অভিনেত্রী মনিরা মিঠু। উৎসব হোক আর না হোক টিভি পর্দা, ইউটিউব ও ওটিটিতে উজ্জল উপস্থিতি থাকে তার। মা কিংবা ভাবিদের চরিত্রে নির্মাতাদের ভরসার জায়গার মনিরা মিঠু থাকেন তালিকার শীর্ষে।হুমায়ূন আহমেদ পরিচালিত টেলিভিশন নাটক “অপেনটি বায়োস্কোপ” দিয়ে মনিরা মিঠুর অভিনয় জীবনের শুরু ।হুমায়ূন আহমেদ পরিচালিত এ নাটকে জাহিদ হাসানের বিপরীতে অভিনয়ের মাধ্যমে মনিরা মিঠু যাত্রা শুরু করেন। এর পর হুমায়ূন আহমেদ পরিচালিত বেশিরভাগ নাটকেই অভিনয় করেছেন। হুমায়ূন আহমেদের পরিচালনায় নীল তোয়ালে তার প্রথম ধারাবাহিক নাটক। চন্দ্রকথা চলচ্চিত্রে অভিনয়ের মধ্য দিয়ে তার চলচ্চিত্রে অভিষেক ঘটে। পরবর্তীকালে তিনি আমার আছে জল, গহীনে শব্দ, জোনাকির আলো, পোড়ামন, দহন, বিশ্বসুন্দরী প্রভৃতি চরিত্রে অভিনয় করে তার দক্ষতার পরিচয় দেন।সেই থেকে এখন পর্যন্ত বিভিন্ন চরিত্রে অভিনয় করে তুমুল দর্শকপ্রিয়তা পেয়েছেন। তিনি ২০০৮ সালে এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে নাকো তুমি নাটকে অভিনয়ের মাধ্যমে মেরিল-প্রথম আলো পুরস্কারের সমালোচক শাখায় সেরা টেলিভিশন অভিনেত্রী বিভাগে পুরস্কার অর্জন করেন।
মনিরা মিঠুর করা জনপ্রিয় ধারাবাহিক ফ্যামিলি ক্রাইসিসের গুরুত্বপূর্ণ এবং দর্শকপ্রিয় চরিত্র শেফালি খালার মৃত্যু ছুয়ে যায় সব দর্শকের অন্তর। মনিরা মিঠুর কাছে এই ভালোবাসা ভাষায় প্রকাশ করার মতন না। যেদিন ফ্যামিলি ক্রাইসিসের শেষ পর্ব প্রচারিত হয় সেদিন তিনি একটি নাটকের শ্যুটিং এ নেটওয়ার্ক এর বাইরে ছিলেন। শ্যুটিং শেষে ফেরার পথে তিমি অজস্রে ফোন পেতে থাকেন। সেই নাটকের প্রোডাকশন হাউসের মালিকের কান্না তাকে আপ্লুত করে তোলে। মনিরা মিঠু বলেন, তিনি নাকি বাস্তবতা আর অভিনয় গুলিয়ে ফেলেছিলেন। অপরিচিত নাম্বারের ফোন, দর্শকের কান্না এবং ভালবাসা সব কিছুরই সাক্ষী হন মনিরা মিঠু এই চরিত্রের কল্যাণে।
মনিরা মিঠুর অভিনয়ে আসা হুমায়ুন আহমেদের হাত ধরে৷ ওপেনটি বায়োস্কোপ নাটকের একটি চরিত্রের জন্য হুমায়ুন আহমেদ নতুন মুখ খুঁজছিলেন। এই নতুন মুখ সন্ধানের দায়িত্ব পরে মিঠুর বড় ভাই চ্যালেঞ্জারের উপর। লাজুক মিঠুর কথা তিনিই প্রথম হুমায়ুন আহমেদকে বলেন৷ সেই থেকে শুরু, এরপর থেকেই নিয়মিত কাজ করে চলছেন তিনি। নাটকের পাশাপাশি চলচ্চিত্রে অভিনয়ের জন্য অনেক প্রস্তাব পান মিঠু। তবে আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে চরিত্রাভিনেত্রীরা অনেক সময় অসম্মানজনক পারিশ্রমিক পান। সে কারণে অনেক সময় চলচ্চিত্রে অভিনয় করা হয়ে ওঠে না তার।
মাত্র ৯ মাস বয়সে মাকে হারান মনিরা মিঠু। তার বেড়ে ওঠা তার দাদি এবং ফুফুর কাছে। সে কারণে মিঠু বয়স্ক চরিত্রে অভিনয়ে বেশি স্বাচ্ছন্দ বোধ করেন বলে জানান। এ কারণেই এত অল্প বয়সেই তিনি একজন দর্শকপ্রিয় চরিত্রাভিনেত্রী হয়ে উঠতে পেরেছেন । তার কাছে এই চরিত্রগুলো অনেক বেশি মজাদার ও গুরুত্বপূর্ণ। তিনি সৃষ্টিকর্তার কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন মূল চরিত্র দিয়ে তার অভিনয় জীবন শুরু না হওয়ার জন্য। তার মতে, এমন কিছু হলে তিনি আজকের জনপ্রিয়তা কখনোই হয়ত পেতেন না।
