বাংলাদেশের রাজনীতি এবং গণমাধ্যমে এক সুপরিচিত মুখ হলেন মাহমুদুর রহমান মান্না। ছাত্রজীবন থেকে তিনি সমাজ পরিবর্তনের মনন নিয়ে রাজনীতির সাথে যুক্ত। ১৯৬৮ সালে তিনি ছাত্রলীগ এর আহ্বায়ক নির্বাচিত হন এবং চাকসুর জিএস নির্বাচিত হন ১৯৭২ সালে। ১৯৭৩ সালে জাসদ ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক এবং ১৯৭৬ সালে জাসদ ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সভাপতি হিসেবে নির্বাচিত হন। ১৯৭৯ সালে ঢাকায় এসে ডাকসুর ভিপি নির্বাচিত হন তিনি। পরবর্তীতে, ১৯৮০ সালে তিনি বাংলাদেশ সমাজতান্ত্রিক দল বাসদ গঠন করেন। ১৯৮৩ সাল থেকে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত এরশাদ বিরোধী আন্দোলনে তিনি সক্রিয় হয়ে পড়েন। এরপর ১৯৯১ সালে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ এ যোগ দিয়ে ২০০৭ সালে আলোচিত এক এগারো সরকারের সময় বাংলাদেশে আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ২০০৯ সালে সংস্কারধর্মী মনোভাবের কারণে বাংলাদেশে আওয়ামী লীগের পদ থেকে বাদ পড়ে যান। তখন তিনি নাগরিক ঐক্য নামের রাজনৈতিক দল গঠন করেন। বর্তমানে তিনি এই দলের সভাপতি হিসেবে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়ে যাচ্ছেন। তিনি জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন পূর্বক জাতীয় সংসদ নির্বাচনেও অংশ গ্রহণ করেছিলেন। কবিতার সাথে আলাপচারিতায় তিনি তার অতীত ও বর্তমানের রাজনীতি, দেশের সামাজিক এবং রাজনৈতিক পরস্থিতি নিয়ে নানা বিশ্লেষণধর্মী বিষয় নিয়ে কথা বলেছেন।
তিনি জানান, দীর্ঘ একটা সময় ধরে তিনি এবং অন্যান্য বিরোধীদলগুলো একটি সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য লড়াই করে যাচ্ছেন। ২০১৪ এ সকল বিরোধী দলকে বাইরে রেখে নির্বাচন হয়েছে, ২০১৮ তেও নির্বাচনের নামে হয়েছে প্রহসন, তাই এখন দেশের জনগণ তাদের ভোটাধিকার তথা একটি সার্বিক গণতান্ত্রিক পরিস্থিতি কামনা করেন বলে তিনি মন্তব্য করেন। এছাড়া ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের বিরাট বিস্তৃতি, দেশের স্বাধীনতার সাথে তাদের সম্পর্ক স্মরণ করে তিনি বলেন, বিগত ১০-১২ বছরে এই দল তাদের রাজনৈতিক চরিত্র হারিয়ে ফেলেছে, মানুষের কাছে তাদের গ্রহণযোগ্যতা হারিয়ে ফেলেছে। তাই মাহমুদুর রহমান মনে করেন, বিরোধীদল হিসেবে ক্ষমতার লড়াইয়ে হেরে গেলেও রাজনীতির মাঠে সরকারের সকল অপকর্ম মানুষের সামনে তুলে ধরতে পেরে তারা বিজয়ী হয়েছেন। এখন তীব্র আন্দোলন ছাড়া দেশে সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয় বলে মনে করেন তিনি।
