মানবতার সবচেয়ে বড় পরিচয় পাওয়া গিয়েছে করোনা মহামারীতে। সেই সময় জাত-পাত ভুলে গিয়ে সবাই সবাইকে সাহায্য করেছেন। শুরুর দিকে করোনা আমাদের কাছে ছিলো এক আতঙ্কের নাম। কারোর করোনা হওয়া মানেই সে প্রায় নিশ্চিত মৃত্যু ধরে নেওয়ার মতো অবস্থায় ছিলো। এমন সংকটে কিছু মানুষ একদম সরাসরি মানবতার সেবায় নিয়োজিত ছিলেন। তারা হলেন ডাক্তার পেশাজীবী সম্প্রদায়। ডাক্তাররা নিজের জীবনের মায়া ত্যাগ করে, পরিবারের থেকে দূরে থেকে করোনা রোগীদের চিকিৎসা সেবা দিয়েছেন। এতে করে অনেকে যেমন প্রাণ হারিয়েছেন, অনেকে মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে এসেছেন। আজকে কথা বলছিলাম এমনই একজন মানবতার সেবকের সাথে যিনি করোনার সময় আমেরিকার সাধারণ মানুষদের জন্য সম্মুখ যোদ্ধা হয়ে কাজ করেছিলেন। শুধু তাই নয়, নিজেও পাঞ্জা লড়ে জয়ী হয়েছেন করোনা যুদ্ধে। তিনি হলেন ডা. মাসুদ বকশ।
ডা. বকশের কাছে জানতে চেয়েছিলাম করোনায় ডিউটি করার অনুভূতি কেমন ছিলো? এর উত্তরে তিনি বলেন, ২০২০ সালের জানুয়ারি/ফেব্রুয়ারি হবে, তখনও করোনা এতটা ভয়াবহ রূপ লাভ করেনি। তারা ভেবেছিলেন করোনা এতদূর ছড়াবে না কিন্তু হুট করে একদিন এক ট্রাভেলার আসে প্রচন্ড জ্বর নিয়ে। ট্রাভেলার একটা স্টেট থেকে ট্রাভেল করে তাদের স্টেটে ইমার্জেন্সি ডাক্তার দেখাতে যায় কারন তার কাঁপুনি দিয়ে জ্বর ছিলো। তখন টেস্ট করারও উপায় ছিলো না কিন্তু ট্রাভেলার কে যখন এক্সরে করানো হলো তখন এক্সরে রিপোর্ট দেখে অনুমান করলেন ট্রাভেলার করোনায় আক্রান্ত আর এটাই তাদের প্রথম রোগী”। প্রচন্ড ভয় নিয়ে ডিউটি শুরু করেন বলে জানান তিনি।
তার নিজের উপসর্গ কখন দেখা দিয়েছে এই প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে তিনি বলেন, “একদিন ডিউটি করে বাসায় গিয়ে যখন ঘুমাচ্ছিলেন তখন প্রচন্ড কাশিতে তার ঘুম ভেঙ্গে যায়। তার অন্য কোন উপসর্গ ছিলো না তবে কাশির ধরণ দেখে তিনি আন্দাজ করেন কিছু একটা হয়েছে। পরদিন তার ডিউটি ছিল। ডিউটিরত মেডিকেল অফিসারকে কল দিয়ে তিনি বলেন যে তার মনে হচ্ছে ডিউটিতে যাওয়া উচিত হবে না, আগে টেস্ট করানো উচিত। তখন তার একজন কলিগ তাকে টেস্ট করানোর ব্যবস্থা করে দেন। কিছুক্ষণ পর তার হস্পিটালের সিইও তাকে কল দিয়ে বলেন যে তিনি কোভিড পজেটিভ। তবে তিনি আরও জানান, করোনার সময় তার কাশি ছাড়া অন্য কোন উপসর্গ ছিলো না। তাই স্ত্রীকে বলছিলেন, করোনা যদি এমন হয় তাহলে তো ভয় পাবার কিছু নেই। কিন্তু, ৪/৫ দিন পর তার শরীরের অবস্থা ক্রমাগত খারাপ হতে থাকে। একপর্যায়ে তিনি কোমায় চলে যান।
তিনি লাইফ সাপোর্ট এ যাওয়ার আগের ঘটনাগুলো সম্পর্কে তিনি জানান ,আস্তে আস্তে যখন তার শরীর খারাপ হতে থাকে তখন তার স্ত্রীও জ্বরে আক্রান্ত হন। পরবর্তীতে পরীক্ষা করে দেখা গেলো তার স্ত্রীও করোনা পজেটিভ। ধীরে ধীরে তার অক্সিজেন লেভেল কমতে থাকে। পরবর্তীতে তিনি নিজেই এম্বুলেন্স ডেকে হাসপাতালে যান। কেননা, তিনি ও তার স্ত্রী একাই থাকতেন। কর্মস্থলের কারনে মেয়েরা বাইরে থাকতেন। তখন হাসপাতালে যাওয়ার পর সেখানকার ডাক্তাররা তার অবস্থা দেখে একটা চিকিৎসা দেন যেটা রেকমেন্ডেট ছিলো না। কেননা এতে যে বা যারা চিকিৎসা দিবে তাদেরও আক্রান্ত হবার সম্ভাবনা থাকে। তবুও তারা তার ক্ষেত্রে এই চিকিৎসাটা প্রয়োগ করেন। এরপর তার আর কোন স্মৃতি তার মনে নেই বলে জানান তিনি। তিনি তখন কোমায় ছিলেন।
