গান মানুষের জীবনের কথা বলে, গান মানুষের প্রাণের কথা বলে। গানের মাধ্যমে মানুষ হারিয়ে যেতে পারে অন্য এক জগতে যে জগৎ তার একান্ত ব্যক্তিগত। তাইতো গানের শিল্পীরা নারী-পুরুষ ও যুবক-বয়স্ক নির্বিশেষে সবার কাছে বিশেষভাবে সমাদৃত হন। আজকে ঠিক এমনি একজন মানুষের কথা বলবো যে তার সুর দিয়ে জয় করে নিয়েছে জনমানুষের মন। গানে গানে যার […]

গানে গানে জীবন : ডরথী বোস

গান মানুষের জীবনের কথা বলে, গান মানুষের প্রাণের কথা বলে। গানের মাধ্যমে মানুষ হারিয়ে যেতে পারে অন্য এক জগতে যে জগৎ তার একান্ত ব্যক্তিগত। তাইতো গানের শিল্পীরা নারী-পুরুষ ও যুবক-বয়স্ক নির্বিশেষে সবার কাছে বিশেষভাবে সমাদৃত হন। আজকে ঠিক এমনি একজন মানুষের কথা বলবো যে তার সুর দিয়ে জয় করে নিয়েছে জনমানুষের মন। গানে গানে যার বেড়ে ওঠা। আমেরিকাসহ দেশ-বিদেশে গানের জন্য সুপরিচিত একটি নাম ডরথী বোস।

ডরথী বোসের বেড়ে ওঠা রাজধানী ঢাকাতেই। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগ থেকে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করে উচ্চশিক্ষার জন্য সুদূর যুক্তরাষ্ট্রে পাড়ি জমান তিনি। সেখানে মনস্তত্ত্ব নিয়ে পড়াশোনা করেন এবং বর্তমানে স্বামী সন্তানসহ যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটন ডিসিতে অবস্থান করছেন তিনি। ডরথী বোসের সঙ্গীতের হাতেখড়ি তার বাবার কাছেই। গানের চর্চাকে কখনো আদালাভাবে দেখেননি তিনি। কেননা, তার বেড়ে ওঠা গানের মাঝেই। ছোটবেলা থেকেই গান ও সুর শুনে শুনেই বড় হয়েছেন তিনি, তাইতো গান যে তাঁর একাডেমিক শিক্ষার অংশ নয় সেটি কখনোই উপলব্ধি করেন নি তিনি। মূলধারার শিক্ষার পাশাপাশি তিনি রবীন্দ্র সঙ্গীতের উপর প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা নিয়েছেন। টিভি খুললেই বিভিন্ন বাংলা গানের অনুষ্ঠানে দেখা যায় তাঁকে। এছাড়া, আমেরিকায় বাংলা ভাষাভাষী মানুষের কমিউনিটি অনুষ্ঠানে ডরথী বোস জনপ্রিয় একটি নাম। তিনি খুবই সংস্কৃতিমনা একজন মানুষ। তাইতো, পারিবারিক ও ব্যক্তিগত জীবন দুই জায়গাতেই বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতিকে তিনি লালন করে চলছেন প্রতিনিয়ত। বিদেশে থাকলেও দেশীয় সংস্কৃতি চর্চায় কখনো অবহেলা করেন না তিনি।

ডরথী বোস রবীন্দ্রচর্চার জন্য বিশেষভাবে খ্যাত। অন্যান্য গানের চর্চা করলেও রবীন্দ্রসংগীতের উপর তার রয়েছে প্রাতিষ্ঠানিক দক্ষতা। তাঁর এই রবীন্দ্র প্রীতি কিভাবে জন্ম নিলো এমন প্রশ্নের উত্তরে ডরথী বলেন ছোটবেলা থেকেই তাঁর গান শুনে শুনে বড় হওয়া। যখন গান শুনতো তখন তিনি বুঝতেনও না কী গান চলেছে। মায়ের কাছ থেকেই রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে জেনেছেন তিনি। তাদের বাড়িতে সবসময় ক্লাসিকাল গান বাজতো এবং গ্রামোফোনন ও রেকর্ড প্লেয়ার ছিলো তাদের বাসায়। নজরুল, শ্যামা সঙ্গীত, রবীন্দ্রনাথ অথবা পুরোনো দিনের সিনেমার গান বাজতো সবসময়। সেই শৈশব থেকে রবীন্দ্রনাথ শুনে শুনে বড় হতে হতে একটা সময় তাঁর মাঝে রবীন্দ্র প্রীতির জন্ম হয়েছে বলে জানিয়েছেন তিনি।

