে তিনি জানান। এই খরচগুলোর সবই তার নিজস্ব অর্থায়নে করা।

পিপল এন্ড টেকের মাধ্যমে আবুবকর হানিপ খুবই স্বল্প সময়ে, মাত্র ৪ মাসের মধ্যে, চাকরি প্রত্যাশীদেরকে কোনো একটি বিষয়ে দক্ষ করে তুলতে চেষ্টা করেছেন, যার ফলশ্রুতিতে পরবর্তীতে তারা উচ্চ বেতনের চাকরি খুঁজে পেয়েছে। এখন যেহেতু বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপিত হয়েছে, তিনি আশা করছেন বিষয়ভিত্তিক দক্ষতার পাশাপাশি শিক্ষার্থীরা তাদের মানসিক স্বাস্থ্যের ব্যাপারে, তাদের আনন্দ দেয় এমন গঠনমূলক কাজের ব্যাপারে এখান থেকে জ্ঞান লাভ করবে। তাদেরকে প্রয়োজনীয় সুযোগ দেয়া হবে যাতে তারা নিজেদের পছন্দমতো বিষয় নিয়ে পড়াশোনা করতে পারে।

সুদক্ষ এই প্রকৌশলী ও শিক্ষকের কাছে জানতে চাওয়া হয়, এই কারিগরী দক্ষতাভিত্তিক শিক্ষাব্যবস্থা তরুণ প্রজন্মকে প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থা থেকে সরিয়ে নেবে কিনা? তাদের কাছে প্রচলিত শিক্ষার গুরুত্ব কমে যাবে কিনা? জবাবে তিনি বলেন, প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থার অধীনে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু যারা শিক্ষা সম্পন্ন করার পরও উপযুক্ত দক্ষতার অভাবে চাকরি পাচ্ছে না, তাদের সেই সমস্যা নিয়েই মূলত তিনি কাজ করছেন। এছাড়াও, যারা হয়তো উচ্চতর শিক্ষা সম্পন্ন না করেই প্রশিক্ষণ নিয়ে চাকরি শুরু করেছিলেন, তাদের অনেকেই আবার পরবর্তীতে ফেরত এসে তাদের উচ্চতর শিক্ষা গ্রহণ করেন। কারণ, আমেরিকান কর্পোরেট জগতে উন্নতির জন্য উচ্চতর ডিগ্রির অনস্বীকার্য প্রয়োজন রয়েছে।

পিপল এন্ড টেক এর কার্যক্রম সম্পর্কে বলেন, প্রায় ১৫ বছর ধরে প্রতিষ্ঠানটি অনলাইন ও অফলাইন কার্যক্রম পরিচালনা করে যাচ্ছে। যাদের জন্য সম্ভব, তারা ইন্সটিটিউটে এসে প্রশিক্ষণ নিচ্ছে এবং বাকিরা ভিন্ন ভিন্ন রাজ্য থেকেও যোগ দিচ্ছে। এমনকি ২০১৪ সালে তিনি বাংলাদেশেও পিপল এন্ড টেকের ইন্সটিটিউট স্থাপন করেছেন যার মাধ্যমে প্রায় ৬০০০ লোকের কর্মসংস্থানের সুযোগ হয়েছে। তাঁর কাছ থেকে আমরা জানতে পারি, ২০১৪ থেকে এ পর্যন্ত এই প্রতিষ্ঠানের পেছনে তিনি ১.৫ মিলিয়ন ডলারের মত নিজস্ব অর্থ খরচ করেছেন, অর্থাৎ যাদের তিনি এখানে পড়িয়েছেন, তাদের বেশিরভাগকেই শিক্ষাবৃত্তির মাধ্যমে পড়িয়েছেন।

তিনি বলেন, এই প্রতিষ্ঠানকে তিনি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান হিসেবে দেখেন না, বরং মানুষের জীবন পরিবর্তনের জন্য তৈরি একটি দাতব্য প্রতিষ্ঠান হিসেবেই এটাকে পরিচালনা করেন। বাংলাদেশে প্রায় ১৬২ এর মতো বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে সরকারি এবং বেসরকারি মিলিয়ে যেখান থেকে প্রতি বছর হাজার হাজার শিক্ষার্থী পাশ করে বের হচ্ছে। কিন্তু সবাই কাঙ্ক্ষিত চাকরি পাচ্ছে না, বরং তারা সরকারি চাকরির দিকে ঝুঁকছে। এর পেছনে যেমন দক্ষতার অভাব রয়েছে, তেমনি রয়েছে চাকরি স্বল্পতা। এর ফলে যারা সরকারি টাকায় ডাক্তার বা ইঞ্জিনিয়ার হয়েছে তারা সমাজে তাদের অবদান রাখতে পারছে না। সেক্ষেত্রে তাঁর এই প্রতিষ্ঠানের অনেক শিক্ষার্থী প্রশিক্ষণ সম্পন্ন করে নিজেরা এমন প্রতিষ্ঠান তৈরি করছে যার মাধ্যমে প্রয়োজনীয় দক্ষতা ও প্রযুক্তি বাংলাদেশে আসছে। এমনকি আবুবকর হানিপ নিজেও বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়কে তাদের দক্ষতাকেন্দ্রীক শিক্ষা কার্যক্রম পরিকল্পনা করার ক্ষেত্রে সাহায্য করছেন।