বিরোধীদলীয় দৃষ্টিভঙ্গি থেকে মাহমুদুর রহমান মান্না বলেন, এই দীর্ঘসময়ে কেন আন্দোলনগুলো সফলতার মুখ দেখেনি, এর পেছনে যেমন সরকারের অত্যাচার-নির্যাতন দায়ী, তেমনি বিরোধীদলগুলো তাদের আন্দোলন পরিকল্পনায় বা বাস্তবায়নে ভুল করেছে কিনা, নিজেদের নীতি-কৌশলের ক্ষেত্রে ভুল করেছে কিনা এই প্রশ্নগুলোও করা জরুরি। যেমন, ২০১৪ এর জাতীয় সংসদ নির্বাচন বর্জন করে বিএনপি কৌশলগত ভুল করেছিল কিনা এই বিতর্ক থেকেই যায়। এর পাশাপাশি, এমন অনেক সময় গেছে যখন হয়ত আন্দোলন, কর্মসূচি থাকার দরকার ছিল, বলিষ্ঠ নিয়ন্ত্রণ দরকার ছিল যা দেখা যায়নি। এর পেছনে অবশ্যই নেতৃত্বের একটি অভাব রয়েছে বলে তিনি মনে করেন। এরসাথে তিনি এটাও বলেন যে, এই সরকারের অধীনে কোনো সুষ্ঠু নির্বাচন হওয়া সম্ভব নয় এবং এই সরকারও স্বাভাবিক নিয়মে ক্ষমতা ত্যাগ করবে না। তাই আন্দোলনই পরিবর্তনের একমাত্র গতিপথ এবং সে আন্দোলনের ধারা এবং রূপরেখা হয়ত মাঠে নামার পরই বোঝা যাবে।
তিনি মনে করেন, রাজনৈতিক দিক থেকে এদেশের জন্য একটি সুষ্ঠু অবকাঠামো তৈরি করে দিয়ে যাওয়া সম্ভব। একটি বড় সমস্যা হল, এদেশের ভবিষ্যত নিয়ে একেকজন একেক রকম ভাবেন, কেউ হয়ত সমাজতন্ত্র চান, কেউ গণতন্ত্র বা কল্যাণ রাষ্ট্র, আবার কেউ শুধু ক্ষমতা অধিগ্রহন করতে চান। মাহমুদুর রহমান মনে করেন, এদেশের মানুষ অত্যন্ত ধৈর্যশীল, সহনশীল এবং পরিশ্রমী। তাই, এদেশে সব ধরনের পরিবর্তনই সম্ভব। বিশেষ করে যদি তরুণদেরকে উদ্বুদ্ধ করা যায়, তাদেরকে কল্যাণের কাজে ও সুস্থ রাজনৈতিক ব্যবস্থার পুনর্গঠনের কাজে নিয়োজিত করা যায়, তাহলে আগামী দীর্ঘসময়ে দেশ তাদের থেকে সুবিধা ভোগ করতে পারবে। এদেশের একটি বড় জনগোষ্ঠী দরিদ্র ও বেকার। যদি মানুষই না খেতে পায় তাহলে লোক দেখানো তথাকথিত উন্নয়নে বিশেষ লাভ হবে না। তাই প্রবীন এই রাজনীতিক মনে করেন, প্রতি বছর যে লক্ষ কোটি টাকা বিদেশে পাচার হয় সেটা রোধ করে এই অর্থ বরং দেশের এই জনগোষ্ঠীর কল্যাণে ব্যয় করা উচিৎ। উন্নতির মাপকাঠি হিসেবে লক্ষ হওয়া উচিৎ শিক্ষা, স্বাস্থ্য এবং বিচারব্যবস্থাকে মানুষের দোরগোড়ায় পৌঁছে দেয়া। আমাদের শিক্ষাব্যবস্থাও এখন ভঙ্গুর যেখান শিক্ষার চেয়ে বেশি সহিংসতা বা বাণিজ্য প্রাধান্য পায়। তিনি বলেন, এই ব্যাপারগুলোতে পরিবর্তন আনতে পারলে বাংলাদেশকে আপাদমস্তক পরিবর্তন করা সম্ভব।
এ ধরনের সমস্যাগুলো ছাড়াও সড়ক নিরাপত্তা, নারীর স্বাধীনতা, বেকারত্ব দূরীকরণের মত সব ব্যাপারেই নিজস্ব কর্মপরিল্পনা আছে বলে জানান মাহমুদুর রহমান। তিনি মনে করেন, এ ধরনের যেকোনো কাজের আগে প্রশাসনিক সংস্কার দরকার ও আধুনিকায়ন দরকার, যাতে করে লেনদেনে দুর্নীতির সুযোগ না থাকে। তার পরিকল্পনা মতে, তিনি ৬ কোটি নিম্ন আয়ের বা দরিদ্র মানুষের ডাটাবেজ তৈরি করতে চান যার উপর ভিত্তি করে স্বয়ংক্রিয়ভাবে তাদের প্রত্যেকের কাছে এক হাজার টাকা করে প্রতি মাসে পৌছে যাবে। এর জন্য হয়ত বাহাত্তর হাজার কোটি টাকা লাগবে, যেটা খুব বেশি নয়। কারণ এদেশে উচ্চবিত্তের অনেকে ঋণ নিয়ে কোটি কোটি টাকা বাইরে পাচার করে দিচ্ছে, কিন্তু এই টাকা গরীব মানুষদের দিলে তারা তাদের সংসার চালিয়ে দেশের মধ্যেই বিনিয়োগ করতে পারবে। এতে করে এই জনগোষ্ঠীর অর্থনৈতিক নিরপত্তা নিশ্চিত হবে। এছাড়া শিক্ষা, বিচারব্যবস্থা, চিকিৎসার মতো ব্যাপারগুলোতেও নজর দেয়া প্রয়োজন। তিনি নিজে কল্যাণ রাষ্ট্রব্যবস্থার একজন প্রচারক, কিন্তু বলেন, কোনো গোড়া কার্যবিধির অনুসরণ না করে প্রয়োজন অনুসারে যখন যে কাজ করা দরকার, তাই করবেন।