বর্তমানে ডিজিটাল যুগে বাস করছি আমরা সবাই। ইন্টারনেটের সহজলভ্যতার পাশাপাশি নেশাদ্রব্য থেকে শুরু করে অনেক কিছুই এখন আমাদের কাছে সহজলভ্য হয়ে উঠেছে। এছাড়া, প্রবাসে বসবাস করলেও আমরা চাই আমাদের সন্তানরা আমাদের সংস্কৃতি লালন করুক, অন্যদিকে সন্তানরা আরেকটি সংস্কৃতিতে অভ্যস্ত। দু’পক্ষের এই টানাপোড়নে হতাশার সৃষ্টি হয় বাচ্চাদের মাঝে। ডরথী বোস কেবল সংগীত শিল্পী নন তিনি একজন মনস্তত্ত্ব বিশেষজ্ঞ। একজন মা এবং মন বিষয়ক বিশেষজ্ঞ হিসেবে এই ব্যাপারে তাঁর অভিমত কী এই প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, “টিন-এজ বা কিশোর বয়সটা খুবই আবেগকেন্দ্রিক। প্রত্যেকটা পরিবারই জড়তাগ্রস্থ এবং সমস্যাবিহীন কোন পরিবার নেই। এছাড়া এখনও বাংলাদেশে কিছু ট্যাবু কাজ করে। শুধু দেশে নয় বিদেশেও এসব ট্যাবু রয়েছে। তারা হতাশার জন্য কোন পদক্ষেপ নিতে চায় না। তারা ভাবে তাদের সন্তানতো পাগল নয়। এছাড়া আমরা বুঝতেও পারি না কখন আমাদের কাউন্সিলর প্রয়োজন। হতাশায় ভোগা মানে পাগল হয়ে যাওয়া নয়, এটি ক্যামিকেল ইমব্যালেন্সের ফল এই ব্যাপারটি মানু্ষ বুঝে না। আমরা স্বীকার করি না আমাদের সন্তানদের সমস্যা আছে। তিনি বলেন, বাবা মা হিসেবে প্রথম দায়িত্ব হলো সন্তানের সমস্যা স্বীকার করা এবং সন্তানের মানসিক অবস্থা বোঝার চেষ্টা করা। সন্তানের সাথে খারাপ আচরণ না করে সময় নিয়ে তাদের কথা শোনা এবং বাচ্চাদের সান্থে সময় কাটানো।

যখনই পরিবার বাচ্চাদের কথা শোনেনা বা পরিবারের সাথে দূরত্ব সৃষ্টি হয় তখনই তারা মাদকাসক্ত হয়ে পড়ে বা বিভিন্ন ধরণের অনৈতিক কাজ করে। তিনি জোর দিয়ে বলেন, পিতামাতা ও সন্তানদের মাঝে যেন দূরত্বের সৃষ্টি না হয়। তার নিজেরও দুটো সন্তান আছে, তিনি প্রতিদিন নিয়ম করে সন্তানরা স্কুল থেকে ফেরার পথে তাদের খোঁজ খবর নেন। যেমন – স্কুল কেমন গেলো, কোন বন্ধুদের সাথে মিশে ইত্যাদি। বাচ্চারা কোনও ভুল করলে যাতে বাবা-মায়ের সাথে শেয়ার করতে পারে এমন একটা বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রাখার ওপর জোর দেন তিনি। তবে সেই বন্ধুত্বের অবশ্যই সীমাবদ্ধতা থাকবে বলেও মনে করেন তিনি। তিনি তাঁর ছেলেমেয়েদেরকে বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে নিয়ে যান। বিভিন্ন ধরনের সামাজিক অনুষ্ঠানে তিনি তার ছেলেমেয়েদের ভলেন্টিয়ারিং করানোর চেষ্টা করেন। এতে করে বাচ্চাদের মানসিক বিকাশ হয়। বিভিন্ন সংস্কৃতির সাথে যেমন পরিচিত হয় তেমনি নিজের সংস্কৃতির প্রতি সম্মান ও শ্রদ্ধাবোধও সৃষ্টি হয়। সবকিছুতে এক্টিভ রাখতে চান তিনি, এরপর সন্তানরা কতটুকু গ্রহন করবে সেটা তাদের ব্যাপার। একজন শিশুর সুস্থভাবে বেড়ে ওঠার সাথে প্যারেন্টিং খুবই গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করেন তিনি।