ফ্যামিলি ক্রাইসিস নাটকে পরিচালক মোস্তফা কামাল রাজ অভিনেত্রী মনিরা মিঠুকে সর্বোচ্চ স্বাধীনতা দিয়েছিলেন। যার কারণেই শেফালী খালা চরিত্রটি এত সাবলীলভাবে ফুটিয়ে তুলতে পেরেছিলেন মিঠু। চরিত্রটি নেতিবাচক হওয়ায় শুরুতে অভিনয় করতে কিছুটা দোটানায় ছিলেন। তবে শেষ পর্যন্ত রাজি হন এবং নাটকের সেট থেকে ভাল লাগার শুরু হয় আর শেষ পর্যন্ত চরিত্রটি হয় তুমুল দর্শকপ্রিয়।
পূর্বে দেখা গেছে ডলি জহুর তার করা নীলু ভাবি চরত্রের কারণে জনপ্রিয়তা পেলেও এরপর আর কখনোই সেই চরিত্রটি থেকে বের হতে পারেননি। মনিরা মিঠুর ক্ষেত্রে তিনিও এমন কিছু আশংকা করেন কি না এ বিষয়ে মিঠুর অভিমত হল, ভয় কিছুটা থাকলেও তিনি তার কাজগুলো নিয়ে আশাবাদী। তিনি একই সাথে দর্শকপ্রিয় দুটি ধারাবাহিক ফ্যামিলি ক্রাইসিসে শেফালী খালা এবং ব্যাচেলর পয়েন্ট এ শিরিন চরিত্রে অভিনয় করেন। দুটো চরিত্রই দর্শকপ্রিয়তা পায় যদিও চরিত্রগুলো ছিল সম্পূর্ণ বিপরীত। এছাড়াও মোস্তফা কামাল রাজের রোমিও জুলিয়েট নাটকে তিনি শিক্ষিকার ভূমিকায় অভিনয় করেছেন। এরপর অ্যাওয়ার্ড বা মানিমেশিন এরপর নাটকগুলো পর পর করেছেন। নাটকগুলোতে তার চরিত্রগুলর মধ্যে কোনোপ্রকার মিল ছিল না। এ থেকে মিঠুর বিশ্বাস তিনি নির্দিষ্ট কোনো একটি চরিত্রে হারিয়ে যাবেন না।
প্রয়াত নাজমা আনোয়ার, ফেরদৌসী মজুমদার, শমী কায়সার, বিপাশা হায়াত বা হালের জাকিয়া বারী মম, রুনা খান, সাবিলা নূর এবং মেহজাবিন চৌধুরী অভিনেত্রী হিসেবে ভীষণ প্রিয় মনিরা মিঠুর। আর অভিনেতাদের মাঝে হুমায়ুন ফরিদী, আসাদুজ্জামান নূর, আলী জাকের, আবুল খায়ের, জাহিদ হাসান এবং এখনকার মোশাররফ করিম, চঞ্চল চৌধুরী, শতাব্দী ওয়াদুদ, অপূর্ব বা আফরান নিশো তার পছন্দের৷
টেলিভিশন নাটক বা সিনেমার বাইরে ওটিটি প্ল্যাটফর্ম এখন জনপ্রিয়তার শীর্ষে। তবে অভিযোগ আছে যে পরিচিত কিছু মুখের বাইরে অন্যদের খুব একটা সুযোগ দেওয়া হয় না ওটিটি প্ল্যাটফর্ম গুলোয়। মনিরা মিঠু নিজেও এ ব্যাপারটিকে আংশিক সত্য মনে করেন৷ শতাব্দী ওয়াদুদ, মোশাররফ করিম, চঞ্চল চৌধুরী, শ্যামল মওলা, অপূর্ব, মেহজাবিন বা নিশোর মত অভিনেতারা এখানে বেশি গুরুত্ব পান। তবে তারা নিজেদের চেষ্টায় এবং দক্ষতায় এই অবস্থানে আসতে পেরেছেন। এছাড়া নতুনরাও সুযোগ পাচ্ছেন এবং সাধ্যমত নিজেদের মেলে ধরছেন বলেই তার বিশ্বাস।
অভিনয় জীবনে মনিরা মিঠুর অন্যতম স্মরণীয় ঘটনা ঘটে হুমায়ুন আহমেদের বৃক্ষমানব নাটকের সেটে। সে সময়ে মনিরা মিঠুর শ্যুটিং বা অভিনয় নিয়ে তেমন কোনো অভিজ্ঞতা ছিল না । নাটকের একটি দৃশ্যে তার অভিনয় দেখে স্বয়ং হুমায়ুন আহমেদ চোখের পানি ফেলেন। এই ঘটনাটি মিঠুর জীবনের স্মরণীয় ঘটনাগুলোর একটি। এছাড়াও সাপ নিয়ে অভিনয় বা অনেক উঁচু থেকে গড়িয়ে পুকুরে পরে যাওয়ার মত ঘটনাগুলোও তার কাছে স্মরনীয়।
জীবন নিয়ে খুব বেশি স্বপ্ন তিনি দেখেন না। তিনি আদতে একজন স্বপ্নহীন ছন্নছাড়া গোছের মানুষ। তবে তার একান্ত বাসনা তিনি যেন সুস্থ থেকে চিরবিদায় নিতে পারেন। আর তার বিদায়ের পর দুই সন্তানের যেন কখনো অভাব না হয় এটিই তার স্বপ্ন। চরিত্রগুলোর জন্য অনেক ত্যাগ শিকার করলেও যখন দর্শকদের ভালবাসা অর্জন করতে পারেন তখন সব ত্যাগ বা সংগ্রাম ভুলে নতুন কাজের আগ্রহ জন্মায় মিঠুর।