ডা: আলিম আক্তার ভুইয়া আমেরিকান বোর্ড থেকে স্বীকৃতিপ্রাপ্ত বাংলাদেশের একমাত্র নিউরোলজি ও এপিলেপসি বিশেষজ্ঞ। তিনি ১৯৮৮ সালে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ থেকে স্নাতক সম্পন্ন করেন। পরবর্তীতে, তিনি লন্ডন স্কুল অফ ট্রপিক্যাল মেডিসিন অ্যান্ড হাইজিন থেকে ডিপ্লোমা ইন ট্রপিক্যাল মেডিসিন অ্যান্ড হাইজিন (ডিটিএমএন্ডএইচ) অর্জন করেন। ডাঃ ভুইয়া যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক সিটি ইউনিভার্সিটির অধীনে কুইন্স হাসপাতাল সেন্টার (মাউন্ট সিনাই হাসপাতালের সাথে অধিভুক্ত) থেকে ইন্টারনাল মেডিসিনে স্নাতকোত্তর প্রশিক্ষণ নিয়েছেন। তিনি নিউরোলজি ও পোস্ট-ডক্টরাল ফেলোশিপ ইন এপিলেপসি এবং ক্লিনিক্যাল নিউরো – ফিজিওলজিতে স্নাতকোত্তর রেসিডেন্সি প্রশিক্ষণ করেছেন স্টেট ইউনিভার্সিটি অফ নিউ ইয়র্ক, সিরাকিউস, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে। সেখানে, তিনি পরপর দুই বছর (১৯৯৭ এবং ১৯৯৮) মেডিকেল ছাত্রদের শিক্ষাদানে শ্রেষ্ঠত্বের জন্য বিভাগীয় আবাসিক শিক্ষাদান পুরস্কারে ভূষিত হন। তিনি আমেরিকান বোর্ড অফ সাইকিয়াট্রি অ্যান্ড নিউরোলজি থেকে নিউরোলজিতে বোর্ড সার্টিফিকেশনও পেয়েছেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কের সিরাকিউসে ভেটেরানস অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (ভিএ) হাসপাতালে তিনি পরামর্শক নিউরোলজিস্ট হিসেবে কাজ করেছেন এবং ১৯৯৯ থেকে ২০০৫ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ মেডিকেল কলেজের নিউরোলজি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ও প্রধান ছিলেন। বর্তমানে তিনি ইউনাইটেড হাসপাতালে ফুল টাইম সিনিয়র কনসালটেন্ট হিসেবে কর্মরত আছেন। নিউরোলজিতে তাঁর একাধিক জাতীয় ও আন্তর্জাতিক প্রকাশনা রয়েছে।
বিদেশে উচ্চশিক্ষা সম্পন্ন করলেও দেশের টানে তিনি আবার বাংলাদেশে ফিরে আসেন। বর্তমানে তিনি সানন্দে তাঁর নিজের জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা দেশের রোগীদের সেবায় নিয়োজিত করছেন। দেশের নিউরোলজির বর্তমান অবস্থা নিয়ে বলেন, আগের চেয়ে অনেক অগ্রসর হলেও আমাদের দেশে প্রায় ২৫০ জনের মত নিউরোলজিস্ট আছেন, যা ১৭ কোটি মানুষের জন্য অপ্রতুল। আমেরিকাতে এর দ্বিগুণ জনসংখ্যার জন্য নিউরোলজিস্ট আছেন ১৮,০০০ এর মত, যে সংখ্যার মাধ্যমে আমাদের দেশের এই কমতি আরও স্পষ্টভাবে ফুটে ওঠে। কোভিড-১৯ ভাইরাস নিয়ে তিনি জানান, এটি হলো সার্স-২, ইনফ্লুয়েঞ্জা ক্যাটাগরির একটি সুনির্দিষ্ট ভাইরাস, যার কাছাকাছি