আজ কথা হচ্ছিল এমন একজন গুণী মানুষের সঙ্গে যিনি একই সাথে জনপ্রিয় মডেল, অভিনেত্রী, রেডিও জকি, উপস্থাপিকা, আবৃত্তি শিল্পীসহ আরও বহু পরিচয়ে পরিচিত। বলছি জনপ্রিয় ব্যক্তিত্ব শারমিন লাকির কথা। যদিও কথাচ্ছলে তিনি জানান যে, কখনো নাটক বা সিনেমায় অভিনয় না করার পরও মানুষের কাছে তার অভিনেত্রী পরিচয়টাই প্রকট হয়ে উঠছে, যার কারণ হয়ত বিভিন্ন বিজ্ঞপনে তার স্বরব উপস্থিতি। নানা গুণে গুণান্বিত এই শিল্পীর কর্মজীবন কিন্তু শিক্ষকতার মাধ্যমে শুরু হয়েছিল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলায় মাস্টার্স করার পর তিনি দুটি ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে শিক্ষকতা করেছেন। তার প্রায় ৫ বছর শিক্ষকতার অভিজ্ঞতা রয়েছে। মিডিয়া জগতে “সিদ্দিকা কবির’স রেসিপি” অনুষ্ঠানে সপ্রতিভ ও স্নিগ্ধ উপস্থিতির মাধ্যমে তিনি প্রথম দর্শকদের নজর কাড়েন। যদিও সেই অনুষ্ঠানের কৃতিত্বের সিংহভাগই তিনি দিতে চান শ্রদ্ধেয় সিদ্দিকা কবিরকে, যা তার বিনয়েরই পরিচায়ক। এরপর বাংলাভিশনে ৩ বছর “আপনার আগামী” নামের আরেকটি অনুষ্ঠান উপস্থাপনা করেছেন। এছাড়াও, ‘চার দেয়ালের কাব্য’ ও ‘মেঘে ঢাকা তারা’র মতো অসংখ্য জনপ্রিয় অনুষ্ঠান করেছেন তিনি। জনপ্রিয় রেডিও চ্যানেল রেডিও ফূর্তিতে রেডিও জকি হিসেবেও ব্যপক সাড়া ফেলেছেন তিনি।
করোনা আক্রান্ত পৃথিবীর অবস্থা নিয়ে বলতে গিয়ে তিনি ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্যে তার চিন্তার কথা ব্যক্ত করেন, পাশাপাশি এর নির্মূলের প্রার্থনাও করেন। আলাপকালে জানিয়েছেন যে তিনি সবসময় চেষ্টা করেন নিজেকে মানসিকভাবে শক্ত রাখতে এবং স্বাস্থ্যবিধি মেনে নিজের কাজ করে যেতে। যাতে করে, করোনার এই বিষন্ন প্রকোপ পেয়ে না বসে এবং তার মানসিক সুস্থ্যতা বজায় থাকে। ৮ ভাই-বোনের বিশাল পরিবারে বেড়ে উঠা তার, তাই সেসময় এবং এসময়ের সন্তানদের বেড়ে উঠার পার্থক্য নিয়ে বলতে গিয়ে এ যুগের সন্তানদের সাথে বাবা-মার এক সহজাত সম্পর্কের কথা বলেন, যেখানে সন্তান হয়ত সহজেই মা-বাবার সাথে এমন অনেক কিছু বলতে বা করতে পারে যা আগে ভাবা যেত না। মজা করে বলেন কীভাবে নিজের মা কে মা দিবসে ভালোবাসার কথা বলি বলি করেও বলে উঠতে পারেন না। তিনি মনে করেন, এ যুগে বিশ্বসংস্কৃতির সংস্পর্শে থাকার কারণে সন্তানেরা আগের চেয়ে অনেক বেশি পরিপক্ব। তাই তাদের সাথে মা-বাবার একটি বন্ধুত্বপূর্ন সম্পর্কই শ্রেয়।
এছাড়াও, তিনি নিজের শিক্ষকতা জীবন নিয়ে এই পেশার প্রতি তার কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে জানান যে, এই পেশার কারণে এখনও যেকোনো অনুষ্ঠান থেকে শুরু করে এয়ারপোর্ট, সব জায়গাতেই পুরোনো ছাত্র-ছাত্রীদের সম্মান ও ভালোবাসায় সিক্ত হন। আমাদের বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে অত্যন্ত চমৎকারভাবে তিনি তার দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরেন। তিনি মনে করেন, বর্তমানের যে বাংলা, ইংরেজি, মাদরাসা ইত্যাদি বিভিন্ন মাধ্যমের শিক্ষাদান ব্যবস্থা রয়েছে, তা একধরনের বিভাজন সৃষ্টি করছে। এবং তিনি ব্যক্ত করেন, এই শিক্ষাব্যবস্থা খন্ডিত না হয়ে একধরনের সার্বজনীন ও যুগোপযোগী হওয়াই বরং শ্রেয় ছিল।