ডরথী বোস ছোটবেলায় কেমন ছিলেন এবং কী স্বপ্ন ছিলো এই প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ছোটবেলায় তিনি খুব একটা দুষ্টও ছিলেন না আবার শান্তও ছিলেন না। তবে তিনি খুব পড়ুয়া ছিলেন। তাঁর ছোটবেলাটা ছিলো খুবই সুন্দর। পরিবারের সবাই মিলে চাঁদের আলোয় ছাদে গান গাইতেন তারা। লোডশেডিং হলে ডরথী বোসের খুশির সীমা থাকতো না। এখন তিনি এসব মিস করেন। ছোটবেলা থেকেই গানের প্রতি তার ছিলো অগাধ ভালোবাসা। তাই গান নিয়ে কিছু একটা করার স্বপ্ন ছিলো তাঁর। তাছাড়া আমেরিকায় থেকে যাওয়ারও ইচ্ছে ছিলো না। তিনি এখনো মনে করেন, যদি দেশে থাকতেন তাহলে হয়তো গানের জন্য নতুন নতুন প্রকল্প হাতে নিতে পারতেন। গানের জগতে কিছু দিয়ে যেতে পারতেন তিনি। ডরথী বোসের জীবনে এক নতুন দিগন্তের সূচনা করেছিলেন তার বাবা-মা। তার মা অনেক সংস্কৃতিমনা হওয়ার কারনে ছোটবেলা থেকেই নজরুল ও রবীন্দ্রনাথের সাথে পরিচয় ঘটে। আর গান কিভাবে গাইতে হবে সেই শিক্ষা পান বাবার কাছে। গানের স্বরলিপি শেখা তার বাবার কাছেই। তিনি বলেন, একটা গান তিনভাবে প্রসেস হয়। এক,লেখকের কাছে, যিনি গানের স্রষ্টা তিনি এক ভাবে উপলব্ধি করে গান লিখেন। দুই, গায়ক যিনি গান গায় তিনি নিজের মতো করে একটা অর্থ ধরে নিয়ে গায়। তিন শ্রোতা, যারা গানটি শুনেন এবং তাদের পরিস্থিতি অনুযায়ী গানের অর্থ খুঁজে বের করেন।

ডরথী বোস এমন ব্যস্ত একজন মানুষ। যিনি ঘর, সংসার, চাকরী, বাচ্চা সব সামলে নিজের রেওয়াজ করার জন্য সময় বের করেন। তাঁর কাছে সময়ের সঠিক ব্যবহার ও সময়ের বণ্টণ অনেক গুরুত্ব বহন করে। সময় অল্প কিন্তু আমাদের কাজ করতে হয় প্রচুর। অনেক চ্যালেঞ্জিং টাইমের মাঝে দিয়ে যেতে হয়। এরজন্য অবশ্য পার্টনারের সহযোগীতা খুব দরকার বলে মনে করেন তিনি। একার পক্ষে সবকিছু করা সম্ভব না বলে জানান তিনি।

ডরথী বোসের দেশের জন্য খারাপ লাগা কাজ করে কি না এই প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ছেড়ে গেলে আসলে মর্যাদা অনুভব করা যায়। বাইরে আছে বলেই দেশপ্রেমটা আরও গভীরভাবে হানা দেয়। ছেড়ে না গেলে বুঝতেই পারতেন না তার মনে এতো দেশপ্রেম কাজ করে। ২১ শে ফেব্রুয়ারি, ২৬ শে মার্চ ও ১৬ ডিসেম্বরের মতো বিশেষ দিনগুলোতে এই তারকা ব্যক্তি আরও বেশি আবেগপ্রবণ হয়ে ওঠেন।
আজ থেকে ঠিক ১০ বছর পর ডরথী বোস নিজেকে কোথায় দেখতে চায় এই প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, গানের মাঝে। এই জনপ্রিয় রবীন্দ্রসংগীত শিল্পী গানের মাঝেই বাকি জীবন পার করতে চান।