নিজের সাফল্য নিজে তৈরিতে বিশ্বাসী পরিবর্তনের এই কারিগর চিন্তা করেন একটু ভিন্নভাবে। তাই তো ওরাকল কর্পোরেশনের মত প্রতিষ্ঠানের লোভনীয় চাকরি ছেড়ে দিতেও দ্বিধা করেন নি। তিনি জানান, এতদিনে হয়ত পরিচালকও হয়ে যেতেন সেখানে, কিন্তু তিনি বরাবর শুধু নিজের নয়, অন্যান্য মানুষের জীবনেও পরিবর্তন আনতে চেয়েছেন। এ কারণেই তার সব প্রতিষ্ঠানেই হাজার হাজার শিক্ষার্থী শিক্ষাবৃত্তি নিয়ে পড়াশোনা চালিয়ে যাচ্ছে। যাদের খরচ বহন করার সামর্থ্য নেই, তাদের শিক্ষা খরচ তিনি নিজ উদ্যোগে চালিয়ে নিচ্ছেন। এমনকি নিজের তিন মেয়েকেও নিয়মিত বাংলাদেশের ব্যাপারে জানাতে এবং বাংলাদেশকে তাদের মাতৃভূমি হিসেবে পরিচয় করিয়ে দিতে তিনি কাজ করছেন। কারণ, ভবিষ্যতে যদি তারা বড় বড় পদে অধিষ্ঠিত হয়, তাহলে সেখানে তারা বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করবে।

বিকশিত চিন্তাধারা ও উচ্চশিক্ষার ছাপ আবুবকর হানিপের পারিবারিক জীবনেও রয়েছে। তিন মেয়ের মধ্যে বড় মেয়ে ইতোমধ্যে বিশ্ববিদ্যালয় জীবন শুরু করতে চলেছে। মেজ মেয়ে ল্যাংলিতে ক্লাস ৯ এ পড়ছে এবং ছোট মেয়ের বয়স ৬ বছর। স্ত্রী ফারহানা হানিপ শুরু থেকেই তাঁর সকল প্রতিষ্ঠানের সাথে যুক্ত আছেন। এমনকি, সেই শুরুর দিনগুলোতে, যখন নিজেদের বাড়িতে ৩০-৪০ জনের মত প্রশিক্ষণার্থীর নিয়মিত সমাগম হত, তখন ফারহানা হানিপ নিজে রান্না করে বা খাবার এনে সবাইকে খাওয়াতেন। তিনি এই পুরো সময়টাতে ধৈর্য সহকারে স্বামীর পাশে থেকেছেন এবং সবকিছু পরিচালনায় সাহায্য করেছেন। আবুবকর হানিপ মনে করেন, তাঁর স্ত্রীর পরিপূর্ণ সহায়তা ও পাশে থাকার ফলেই আজ পিপল এন্ড টেক সহ অন্যান্য সব প্রতিষ্ঠান দাঁড়িয়ে আছে। ফারহানা হানিপ এখনও পরিপূর্ণভাবে একজন কার্যনির্বাহক হিসেবে সকল প্রতিষ্ঠানের সাথে যুক্ত আছেন। আবুবকর হানিপ তার জ্ঞান ও অর্জিত অভিজ্ঞতা মানুষের মাঝে ছড়িয়ে দিতে চান এবং মৃত্যুর আগে তার অর্জনগুলো মানুষের মাঝে বিলিয়ে দিতে চান। নিজের বিশ্ববিদ্যালয়কে তিনি বাংলাদেশিদের বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে পরিচয় দেন এবং এই বিশ্ব্যবিদ্যালয়ের মাধ্যমে আমেরিকায় যেন ছাত্রছাত্রীরা প্রয়োজনীয় জ্ঞানার্জন করে মধ্য থেকে উচ্চস্তরের চাকরি অর্জন করতে পারে এই কামনা করেন। তিনি চান এই মডেল অনুসরণ করে বাংলাদেশকে বেকারত্বের অভিশাপ থেকে মুক্তি দিতে। ভিন্নধর্মী এই শিক্ষকের প্রত্যাশা, নিজের মৃত্যুর পরও যাতে মানুষের মনে তিনি বেঁচে থাকেন। তাঁর এই বিশ্ববিদ্যালয় যেন একদিন বড় বড় বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর তালিকায় জায়গা করে নেয়, যাতে করে তিনি নিজের এই কাজগুলোর মধ্য দিয়ে মানুষের কাছে স্মরনীয় হয়ে থাকেন, এটাই তাঁর চাওয়া। তার এই চাওয়া যেন শতগুণে সত্য হয়, তার এই মহান উদ্যোগগুলো যেন সফল হয়, এই প্রত্যাশাই রইল।

-শেষ-