১৯৭১ এ যখন দেশ যখন ক্রান্তিলগ্নের সম্মূখীন, তখন এদেশের লক্ষ লক্ষ সূর্যসন্তান ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন দেশকে শত্রুমুক্ত করতে। জাত, শিক্ষা, পেশা নির্বিশেষে দেশমাতৃকার সন্তান হিসেবে যুদ্ধ করে তারা আমাদের জন্য ছিনিয়ে আনেন স্বাধীনতা। তেমনি একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা তাজুল ইমাম। তাজুল ইমাম একজন শিল্পী, চিত্রকর, সঙ্গীতজ্ঞ, গায়ক এবং গীতিকার, যিনি কয়েক দশক ধরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বসবাস করছেন এবং কাজ করছেন। তিনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইনস্টিটিউট থেকে পড়াশোনা করেন এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বিভিন্ন ডিজিটাল আর্ট প্রশিক্ষণ সম্পন্ন করেন। তাজুল ইমাম প্রখ্যাত বাংলাদেশী রক ব্যান্ড ‘সোলস’ এর প্রধান কণ্ঠশিল্পী ও গীতিকার ছিলেন। কবিতা লেখা ও আবৃত্তি করাও তার নেশা। তাজুল গ্রাফিক্স মিডিয়ার সিনিয়র ডিজাইনার এবং শিল্প ও গ্রাফিক্স পরামর্শক। চিত্রশিল্পের ক্ষেত্রে তিনি তেল, অ্যাক্রিলিক, জলরঙ, কালি, পেন্সিল, মিক্স-মিডিয়া এবং ডিজিটাল ইত্যাদি অনেক শিল্প মাধ্যমে দক্ষ। এত দক্ষতা, এত পরিচয় থাকা সত্ত্বেও তার কাছে জীবনের সবচেয়ে বড় অর্জন এবং সফলতা তার এই মুক্তিযোদ্ধা পরিচয়। তিনি বলেন, পরাধীনতার শেকল নিজে অনুভব করেছেন বলেই স্বাধীনতা তার কাছে এবং প্রতিটি বাঙালির কাছে একটি অমূল্য ধন।
মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে তিনি জানান, সেই সময়ে মুক্তিযুদ্ধের পূর্ববর্তী রাজনৈতিক উত্থান-পতনের ব্যাপারে সবাই সচেতন ছিল। তাই তো তখন মাত্র সতেরো বছর বয়সেই তিনি পরিষ্কারভাবে জানতেন এবং বুঝতেন দেশে কী ঘটছে! যখন অস্ত্র বোঝাই এমভি সোয়াত চট্টগ্রাম বন্দরে আসে, তখনই তাঁরা বুঝতে পারেন কাদের বিরুদ্ধে চলবে এই অস্ত্র। নিজেদের সাধ্যমতো তাঁরা প্রতিবাদ করে যান। ২৫ মার্চের ভয়াল রাতে তিনি সপরিবারে চট্টগ্রামের পোর্ট কলোনিতে ছিলেন। সেখানে আক্রমণকারী পাকিস্তানি বাহিনী ও প্রতিরোধকারী স্বল্প সংগঠিত বাঙালী সেনাবাহিনী এবং ইপিআরের গোলাগুলির মাঝে পড়ে যান তাঁরা। সেখান থেকে তার বাবা পরদিনই পুরো পরিবারকে সরিয়ে আনেন এবং দীর্ঘ পথ অতিক্রম করে ভারতীয় সীমান্ত পার হয়ে তাঁরা ভারতের মনুতে পৌঁছান। সেখান থেকেই আরও ১৭ কিলোমিটার দূরে হরিণা রিক্রুটিং ক্যাম্পে যুদ্ধের জন্য তাকে রিক্রুট করা হয় এবং ২০ দিন পর বগাফা ট্রেনিং