দুটি ভাইরাস হল সার্স-১ এবং মার্স ভাইরাস যার প্রকোপ মধ্যপ্রাচ্য ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়াতে দেখা গিয়েছে। এটি বেশ সংক্রামক হওয়ার কারণে ইউরোপ ও আমেরিকাতে অনেক লোক হতাহত হয়েছে। আমেরিকার মত দেশে যেখানে উচ্চমৃত্যু হার দেখা গেছে সেখানে বাংলাদেশে আশ্চর্যজনকভাবে মৃত্যুর হার বেশ কম, যা ডাক্তার ও গবেষকদের জন্য কৌতূহলোদ্দীপক। ডা: আলিম আক্তার ভুইয়া মনে করেন, হয়তো পরিবেশ ও আবহাওয়াজনিত কারণে পশ্চিমা বিশ্বের তুলনায় উপমহাদেশে ভাইরাসের সংক্রমন কম দেখা গিয়েছে। পশ্চিমা বিশ্বের ঠান্ডা আবহাওয়া ভাইরাসের সংক্রমণের জন্য অধিকতর উপযোগী। এছাড়াও শুরুর দিকে এ ভাইরাস সম্পর্কে কোনো জ্ঞান না থাকায় প্রয়োজনীয় তথ্য উদ্ধার ও পদক্ষেপ নির্ধারণে অনেক সময় লেগে গিয়েছে বলেও তিনি মনে করেন। আমাদের মতো দেশে যেখানে ঘনবসতি, দুর্বল চিকিৎসা অবকাঠামোর মতো অসংখ্য সমস্যা রয়েছে, সেখানে তুলনামূলক এত কম সংক্রমণ সৃষ্টিকর্তার দয়া হিসেবে দেখছেন তিনি।
ডা: আলিম কাছ থেকে আমরা নিউরোলজির একটি সুন্দর ব্যাখ্যাও পেয়ে যাই। তিনি বলেন, নিউরোলজি মূলত মানুষের মস্তিষ্ক ও মেরুদন্ডসহ সার্বিক স্নায়ুতন্ত্র নিয়ে কাজ করা একটি বিশেষায়িত শাখা। আমাদের শরীরকে নিয়ন্ত্রণ করে মূলত দুটি সিস্টেম- স্নায়ুতন্ত্র বা নার্ভাস সিস্টেম এবং এন্ডোক্রাইন সিস্টেম। আমাদের দৈনন্দিন জীবনের যত কাজ রয়েছে সবই আমাদের মস্তিষ্কের বিভিন্ন অংশ নিয়ন্ত্রণ করছে। এই স্নায়ুতন্ত্রে কোনো সমস্যা দেখা দিলে স্ট্রোকের মতো নানা রোগ শরীরে বাসা বাঁধে। এই ধরনের নানা রোগ আমাদের মস্তিষ্কে বিরূপ প্রভাব ফেলে। এই সকল জটিল বিষয় নিয়েই নিউরোলজি, যার প্রায় ৪০ টির মতো শাখা প্রশাখা রয়েছে ইউএসএ-তে। ডিমেনশিয়া বা স্মৃতিভ্রম এমনই একটি জটিল সমস্যা। ৬০-৬৫ শতাংশ ডিমেনশিয়া রোগীর রোগের মূল কারণ হল আলঝাইমার। এর বাইরেও আরও বেশ কিছু প্রকারের ডিমেনশিয়া রয়েছে। এর মধ্যে কিছু চিকিৎসাযোগ্য, যেমন ভিটামিন বি১২ এর ঘাটতি, থাইরয়েড এর সমস্যা, সিফিলিস ইত্যাদি। ডিমেনশিয়ার ফলে রোগী সাধারণত ৫০-৬০ বছরের পর থেকে ধীরে ধীরে স্মৃতিভ্রষ্ট হতে শুরু করে, তার স্মরণশক্তি হারিয়ে যেতে থাকে, তাদের কথা বলতে এবং বুঝতে সমস্যা হয়, এভাবে আস্তে আস্তে সমস্যার শুরু হয়।