কথায় কথায় তার ২৬ পর্বের নন-ফিকশন “চন্দ্রবিন্দু” সম্পর্কে বেশকিছু মজার কিছু তথ্য জানা যায়। এ অনুষ্ঠানের ২৬ টি পর্ব ছিল বিভিন্ন বিষয়ের উপর, যেমন – মা, বৃষ্টি, কাক, ভূত ইত্যাদি। গুণী এই উপস্থাপিকে নিজেকে এই অনুষ্ঠানের সাথে তাল মিলিয়ে উপস্থাপন করেছেন ২৬ টি সম্পূর্ণ ভিন্ন ধরনের উপায়ে, পোশাকে এবং ভঙ্গিমায়, যা প্রতিটি পর্বের বিষয়বস্তুকে প্রতিফলিত করতো। সংগীতশিল্পী শাফিন আহমেদের সাথে “গান ও ফান” নামে আরেক জনপ্রিয় অনুষ্ঠান করেছেন তিনি। এছাড়াও নিজের ক্যারিয়ারভিত্তিক একটি অনুষ্ঠান নিয়ে কথা বলেন তিনি যার মাধ্যমে, চিরাচরিত পেশাগুলোর বাইরে আরও অন্যান্য পেশার খোঁজ তিনি তরুণদের সামনে তুলে ধরতেন যা আমাদের সামাজিক প্রেক্ষাপটে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বর্তমানে তিনি বাচ্চাদের গল্প বলার একটি শিক্ষামূলক অনুষ্ঠান “বই পড়ি, জীবন গড়ি” এর সাথে যুক্ত আছেন। শিল্পের বিভিন্ন শাখায় বিচরণ করা এই গুণী শিল্পীর রয়েছে নিজস্ব সংগঠন এবং ইউটিউব চ্যানেল “তাইরে নাইরে না”, যেখানে তিনি ভবিষ্যত বাচকশিল্পী, সংবাদপাঠক ও উপস্থাপকদের শুদ্ধ উচ্চারণ শেখানোর কাজ করছেন। এর বাইরেও তিনি কবিতার সংগঠন “পঞ্চকন্যা”র সাথে যুক্ত আছেন।
কীভাবে তার দৃষ্টি আকর্ষণ করা যায়, এমন প্রশ্নের জবাবে শারমিন লাকি সুন্দর গান গাওয়া এবং সুন্দর করে কথা বলার প্রতি তার ভালো লাগার কথা জানান। এজন্যই তিনি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অসংখ্য সংগীত শিল্পীদের সাথে যুক্ত আছেন বলে জানিয়েছেন। এমনকি সংগীতশিল্পী পার্থ বড়ুয়ার সঙ্গে একসাথে “সারাদিন তোমায় ভেবে হলোনা আমার কোনো কাজ” গানটির স্টুডিও রেকর্ডিং এর মজার অভিজ্ঞতা বর্ণনা করেন তিনি। স্কুল-কলেজ জীবন নিয়ে কথা হলে তিনি তার দুরন্ত স্কুল জীবনের কথা শোনান। শৈশব ও কৈশোরে তিনি সারাদিন রোদে ঘুরে বেড়াতেন, গাছে চড়তেন, মাঠে নেমে খেলতেন, ছেলেদের সাথে মিলে মারপিট করতেন। এসব ছিল তার নিত্যদিনের কাজ। পরবর্তীতে উচ্চমাধ্যমিক স্তরে গিয়ে যখন পরিবর্তন আসে, তখন নিজের অবলোকন এবং অন্যদের প্রশংসায় যে আত্মপ্রেম, আলোড়ন এবং অনুপ্রেরণা তৈরি হয় কিংবা যে সকল অম্লমধুর বিড়ম্বনার সৃষ্টি হয়, সেসব কথাও বলেন।
