দেশ ও দেশমাতৃকার সাথে প্রতিটি মানুষের আত্মিক সম্পর্ক থাকে। অনেকে নিজের দেশ কে ছেড়ে যেতে পারলেও দেশের মায়াকে ছাড়তে পারেন না। তাইতো প্রবাস জীবনেও হন্য হয়ে দেশ ও সংস্কৃতির জন্য অকাতরে কাজ করে যান অনেকেই। নানা বৈরী পরিবেশ ও সংস্কৃতির ভিড়ে নিজের সংস্কৃতিকে তুলে ধরার চেষ্টা করে যান অনেকেই। আজকে ঠিক এমনই একজন ব্যক্তিত্বের কথা […]

জীবনের কথক: ফরহাদ হোসেন

দেশ ও দেশমাতৃকার সাথে প্রতিটি মানুষের আত্মিক সম্পর্ক থাকে। অনেকে নিজের দেশ কে ছেড়ে যেতে পারলেও দেশের মায়াকে ছাড়তে পারেন না। তাইতো প্রবাস জীবনেও হন্য হয়ে দেশ ও সংস্কৃতির জন্য অকাতরে কাজ করে যান অনেকেই। নানা বৈরী পরিবেশ ও সংস্কৃতির ভিড়ে নিজের সংস্কৃতিকে তুলে ধরার চেষ্টা করে যান অনেকেই। আজকে ঠিক এমনই একজন ব্যক্তিত্বের কথা বলব; দেশীয় সাংস্কৃতিক পরিমন্ডলে যার অবাধ পদাচারণা – ফরহাদ হোসেন। তিনি একাধারে একজন লেখক, চিত্রনাট্যকার, নির্মাতা, প্রযোজক ও সাংস্কৃতিক সংগঠক।

ফরহাদ হোসেন সাংস্কৃতিক পরিমন্ডলের ব্যক্তিত্ব হলেও পেশাগত জীবনে তিনি একজন আইটি কনসালটেন্ট। শিকাগোর ডিপলস ইউনিভার্সিটি থেকে তিনি কম্পিউটার ম্যানেজমেন্ট এন্ড ইনফরমেশন সিস্টেমস এ স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেছেন। বর্তমানে তিনি বিশ্ববিখ্যাত প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান আইবিএম এ আইটি কনসালটেন্ট হিসেবে কর্মরত আছেন। এছাড়াও তিনি শিকাগো ফিল্ম মেকারস থেকে চলচিত্র নির্মাণ ও পরিচালনায় উচ্চতর প্রশিক্ষণ নিয়ে “শিকাগো বায়োস্কোপ” নামে নিজস্ব প্রোডাকশন হাউস প্রতিষ্ঠা করেন। 

চিত্রনাট্য থেকেই মূলত ফরহাদ হোসেন লেখালেখির জগতে প্রবেশ করেছেন। লেখালেখির অনুপ্রেরণার উৎস কোথায় এ প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, শুরুতে তিনি চিত্রনাট্য লিখতেন, তারপর নিজে কাজ করেছেন নিজের চিত্রনাট্যে, পরিচালনা করেছেন, কিন্তু কখনও লেখক হবেন সেই কথা তিনি চিন্তা করেন নি। তার লেখালেখির প্রথম অনুপ্রেরণা হলেন জনপ্রিয় অভিনেতা শহিদুজ্জামান সেলিম। শহিদুজ্জামান সেলিম একবার আমেরিকায় যান শ্যুটিং এর কাজে। তখন তিনি ফরহাদ হোসেনের সাথে পূর্ব পরিকল্পনানুযায়ী সাক্ষাৎ করেন। কথাবার্তার এক পর্যায়ে ফরহাদ হোসেন শহিদুজ্জামান সেলিমকে একটি চিত্রনাট্য পড়তে দেন এবং এটা জানান যে ফরহাদ হোসেন চান তিনি যাতে সেই চিত্রনাট্যে অভিনয় করেন। কিন্তু ফরহাদ হোসেনের লেখা চিত্রনাট্য এতটাই চমকপ্রদ এবং উচ্চমানের হয়েছে যে শহিদুজ্জামান সেলিম ফরহাদ হোসেনের স্ত্রীকে বলে আসেন যেন তিনি তার স্বামীকে লেখার জন্য অনুপ্রেরণা দেন। তিনি জানান, পরবর্তী অনুপ্রেরণা হলেন ফরিদা পারভীন এবং তৃতীয় অনুপ্রেরণা হলেন অন্যপ্রকাশের মাজহার ইসলাম। মাজহার ইসলাম যখন তাকে ডেকে বলেন যে অন্যপ্রকাশ তার লেখা ছাপাতে চায়, তখন তিনি সবচেয়ে বেশি অনুপ্রেরণা পেয়েছেন। এটাই মূলত তার চিত্রনাট্যকার থেকে গল্পকার হয়ে ওঠার ছোট গল্প। “তৃতীয় পক্ষ” নামক বইটি তার প্রথম প্রকাশিত বই। এরপর এক দশকে মোটামুটি ৫/৬ টি গ্রন্থ রচনা করে ফেলেছেন তিনি। 

চরিত্রগুলো মূলত কোথা থেকে সৃষ্টি এবং এর সাথে বাস্তবিক জীবনের কোন যোগসূত্র আছে কি না এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, চরিত্র সবসময় কাল্পনিক নয়। লেখার সময় ও ভাবনার সময় নিজের জীবনের প্রতিফলন চরিত্রগুলোতে প্রতক্ষ্য ও পরোক্ষ ভাবে চলে আসে। লেখকেরা নিজের জীবনের ঘটনাও অনেক সময় বেনামে লিখে ফেলেন।