সেন্টারে পাঠিয়ে দেয়া হয়। সেখানে ২১ দিন ধরে তিনি হালকা অস্ত্র যেমন, স্টেনগান, গ্রেনেড, থ্রি নট থ্রি, রকেট লঞ্চার ইত্যাদির ট্রেনিং নেন। সময়ের প্রয়োজনে সেদিনের সেই কিশোর অতি অল্প সময়ে মানসিকভাবে এক দায়িত্বশীল পুরুষে রুপান্তরিত হয়েছিল। ট্রেনিং শেষে অপারেশনের জন্য পার্বত্য চট্টগ্রামের ভেতর দিয়ে পাহাড়ি পথ পেরিয়ে ফটিকছড়ি দিয়ে তাঁরা হাটহাজারী এসে পৌঁছান। সেখানে বদিউল নামের এক সহযোদ্ধার বাড়িতে অস্ত্র লুকিয়ে রেখে অপারেশনের প্রস্তুতি নিতেন তাঁরা। নুরুল বর্ষণ নামে তার প্লাটুনেরই একজন দক্ষ যোদ্ধা মুক্তিযোদ্ধাদের থাকা খাওয়া তথা সার্বিক তত্ত্বাবধানের দায়িত্বে ছিলেন। আর তাজুল ইমামের দায়িত্ব ছিল অপারেশন পরিকল্পনা এবং বাস্তবায়ন। যুদ্ধের সেই সময়ে তাদের অনুপ্রেরণা দিয়ে গেছে বিভিন্ন গান, বিভিন্ন মানুষ এবং নানা স্মৃতি। বঙ্গবন্ধু তখন দেশের মানুষের এক প্রধান অনুপ্রেরণার নাম, যুদ্ধের এক মূল চালিকাশক্তি। নিজস্ব অভিজ্ঞতা থেকে তাজুল ইমাম বলেন, বঙ্গবন্ধু মানুষের হৃদয়ের অতি গভীরে তার জায়গা করে নিতে পেরেছিলেন। সে জন্যেই তো যে জাতির দীর্ঘদিনের ইতিহাস ছিল বৈদেশিক শাসনের ইতিহাস, সেই জাতিই ভেতরের জমাটবাধা ক্রোধকে আশ্রয় করে বিক্রমের সাথে শত্রুর মোকাবিলা করেছে।
তাজুল ইমাম মনে করেন, মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে তার দ্বিতীয় জন্ম হয়েছে। যুদ্ধ শুরুর আগে তিনি একজন কিশোরমাত্র, লুকিয়ে বই পড়া, ছোটখাটো গল্প কবিতা লেখার মাঝে যার জীবন সীমাবদ্ধ। সেই কিশোর কোনো ভয়াবহতা না বুঝেই মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপ দিয়েছিল। সে জন্যেই আজ আমাদের স্বাধীনতা দিবস কিংবা বিজয় দিবসের মতো দিনে আনন্দের পাশাপাশি বেদনার এক করুণ সুরও তার হৃদয়ে বেজে ওঠে। তার মতো যারা মায়ের জন্য চিঠি লিখে রেখে ঘর ছেড়েছিল দেশকে মুক্ত করতে, তাদের কতজনই আর ঘরে ফিরে আসে নি। কত বন্ধুর সাথে আর কোনোদিন দেখা হয় নি, কতজন কত আজানা জায়গায় চিরনিদ্রায় শায়িত, এই স্মৃতিগুলোয় বারবার তার মানসপটে ভেসে ওঠে। যুদ্ধের পর এক দীর্ঘসময় ধরে তিনি যুদ্ধপরবর্তী মানসিক আঘাত বয়ে বেড়িয়েছেন। তারপর তাকে পলিটেকনিক কলেজে ভর্তি করিয়ে দেয়া হয়। সেখানে মন না বসায় পরবর্তীতে বড় ভাইয়ের উৎসাহে চট্টগ্রাম চারুকলা কলেজে ভর্তি হন। এখানে পড়ার সময়ই গানের সঙ্গেও ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে যান, যোগ দেন