তবে তিনি জ্ঞান ফেরার পর যা যা শুনেছেন সেগুলো আমাদের সাথে বলেছেন। তিনি বলেন, তিনি যখন কোমায় ছিলেন তখন তার মেয়েরা অনেক কষ্ট করেছে। বিশেষ করে করোনার সময় কোভিড সারভাইভারদের কাছ থেকে অনেক কষ্ট করে প্লাজমার ব্যবস্থা করেছেন তার ডাক্তার মেয়ে। তিনি আরও বলেন, তার অসুখের সময় একটা মেডিসিন নিয়ে ডাক্তারদের হয় কেননা ৫৫ বছর বয়সের বেশি মানুষের ক্ষেত্রে মেডিসিন কাজ করে না বরং ইমিউন সিস্টেমকে আরও দুর্বল করে দেয়। এছাড়াও তাকে একমো মেশিনে দেওয়া হবে কি হবে না এটা নিয়েও প্রচন্ড বিতর্ক হয়। এক পর্যায়ে তার মেয়ে রীতিমত যুদ্ধ করে তাকে একমো মেশিনে দেয়। মেশিনে দেওয়ার ৭/৮ দিন পর ভেন্টিলেটর থেকে তাকে বের করা হয়। তখনও তার জ্ঞান ছিলো না বলে জানান তিনি। তারপর ধীরে ধীরে জ্ঞান ফিরে তার।
ডা. বকশের কাছে জানতে চেয়েছিলাম, করোনায় তো অনেকেরই মানসিক কিছু সমস্যা দেখা গিয়েছিল পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া হিসেবে। তারও মানসিক সমস্যা হয়েছিলো কি না এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, উনার শারীরিক অনেক সমস্যা হয়েছিলো। যেমন- উনার হাতের আঙ্গুল বেঁকে গিয়েছিলো। হাত দিয়ে কোন কাজ করতে পারতেন না – লিখতে পারতেন না, টাইপ করতে পারতেন না। তবে সেই সাথে তিনি জানান, মানসিক দিক দিয়ে তার অবিশ্বাস্য এক পরিবর্তন হয়েছে। তিনি একজন নাস্তিক মানুষ ছিলেন। কিন্তু তিনি যখন কোমায় ছিলেন তিনি প্রার্থনার আওয়াজ শুনতে পান। তিনি পুরুষের গলায় প্রার্থনার ধ্ধনি শুনতে পেতেন। তিনি মন্দিদের ঘন্টাও শুনতে পেতেন এমনকি তিনি খ্রিষ্টের কাছেও মাফ চাইতেন। জ্ঞান ফেরার পর তিনি শুনতে পান, তার পরিবার-পরিজন ও আত্মীয়স্বজন সকলে তার জন্য প্রার্থনার ব্যবস্থা করতেন। তবে তিনি এখনও জানেন না তিনি প্রার্থনা কেন শুনতেন। তবে বর্তমানে তিনি নিজেকে বিশ্বাসী বলে দাবী করেন। মানসিক পরিবর্তনের কথা বলতে গিয়ে তিনি আরও বলেন, তার মানসিক কোন পরিবর্তন হয়নি তবে তার স্ত্রী মনে করেন তার ধৈর্য কমে গিয়েছে। তিনি তার মানসিক অবস্থার কথা বর্ণনা দিতে গিয়ে তার পরিবারের সদস্যদের কথা বিশেষভাবে বলেন। তিনি জানান, তার পরিবার এখনো তাকে নিয়ে আশংকায় থাকেন। সুস্থ হয়ে বাড়ি ফেরার প্রথম দিকে তার স্ত্রী অনেক ভয় পেতেন। তিনি ভাবতেন উনি বেশিদিন বাঁচবেন না। তিনি আরও মনে করেন, হাসপাতাল থেকে তিনি যেমন সেবা পেয়েছেন এমন সেবা হয়তো তিনি এখনও পর্যন্ত কাউকে দিতে পারেন নি।
ডা. মাসুদ বকশ বর্তমানে মেডিসিন ও রিজেনারেটেড মেডিসিন নিয়ে কাজ করছেন। তিনি মনে করেন, মানুষেরর সুস্থ জীবন যাপনে ফাংশনাল মেডিসিন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। তিনি জানান, তার এই প্র্যাক্টিসে অল্প কিছু রোগী রয়েছেন তবে তারা সবাই অনেক সন্তুষ্ট এমং সুস্থ জীবনযাপন করছেন।
মানুষের কাছে তার একটাই প্রত্যাশা – সকলেই সুখী এবং সুস্থ থাকার চর্চা করুক। তিনি মনে করেন, যদি মানুষ সুস্থ থাকার জন্য জীবনযাত্রাকে পরিবর্তন করে তাহলেই তিনি তার কাজের মাঝে স্মরণীয় হয়ে থাকবেন। তিনি মৃত্যুর পর এভাবেই তার কাজের মাধ্যমে মানুষের মাঝে বেঁচে থাকতে চান।
লিখেছেন – রোমান উদ্দিন