তিনি জানান, প্রবাস জীবনে নানাবিধ সমস্যায় জর্জরিত থাকে মানুষ। সংস্কৃতির ভিন্নতা, ব্যক্তিগত সমস্যা, পারিবারিক সমস্যা, হতাশা, সিটিজেনশিপ নিয়ে চিন্তা এসব প্রতিটি অভিবাসী বাঙালির জীবনের চিত্র। আর এই বিষয়গুলিই তিনি তার লেখনিতে ফুটিয়ে তুলেন।

জীবন একাধারে যেমন সহজ একটি বিষয় ঠিক তেমনি জীবন অনেক জটিলও। জীবনের এই সহজ ও জটিল সমীকরণের নাম সম্পর্ক। মানুষের জীবনের সমীকরন লেখক ফরহার হোসেনের কাছে কেমন এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, সব সম্পর্কই যত্নের ফসল। সময়ের সাথে সাথে অনেক কিছুর পরিবর্তন হয়,  সম্পর্কে আসে নতুন মোড়। তাই তার কাছে সম্পর্কের আরেক নাম যত্ন।

লেখকের প্রিয় লেখক কে? এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বেশ কয়েকজন গুনী লেখকের নাম বলেন। প্রথমত, হুমায়ুন আহমেদ তার প্রিয় লেখক। বুদ্ধদেব গুহ দিয়ে তিনি নিজেকে পাঠক হিসেবে উপস্থাপন করলেও হুমায়ুন আহমেদ দিয়ে তিনি প্রভাবিত বলে জানিয়েছেন। তিনি বলেন, হুমায়ুন আহমেদ তাকে কেবল পাঠক নয় একজন লেখক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করতেও প্রভাবিত করেছেন। তারপর বুদ্ধদেব গুহ ও সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় তার প্রিয় লেখক। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের সাথে তার সাক্ষাৎ হলেও বুদ্ধদেব গুহের সাথে সাক্ষাৎ করার সৌভাগ্য তার হয়নি। তবে টেলিফোনে তাদের শুভেচ্ছা বিনিমিয় হয়েছে বলে জানান তিনি। এমনকি বুদ্ধদেব গুহ তাকে ও তার স্ত্রীকে উপহারও পাঠিয়েছেন। এই তিনজন ছাড়াও শমরেশ মজুমদার তার প্রিয় লেখক। 

নতুন প্রজন্মের লেখকদের মাঝে কার লেখা সবচেয়ে ভালো লাগে ফরহাদ হোসেনের এর উত্তরে তিনি বলেন, নতুনরা সবাই অনেক ভালো লিখেন। বিশেষ করে কারোর নাম নিতে চান না তিনি। বর্তমানে সবার লেখার মান অনেক ভালো বলে মনে করেন তিনি।

প্রবাসীদের কাছে বাংলা বই এখনো সহজলভ্য হয়নি। পাঠক চাইলেও সবসময় বই সংগ্রহ করতে পারেন না। এ বিষয়ে তিনি জানান যে তারা চাচ্ছেন বিদেশে বই মেলার আয়োজন করতে। এছাড়াও তিনি ব্যক্তিগত ভাবে একটি সংস্থার সাথে মিলে এই বিয়য়ে উন্নয়নের জন্য কাজ করছেন এখন।

লেখক ফরহাদ হোসেন আগে চিত্রনাট্য লিখতেন এবং পরিচালনাও করতেন। চলচিত্র নির্মানের অভিপ্রায় আছে কি না এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, সবারই চূড়ান্ত লক্ষ্য থাকে চলচ্চিত্র নির্মানের, উনারও তেমন চলচ্চিত্র তৈরির ইচ্ছা আছে।

মুক্তিযুদ্ধের সিনেমা পছন্দ করেন তিনি। শ্রাবণ মেঘের দিন সিনেমাটি তার খুব প্রিয় একটি সিনেমা। সিনেমা থেকে অনেক কিছুই তিনি গ্রহণ করেন বলে জানান। এমনকি পরবর্তীতে এসব শিক্ষা নিজের জীবনে ও লেখনিতে প্রয়োগ করেন বলে জানান তিনি।

নিজের সম্পর্কে বলতে গিয়ে তিনি বলেন, প্রথমত, তিনি অত্যন্ত আবেগী একজন মানুষ। দ্বিতীয়ত, তিনি নিজেকে প্রকাশ করতে পারেন না। নিজের দুঃখ, কষ্ট কাউকে বুঝতে দেননা। আর সর্বশেষ, তার বন্ধুভাগ্য খুবই ভালো। তবে, বন্ধুরা তাকে বুঝতে পারেন না বলে আক্ষেপ করেন তিনি।

লেখক ফরহাদ হোসেন মৃত্যুর পর কিভাবে স্মরণীয় হতে চান এই প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, তিনি মনে করেন না তিনি এমন কিছু করতে পেরেছেন যে মানুষ তাকে মৃত্যুর পর মনে রাখবে। তবে যদি কোন ইচ্ছা থেকে থাকে তবে সেটি হলো, তিনি চান মানুষ তাকে একজন ভালো মানুষ হিসেবে মনে রাখুক। একজন ভালো মানুষ হিসেবে সকলের মাঝে বেঁচে থাকতে চান তিনি।

লিখেছেন – রোমান উদ্দিন