এছাড়াও সারা দুনিয়াতে বর্তমানে ১-২ শতাংশ জনগোষ্ঠীর এপিলেপ্সি বা মৃগীরোগ আছে বলে আমরা জানতে পারি ডা: আলিম আক্তার ভুইয়ার কাছ থেকে। আমেরিকা তে এই সংখ্যা প্রায় ৩৫ লক্ষ। বাংলাদেশে কোনো পরিসংখ্যান না থাকলেও তা প্রায় ২৫-৩০ লক্ষের কাছাকাছি। নিম্নমানের মাতৃকালীন চিকিৎসা, মাথায় আঘাত পাওয়া, দুর্ঘটনা বা সন্ত্রাসের কবলে পড়া, তৃতীয় বিশ্বের এমন নিত্য নৈমিত্তিক ঘটনাগুলোর জন্য উন্নত বিশ্বের চেয়ে এপিলেপ্সির রোগীর সংখ্যা বেশি বলে তাঁর কাছ থেকে জানা যায়। এই রোগে মস্তিষ্কের কোনো অংশে হঠাৎ বজ্রপাতের মতো বৈদ্যুতিক সঞ্চালন ঘটে। প্রায় ৪০ ধরনের এপিলেপ্সি রয়েছে এবং এর মধ্যে ৭০ শতাংশ এপিলেপ্সি ওষুধ বা সাধারণ চিকিৎসা দিয়ে নিয়ন্ত্রণ করা যায়। বাকি ৩০ শতাংশের জন্য বিশেষায়িত চিকিৎসার ব্যবস্থা রয়েছে উন্নত বিশ্বে, কিন্তু বাংলাদেশের মতো দেশে তা বিরল বা নেই বললেই চলে। এছাড়া ব্রেইন টিউমারের মতো সমস্যায় প্রয়োজন অস্ত্রোপচারজনিত চিকিৎসা। এর বাইরে টিউমারের ধরনের উপর নির্ভর করে অনেক সময় রেডিয়েশন থেরাপিও প্রয়োগ করা হয়। এরপর ডা: আলিম এর মতো সুযোগ্য নিউরোসার্জনরা রোগীদের পরবর্তী সুস্থ্যতা নিশ্চিত করার কাজ করেন।
তিনি জানান, গত তিন চার দশকে নিউরোলজির ক্ষেত্রে অভাবনীয় উন্নতি সাধন হয়েছে। বিভিন্ন উচ্চমানের গবেষণার ফলে উন্নত চিকিৎসাপদ্ধতি এবং ক্ষেত্রবিশেষে জেনেটিক চিকিৎসার ব্যবহারও হচ্ছে। আমাদের বাংলাদেশও উন্নত বিশ্বের চেয়ে পিছিয়ে থাকলেও খুব দ্রুতগতিতে চিকিৎসাপদ্ধতির দিক দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। ডা: আলিম মনে করেন গত ১০-১৫ বছরেই আমাদের চিকিৎসাক্ষেত্রে ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে। আমেরিকাতে যেমন চিকিৎসা প্রদান করা হয় তার ৯০-৯৫ শতাংশ বাংলাদেশের হাসপাতালগুলোতে প্রদান করা সম্ভব। নিউরোসায়েন্স হাসপাতালসহ বিভিন্ন হাসপাতালে দক্ষ জনশক্তি তৈরির উদ্দেশ্যে নিয়মিত প্রশিক্ষণ পরিচালিত হচ্ছে। এছাড়া, যে প্রশিক্ষণ এবং পরীক্ষাসমূহ এখানে সম্ভব হচ্ছে না, সেগুলোর জন্য ভারতীয় বিভিন্ন ল্যাবের সাথে নিয়মিত যোগাযোগ বজায় রাখা হচ্ছে বলেও তিনি জানান।
সবশেষে তিনি জানান, তাঁর ইচ্ছা বাংলাদেশে একদল দক্ষ নিউরোলজিস্ট এবং একটি উন্নত চিকিৎসা ব্যবস্থা তৈরি করে দিয়ে যাওয়া। তিনি সেই লক্ষ্য নিয়েই ডাক্তারদের পোস্ট-গ্রাজুয়েট ট্রেনিং এর সাথে নিয়মিত যুক্ত থাকছেন, নিজ হাতে তাদের প্রশিক্ষণ দিচ্ছেন। তিনি চান নিজের অর্জিত জ্ঞান এবং অভিজ্ঞতা পরবর্তী প্রজন্মের হাতে তুলে দিতে, যাতে করে পাশ্চিমা বিশ্ব থেকে শিখে আসা তাঁর জ্ঞান এবং কর্মপদ্ধতি কাজে লাগিয়ে এ দেশের নিউরোলজি উন্নত বিশ্বের সাথে পাল্লা দিতে সক্ষম হয়। তাঁর এই মহৎ উদ্দেশ্য আমাদের দেশের জন্য উত্তরোত্তর কল্যান বয়ে আনুক এই প্রত্যাশা রইল।