দেশীয় সংস্কৃতি চর্চায় যে জাতি যত বেশি সমৃদ্ধ সে জাতি তত বেশি উন্নতি করতে পারে। সংস্কৃতি জীবনের দর্পন। নিজ দেশীয় সংস্কৃতি লালনের মাধ্যমেই ব্যক্তির মাঝে দেশপ্রেম, আদর্শ ও নৈতিকতার জন্ম নেয়। আমাদের দেশে এমন কিছু মানুষ আছেন যারা সংস্কৃতির সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছেন। প্রতিনিয়ত চেষ্টা করে যাচ্ছেন কালের গহ্বরে যাতে দেশীয় সংস্কৃতি হারিয়ে না যায়। নতুন প্রজন্মের কাছে ইতিহাস ও ঐতিহ্যকে সঠিকভাবে উপস্থাপন করার জন্য করে যাচ্ছেন নিরলস পরিশ্রম। আজকে এমনি একজন কিংবদন্তির কথা বলবো যিনি সমগ্র বাংলাদেশের ঐতিহ্যকে উচ্চ শিখরে নিয়ে গিয়েছেন। নিজের দেশের সাথে সাথে নন্দিত করেছেন নিজের নামকেও, সার্থক করেছেন নিজের জন্মকে। তিনি হলেন বাংলাদেশের প্রথিতযশা নৃত্যশিল্পী ও গবেষক, স্বাধীনবাংলা বেতার কেন্দ্রের একজন গর্বিত সৈনিক এবং বাংলা সংস্কৃতির ঐতিহ্যের ধারক লুবনা মরিয়ম।
লুবনা মরিয়মের জন্ম ১৯৫৪ সালে। নন্দিত এই নৃত্যশিল্পী মুক্তিযোদ্ধা কাজী নুরুজ্জামান ও অধ্যাপক ড. সুলতানা কামালের কণ্যা। তিনি মুক্তিযুদ্ধের সময় শরণার্থী ক্যাম্পে শরণার্থীদের সেবা শুশ্রুষার কাজ করেন। বুয়েটে স্থাপত্যকলায় ভর্তি হলেও তৃতীয় বর্ষেই শিক্ষার পাঠ চুকিয়ে নাচে মনযোগী হন এবং নৃত্যকলা নিয়ে পড়াশোনা করেন। পরবর্তীতে তিনি টরেন্টো বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাস্টার্স সম্পন্ন করেছেন।
নাচকে কিভাবে জীবনের অংশ করেছেন এই প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, জীবন কখনো সরলরেখার মতো চলে না। সবার জীবনেই আনন্দ ও দুঃখ-কষ্টের সংমিশ্রণ থাকে। লুবনা মরিয়মের জীবনও স্রোতের ব্যতিক্রম ছিলো না। ছোটবেলা থেকেই নানা রকম শারীরিক অসুস্থতা নিয়ে বড় হয়েছেন তিনি। শৈশবের বেশিরভাগ সময় কাটিয়েছেন হাসপাতালে তাইতো হাসপাতালের বেডে শুয়ে শুয়ে স্বপ্ন দেখতেন বড় হয়ে ডাক্তার হবেন তিনি। স্বল্পভাষী হওয়ায় একা একাই থাকতেন বেশিরভাগ সময়। তাই তার অধ্যাপিকা মা তাকে নাচের একাডেমিতে ভর্তি করে দেন। প্রথমে নাচ তার পছন্দ না থাকলেও ধীরে ধীরে মঞ্চের সাথে সখ্যতা গড়ে উঠে তার।
বাংলা ও বাঙ্গালীর সংস্কৃতিকে মনে প্রাণে ধারণ করেন লুবনা মরিয়ম। শিল্পচর্চার সাথে ছেলেমেয়েদের যুক্ত করা উচিত বলে তিনি মনে করেন। কেননা একমাত্র শিল্পচর্চার মাধ্যমেই ছেলেমেয়েদের সঠিক মানসিক বিকাশ হয় বলে তার ধারণা। শুধু সংস্কৃতির চর্চা নয় সেই সাথে সংস্কৃতি নিয়ে গবেষণাও করেন তিনি। দেশ ও জাতির সংস্কৃতি নিয়ে বিভিন্ন ধরণের গবেষণামুলক লেখা রয়েছে তার। সৃষ্টি করেছেন ‘সাধনা (এ সেন্টার ফর দ্যা এডভান্স অব সাউথ এশিয়ান কালচার)’ এর মতো প্রতিষ্ঠান। সাধণা কেন এবং কিভাবে আসলো এই প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, “সাধনা প্রথমে কেবল নাচ-গানের প্রশিক্ষণ চর্চা কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন তিনি। কিন্তু দিন যত বাড়ছিলো তিনি তত বেশি অনুধাবন করতে পারছিলেন যে শুধুমাত্র প্রশিক্ষণ দিয়ে তাঁর কাজ সম্পূর্ণ হবে না। বাংলার সংস্কৃতিকে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে যথাযথ ভাবে তুলে ধরতে হলে সেগুলোর সংরক্ষণ করতে হবে। সেই লক্ষ্যেই তিনি শুরু করেন প্রযোজনা। এ পর্যন্ত ২৬টিরও বেশি পরিচালনা রয়েছে তার।