জনপ্রিয় ব্যান্ড ‘সোলস’ এ। একা চট্টগ্রাম শহরে থেকে গান এবং চিত্রকলা একসাথে চর্চা করতে গিয়ে তিনি শারীরিকভাবে প্রচন্ডভাবে ভেঙ্গে পড়েন। সে সময় নিজের বন্ধুবান্ধব এমনকি শিক্ষকরা স্নেহ ও যত্নে তাকে সারিয়ে তোলেন। তার জন্য বন্ধুর মায়েরা নিজ হাতে খাবার রান্না করে পাঠাতেন। তিনি বলেন, আজন্ম এই সকল স্নেহডোরে তিনি বাঁধা থাকবেন।
যখন সোলস এর সঙ্গে তার যাত্রা শুরু হয়, তখন সদ্য স্বাধীন দেশে তাঁরা ভিন্ন কিছু করার চেষ্টা করে যাচ্ছিলেন। ওয়েস্টার্ন ঘরানার সংগীত তখন বাংলাদেশে নতুন। নিজে বাউল শিল্পী হিসেবে তাজুল ইমাম এবং তার ব্যান্ড দেশীয় বাউল সংগীতের সাথে এই পাশ্চাত্য সংগীত এর এক মিশ্রণ ঘটানোর চেষ্টা করেছেন। তাজুল ইমাম জানান, নিজে সিলেটের বিভিন্ন এলাকায় ঘুরে ঘুরে গ্রাম-লোকালয় থেকে বাউল গান সংগ্রহ করেছেন। তারপর সেগুলো নিয়ে পাশ্চাত্যধর্মী সংগীতের সাথে কাজ করেছেন। সেই সকল কাজ তখনকার দর্শক এবং শ্রোতারা লুফে নিয়েছিলেন। সোলস এর তখন ঘরে ঘর পরিচিতি। কিন্তু শীঘ্রই তাদের মনে হল, উচ্চারণ, স্পন্দনসহ বিভিন্ন ব্যান্ডের নিজস্ব গান থাকলেও তাদের নিজেদের কোনো গান নেই। এমনকি সেসময় তাদের পছন্দের সাথে যায় এমন গীতিকারও তাঁরা খুঁজে পাচ্ছিলেন না। ঠিক তখনই ব্যান্ডের বন্ধুদের একপ্রকার জোরাজুরিতেই তাজুল ইমাম গান লেখা শুরু করেন। ‘খুঁজি যাহারে’সহ তার লেখা অনেক গান দীর্ঘ ৪৮ বছর পরও ‘সোলস’ এর নানা আয়োজনে আমরা শুনতে পাই।
সঙ্গীতশিল্পী তাজুল ইমামের পাশাপাশি চিত্রশিল্পী তাজুল ইমামও স্বীয় প্রতিভায় সমুজ্জ্বল। যুদ্ধ পরবর্তী সময়ে চিত্রশিল্প তাকে যুদ্ধের বিভীষিকা কাটিয়ে উঠতে সাহায্য করেছে, থেরাপির মত কাজ করেছে। তারপর থেকেই চিত্রশিল্পের সাথে এক নিবিড় বন্ধনে জড়িয়ে গেছেন তিনি। প্রথম যখন বিদেশে যান তখন নানা ধরনের চাকরি করেছেন। তারপর টেক্সাসের এক আর্কিটেকচারাল গ্রাফিক্স কোম্পানিতে চাকরি নেন। ১৯৯০ এর দিকে আরও কিছু কোম্পানিতে ঘুরে তিনি যোগ দেন হিউস্টনের এক কম্পিউটার কোম্পানিতে। সেখান থেকেই কম্পিউটারের বিভিন্ন কার্যকারিতা তিনি শিখতে থাকেন, তুলির কাজ যে সহজেই কম্পিউটার দিয়ে করা যায় তা বুঝতে পারেন। তারপর তিনি নাসাতে ইন্টারফেস ডিজাইনার হিসেবে যোগদান করেন। এই কাজে যথেষ্ট সুখ্যাতি অর্জন করা সত্ত্বেও তিনি সন্তুষ্ট হতে পারেন নি। তার ছবি আঁকার দক্ষতা লাইফসাইন্স প্রজেক্টের প্রধানের নজর কাড়ে। তার উৎসাহে তাজুল ইমাম লাইফসাইন্স প্রজেক্টের বারান্দায় এক বিরাট ম্যুরাল