দেশের চিকিৎসাব্যবস্থা নিয়ে তিনি বলেন, আমরা যদি আমাদের ডায়াবেটিক হাসপাতাল, আইসিডিডিআরবি কিংবা গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের দিকে তাকাই, তাহলে স্পষ্টত বোঝা যায় কম খরচে অতি উন্নত চিকিৎসা প্রদান করা সহজেই সম্ভব। দরকার হলে কমিউনিটি হাসপাতালের মত ব্যবস্থা স্থাপন করে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জন্য উপজেলা বা থানা পর্যায়ে সুচিকিৎসা সরবরাহ করা সম্ভব। শিক্ষার ক্ষেত্রেও মনে রাখতে হবে, বিশ্ববিদ্যালয় বা অন্যান্য প্রতিষ্ঠানগুলো জ্ঞানচর্চার কেন্দ্র, রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তারের জায়গা নয়। তাই বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর গবেষণা ও শিক্ষার মান বাড়াতে হবে। তৃণমূল পর্যায়ে প্রয়োজনীয় সুযোগ সুবিধা দিয়ে শিক্ষাকে পৌছে দিতে হবে।
স্বাধীনতা থেকে শুরু করে আজ পর্যন্ত দেশের রাজনীতির সকল উত্থান-পতন সামনে থেকে দেখা ঋদ্ধ এই রাজনীতিবিদ মনে করেন, আজ পর্যন্ত পরিপূর্ণ গণতন্ত্র আমরা কখনো পাইনি। সে জন্যেই ৫০ বছরে যেখানে থাকার কথা ছিল সেখানে বাংলাদেশ পৌঁছাতে পারে নি। বরং ক্ষমতার বদল পালাবদলের রণক্ষেত্রে পড়ে এদেশের মানুষ স্বপ্ন দেখতে ভুলে গেছে। তাই তিনি উন্নয়নের স্বপ্ন, পরিবর্তনের স্বপ্ন নতুন করে মানুষকে দেখাতে চান। প্রতিনিয়ত এদেশ থেকে যে মেধাগুলো চলে যাচ্ছে, তাদের কাজে লাগানোর মতো সুষ্ঠু পরিবেশ ও ক্ষেত্র গড়ে তুলতে চান। যতদিন বেঁচে আছেন, ততদিন মানুষের সম্মান এবং ভালোবাসা নিয়ে তিনি বেঁচে থাকতে চান।
রাজনীতিবিদ হওয়ার পাশাপাশি মাহমুদুর রহমান মান্না একজন লেখকও, যার বইয়ের সংখ্যা প্রায় ১৫। সেজন্যেই সামাজিক আন্দোলনের পাশাপাশি সাংস্কৃতিক আন্দোলন চালিয়ে যাওয়াও তাঁর স্বপ্ন। মানুষের চিন্তা-ভাবনা দৈন্য দূর করতে তাদের সাংস্কৃতিক মুক্তির লক্ষ্যে কাজ করে যেতে চান তিনি। নানা সমস্যায় জর্জরিত আমাদের সমাজব্যবস্থায় মানুষের জন্য কাজ করতে যে মানবিকতা দরকার, সে মানবিকতার চিন্তাও কেউ করে না বলে তিনি মনে করেন। বলেন, জাতিগতভাবে আমরা আবেগ যতটা পেয়েছি, যুক্তিসিদ্ধ ভালোবাসা ততটা পাইনি। আমাদের রাজনীতির কারণেই আমরা সামাজিক ক্ষেত্রে চিন্তাশীল সংস্কৃতি সৃষ্টি করতে ব্যর্থ হয়েছি। নিজের দীর্ঘ রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা থেকেই তিনি বলেন, দলীয় রাজনীতি করেও সবার গ্রহনযোগ্যতা অর্জন করা যায়, সহাবস্থানের পরিবেশ সৃষ্টি করা যায়, যেমনটা করে গিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। দেশকে ভালোবেসে, দেশের প্রতি অঙ্গীকারবদ্ধ থেকে, দেশে একটি সুষ্ঠু গণতান্ত্রিক পরিবেশ সৃষ্টিতে সহায়তা করতে বাংলাদেশের সকল নাগরিকের প্রতি তিনি আহবান জানান। তার সকল সদিচ্ছা ও শুভচেষ্টা সফল হক এই প্রত্যাশাই রইল।