বাংলাদেশের শিল্প ও সংস্কৃতি বাইরের মানুষের কাছে কেমন এই ব্যাপারে জানতে চাইলে তিনি বলেন, বাইরের মানুষের কাছে এদেশের শিল্প সংস্কৃতি কেমন তা ঠিক বলতে না পারলেও দেশের মানুষের গর্ব করা উচিত এ দেশে জন্মেছে বলে। বিভিন্ন দেশ থেকে যেমন নদী এসে একই মোহনায় মিলিত হয় সংস্কৃতির ব্যাপারটিও তার কাছে ঠিক তেমন। সংস্কৃতি পরিবর্তনশীল আবার সংস্কৃতির সংমিশ্রণও হয়। বিভিন্ন দেশে নানা রকম চিন্তা আছে সেসবের সংমিশ্রণে সংস্কৃতির পরিবর্তন হয়। এদেশের সংস্কৃতিকে মিশ্র সংস্কৃতি বলেন তিনি। এদেশে বৌদ্ধ দর্শন যেমন আছে ঠিক তেমনি চৈতন্য, শ্রীকৃষ্ণ, বৈষ্ণব, আবার ব্রিটেন সহ বিভিন্ন দেশের সংস্কৃতি এক হয়ে যোগ করেছে এক ভিন্ন মাত্রা। এতো ছোট দেশে এতো সংস্কৃতির মিশ্রণ নতুন প্রজন্মের এসব জানা উচিত বলে মনে করেন তিনি।
বর্তমানে লক্ষ্য করা যায় যে বলিউড ও পশ্চিমা সংস্কৃতির প্রভাবে দেশীয় সংস্কৃতি হারিয়ে যাচ্ছে। এমনকি বাঙালির বিয়েতেও চলে এসেছে বিদেশী ছাপ। এই যে সংস্কৃতির হারিয়ে যাওয়ার অবস্থা এই নিয়ে লুবনা মরিয়মের ভাবনা কী তা জানতে চাইলে তিনি বলেন, পরিবর্তন থামানো যায় না। তবে ঐতিহ্যের সাথে নতুন প্রজন্মকে পরিচয় করিয়ে দিতে হবে। নতুন প্রজন্মের মাঝে সংস্কৃতির ভালোলাগা ও ভালোবাসা তৈরি করা গেলে তারাই এসব চর্চা করবে।
মুক্তিযুদ্ধের সময় মুক্তিযোদ্ধাদের পক্ষে পরোক্ষভাবে কাজ করেছেন তিনি। তার পিতা এবং ১৫ বছরের ছোট ভাই সরাসরি মুক্তিযুদ্ধ করেছেন। খুব কাছ থেকে তিনি ও তার পরিবার মুক্তিযুদ্ধের ভয়াবহতা প্রত্যক্ষ করায় তিনি কখনো মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কাজ করেন নি এমনকি তার পিতার কড়া আদেশ ছিল কখনো তাদের বাড়িতে যেন মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কথা না হয়। তবে স্বাধীনতার ৫০ বছর পর এসে তিনি মনে করছেন এখন সময় এসেছে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কাজ করার। কেননা, এই প্রজন্ম মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস সম্পর্কে জানেন না। তিনি মনে করেন, মুক্তিযুদ্ধকে অনেকে ভুলভাবে ব্যাখা করছেন যেটা কখনোই কাম্য নয়। তাইতো তিনি মুক্তিযুদ্ধের ওপরে ‘মহানন্দা’ নামে একটি চিত্রনাট্য উপস্থাপন করেন। মহানন্দা সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, মুক্তিযুদ্ধের সময় ১৪ ডিসেম্বরে মদানন্দার তীরে ৪০টি লাশ পাওয়া যায়। লাশগুলো কার সে সম্পর্কে যেমন কেউ জানে না ঠিক তেমনি লাশগুলোর কোন নথিও পাওয়া যায় নি। কিন্তু এসব সম্পর্কে মানুষের জানা উচিত। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস সম্পর্কে নানা ধরনের ভুল ব্যাখা হয়। ভারত মনে করে তারা বাংলাদেশকে ১৩ দিনে স্বাধীন করেছে। কিন্তু এই দেশকে ভারত স্বাধীন করেনি। আমাদের দেশের সর্বস্তরের জনগন এই দেশকে স্বাধীন করেছে। অবশ্যই ভারত আমাদের সাহায্য করেছে তবে কৃতিত্ব তাদের নয়। কৃতিত্ব আমাদের দেশের জনগনের।
মৃত্যুর পর নিজেকে কিভাবে স্মরণীয় করতে চান এই প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, তিনি প্রাতিষ্ঠানিক কোন পরিচয় চান না। তবে একজন সৎ মানুষ হিসেবে মানুষ তাকে মনে রাখুক এইটাই তার প্রত্যাশা।
দেশবরেণ্য এই নৃত্যশিল্পী নৃত্যে বিশেষ অবদানের জন্য ২০১৯ সালে শিল্পকলা পদক লাভ করেন। ২০১৬ সালে ৭১ ফাউন্ডেশন, ২০১৫ সালে জিনাত জাহান স্মৃতি পুরষ্কার সহ নানা ধরনের পুরষ্কারে ভুষিত হয়েছেন তিনি।
গুনী এই শিল্পী দেশের জন্য কাজ করছেন। দেশের শিল্প ও সংস্কৃতিকে সংরক্ষণের জন্য কাজ করে যাচ্ছেন। নতুন প্রজন্ম তার এই কাজকে এগিয়ে নিয়ে যাবেন বলে তিনি বিশ্বাস করেন। তিনি চান, মানষ চিন্তা ও চেতনাকে কাজে লাগিয়ে এই পৃথিবীকে সুন্দর করে রাখুক। দেশকে বাঁচানোর জন্য নতুন প্রজন্ম এগিয়ে আসুক।
লিখেছেন – রোমান উদ্দিন