আঁকেন, যার খ্যাতির কারনে সেটি স্থায়ী প্রদর্শনীতে জায়গা করে নেয়। নিউ ইয়র্কে গ্রাফিক্স ডিজাইনার হিসেবে প্রভূত খ্যাতি এবং অর্থ উপার্জন করার পর আবার তার দেশে ফিরে যাবার ইচ্ছা হয়। সেই ইচ্ছা নিয়েই ২০০৬-০৭ এর সময়ে দেশে ফিরেছিলেন। কিন্তু আক্ষেপ করে বলেন, ২৫-৩০ বছরের মধ্যে একটি দেশের সমাজ, মূল্যবোধ, সংস্কৃতি সব কিছুতেই ব্যাপক পরিবর্তন আসে। চারিদিকের অপরিচিত চেহারার ভীড়ে দেশকে চিনতে না পেরে আবার বিদেশে পাড়ি জমান।
তাজুল ইমাম নিজের ক্ষোভ, দুঃখ, বিষাদ থেকে সাম্প্রদায়িকতা এবং সাম্প্রদায়িক সহিংসতা নিয়ে বহু ছবি এঁকেছেন। এমন একটি বাংলাদেশের প্রার্থনাই তিনি করেন, যেখানে সকল ধর্ম, বর্ণ ও জাতের মানুষ এক ভ্রাতৃত্ববোধের অনুভূতি নিয়ে বাস করবে। নিজের ব্যক্তিজীবন নিয়ে তিনি বলেন, তার এই ছন্নছাড়া জীবনে যে মানুষটি শৃঙ্খলা আনতে সচেষ্ট, তিনি তার স্ত্রী। এমনকি তার ছবি আঁকার জন্য আলাদা একটি স্টুডিও তৈরি করে দিয়েছেন তিনি, যেখানে নিশ্চিন্তে শিল্পসৃষ্টিতে মনোনিবেশ করতে পারেন তাজুল ইমাম। তার কন্যাও নিয়মিত বাবার স্বাস্থ্যের এবং শিল্পের খোঁজ নেন। এসব কারণে নিজের স্ত্রী এবং কন্যার প্রতি তিনি অত্যন্ত কৃতজ্ঞ। বর্তমানে তিনি কোলাজের মাধ্যমে শিল্পকর্ম তৈরি করছেন। তিনি মনে করেন, পাথর মানবজীবনের একটী বড় অনুষঙ্গ। সেই প্রাগৈতিহাসিক যুগ থেকে ইতিহাস, শিল্প, ধর্ম সকল ক্ষেত্রে পাথরের একটি বিরাট উপস্থিতি মানবসভ্যতায় প্রতীয়মান। তাই পাথর নিয়ে, ফেলে দেয়া কাগজের ব্যাগ নিয়ে তিনি বর্তমানে কাজ করছেন। এর বাইরেও তিনি মন্টেসরি এডুকেশনাল ম্যাটেরিয়ালের জন্য বই এর অঙ্কনের কাজ করছেন। এই সূত্র ধরেই ইসলামের ইতিহাস, নবী (সঃ) এর জীবনের ইতিহাস, খালিফায়ে রাশেদীন এবং অন্যান্য নবীদের ইতিহাসের চিত্র বর্ণনা তৈরি করছেন। তাজুল ইমাম পাশ্চাত্যের শিল্পী এবং শিল্প বিপ্লবের ইতিহাস নিয়ে সময়কাল রচনা করেছেন এবং বই লিখেছেন। এছাড়াও মানুষের যোগাযোগব্যবস্থার পরিবর্তন থেকে শুরু করে মুসলিম বিজ্ঞানীদের নানা আবিষ্কার নিয়েও তিনি বই লিখেছেন। এই সময়েও এসেও তাই তাজুল ইমাম অত্যন্ত কর্মব্যস্ত একজন শিল্পী। নিজের কাজের মধ্য দিয়েই তিনি কোনো এক অসম্ভবকে, প্রয়াত শ্রদ্ধেয় হুমায়ুন আহমেদের ভাষায় যাকে বলে জোছনার ফুল, সেই ফুলকে ছুঁয়ে দেখতে চান। আমাদের বিশ্বাস, তার শিল্প, তার কর্ম তাকে সেই অসম্ভবের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে দেবে।
লিখেছেন – রোমান উদ্দিন