কথার মাঝে দেশীয় শিল্পের প্রতি তার ভালোবাসার কথা উঠে আসে। তিনি জানান, দেশীয় শিল্প ও পোশাক নিয়ে যারা কাজ করেন, তাদের পাশে থাকার সর্বাত্মক চেষ্টা করেন তিনি। দুটি শাড়ি কিনলে একটি যাতে বাংলাদেশের হয়, এমন ভাবেই চিন্তা করেন শারমিন। আমাদের তাঁতশিল্পকে বাঁচিয়ে রাখতে সবারই এভাবে এগিয়ে আসা উচিৎ বলে মনে করেন তিনি। আরজে হিসেবে নিজের দুই সিজন রেডিও শো করার অভিজ্ঞতা তিনি আমাদের কাছে তুলে ধরেন। জানান, তিনি চেষ্টা করেন কথার মাঝে যাতে বাংলা ইংরেজির মিশ্রন চলে না আসে। এর পাশাপাশি তিনি বলেন, জকি হিসেবে বিভিন্ন ধরনের শ্রোতাগোষ্ঠীর উপযোগী হিসেবে নিজের গানের তালিকা বা বিষয়বস্তু সাজানো খুবই কঠিন একটি কাজ। তাই তিনি সুস্থ-স্বাভাবিক ভাবে সুন্দর বাংলায় নিজের অনুষ্ঠান পরিচালনার চেষ্টা করেছেন। এসবের মাঝেই বাংলা ভাষার প্রতি তার তীব্র সম্মান এবং ভালোবাসা প্রকাশ পায়, ভাষাকে যে তিনি মাতৃসম ভাবেন, বারবার তার কথায় সেটি উঠে আসে। আর তাইতো, বিকৃত উচ্চারণের তীব্র সমালোচনা করেন তিনি। একইসাথে এও বলেন যে, বর্তমান প্রজন্মের ইচ্ছাকৃত বিকৃত উচ্চারণের জন্যে হয়ত কিছুটা পূর্ববর্তী প্রজন্মও দায়ী, যারা এই ভালোবাসাটা এ প্রজন্মের মধ্যে সৃষ্টি বা সঞ্চালন করতে পারেনি। তাই তিনি চেষ্টা করেন যখন উপস্থাপনার উপর ক্লাস নেন, তখন নিজের জায়গা থেকে সুন্দরভাবে এই ব্যাপারগুলো বুঝিয়ে বলতে।
বিগত ৫-৬ বছর ধরে শারমিন লাকি নিয়মিত উপস্থাপনা ও কবিতা ইত্যাদির উপর সরাসরি কিংবা অনলাইন কোর্স করিয়ে আসছেন। সেখানে বরাবরই তিনি বাংলা ভাষার সৌন্দর্য রক্ষার ক্ষেত্রে সর্বাত্মক গুরুত্ব দিয়েছেন। ক্ষেত্রবিশেষে নিজের উদাহরণ টেনেও শিক্ষার্থীদের শুদ্ধ বাংলার সৌন্দর্য ও সফলতা দেখানোর চেষ্টা করেন। পাশাপাশ, তিনি এই ব্যাপারটিও তুলে ধরেন যে, বিগত সময়ে যে জকিরা বিকৃত বাংলা বলে শো চালানোর চেষ্টা করেছেন, তাদের কারোর অস্তিত্বই এখন বিনোদন জগতে সেভাবে নেই, তার বিপরীতে বরং যারা অন্তত সুন্দরভাবে বাংলায় উপস্থাপনের চেষ্টা করছেন, তারাই শ্রোতাদের মন জয় করেছেন এবং এখনও টিকে আছেন।
নিজের জীবনের স্মরণীয় সময় বা কাজ নিয়ে বলতে বললে আবারও তিনি শ্রদ্ধেয় সিদ্দিকা কবিরের কথা তুলে ধরেন। এছাড়া শারমিন জানান, জয়ন্ত চট্টোপাধ্যায়, ডঃ বিপ্লব বালা, প্রদীপ ঘোষের মত কিছু শিক্ষক তিনি নিজের সময়ে পেয়েছিলেন। তিনি জানান, বর্তমানে তার এ অবস্থানে আসার পিছনে সারা জাকেরের অনেক অবদান আছে। সারা জাকেরদের মত মহৎ মানুষদের সাথে কাটানো সময়গুলোই তার জীবনের স্মরণীয় ও বরণীয় স্মৃতি। এর বাইরে স্মরণীয় ঘটনা হিসেবে তিনি ইউনিভার্সিটি অফ মেলবোর্নে কাটানো একটি দিনের কথা বলেন, যেদিন তার ছেলের নিজস্বসৃষ্ট চিত্রনাট্য পাঠ তিনি দেখতে যান। তিনি বলেন, সেদিনের সেই ঘটনা, সেই পরিবেশ, অভিনয় এবং নিজের সন্তানের চিন্তা-ভাবনার গভীরতা এবং সৃষ্টিশীলতা, যা মা হিসেবে তিনিও ভাবতে পারেননি, এসব মিলিয়ে এটি তাঁর জীবনের অন্যতম স্মরণীয় একটি ঘটনা।
শারমিন লাকির অসাধারন বাগ্মীতার জন্যেই হয়ত কখন বিদায়ের সময় চলে এসেছে তা বোঝাই গেল না। বহুমূখী প্রতিভার অধিকারী এই শিল্পী, অসংখ্য দর্শকের মনে নিজগুণে জায়গা করে নিয়েছেন। তিনি যেন ভালো থাকেন, সুস্থ্য থাকেন, এটাই কামনা রইল।