মানুষের নিজের উপলব্ধিকে অন্যের কাছে তুলে ধরার জন্য সাহিত্য যেমন ভূমিকা রাখে ঠিক তেমনি সমাজের চিত্রকে সবার মাঝে তুলে ধরে নাটক ও সিনেমা। নাটক ও সিনেমা মানুষকে অন্য এক জগতে নিয়ে যায়। নিজেকে নিয়ে ভাবতে শেখায়। নিজের দেশ, সংস্কৃতিকে তুলে ধরার জন্য এর চেয়ে সহজ পন্থা বোধহয় কমই আছে। আর এই রূপালি জগতের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ হলেন আমাদের অভিনয় শিল্পীরা। শিল্পী তার নিজের সকল দক্ষতা কাজে লাগিয়ে নিজেকে সাধারণ মানুষের খুব কাছাকাছি নিয়ে যান। অভিনয়ের বিভিন্ন চরিত্রকে নিজের মাঝে ফুটিয়ে তুলে নিজেকে ছাড়িয়ে তাঁর চরিত্রের মানুষটি হয়ে যুগ যুগ বেঁচে থাকেন কোটি কোটি দর্শকের হৃদয়ে। আজ এমন একজন অভিনয় শিল্পীর কথা বলব, যার বড় হওয়া ও বেড়ে ওঠা হয়েছিল সাংস্কৃতিক পরিমন্ডলে থেকেই। যার পদচারণায় আরও বিকশিত হয়েছে বাংলাদেশের সোনালী ও রূপালি পর্দার জগৎ। যিনি রাঢ়াঙ নাটকের শ্যামলী, ময়ূর সিংহাসন এর কৃষ্ণা এবং বিদ্যাসাগর নাটকের রাধা চরিত্রগুলোর মধ্য দিয়ে দর্শক মনে বিশেষভাবে জায়গা করে নিয়েছেন; বলছি জনপ্রিয় অভিনয় শিল্পী তমালিকা কর্মকারের কথা।
তমালিকা কর্মকার একজন বাংলাদেশী মডেল ও নাট্য অভিনেত্রী। একই সাথে তিনি একজন কোরিওগ্রাফার এবং প্রশিক্ষকও। মঞ্চ নাটক, টেলিভিশন, ও চলচ্চিত্রে সমানভাবে পদচারণা রয়েছে তাঁর। জনপ্রিয় এই অভিনেত্রী ১৯৭০ সালের ২রা জুলাই খুলনায় জন্মগ্রহণ করেন এবং জন্মের কিছুদিন পরেই তিনি স্বপরিবারে ঢাকায় চলে আসেন। তার মা ছিলেন বিটিভির নিয়মিত নজরুল সংগীত শিল্পী। এছাড়াও তিনি শ্যামাসংগীতও গাইতেন। মাত্র তিন বছর বয়স থেকে অভিনয় শুরু করেন তিনি। ১৯৭৮ থেকে ১৯৮০ সাল পর্যন্ত বিটিভিতে আয়োজিত ফুলকুঁড়ি অনুষ্ঠানে গল্প বলা পর্বে অংশগ্রহণ করতেন তিনি।
কিভাবে বেড়ে উঠা এবং অভিনয় জগতে প্রবেশ এই প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ঠিক মনে নেই তার। যখন থেকে তিনি অভিনয় শুরু করেছেন তখন তিনি বুঝতেনই না অভিনয় কী? ছোটবেলা থেকেই সাংস্কৃতিক অঙ্গনে বড় হওয়ার ফলে তাঁর কাছে অভিনয়, গান, নাচ এসব সহজাত মনে হতো। পড়াশোনা যেমন স্বাভাবিক কাজ, করতেই হবে, ঠিক তেমনি অভিনয়কেও তিনি স্বাভাবিক হিসেবেই ধরতেন। গহর জামিলের কাছে তার নাচ শেখা, ছায়ানটে গান এবং আর্ট কলেজে ছবি আঁকা শেখা। সাংস্কৃতিক অঙ্গনের এই দিকগুলোকে তিনি অন্যান্য কাজের মতই ভাবতেন, তার কাছে বিশেষ কিছু মনে হয়নি।
অভিনয়ে আগ্রহী হলেন কিভাবে এই প্রশ্নের জবাবে তিনি জানান, তাঁর মা একজন সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব ছিলেন এবং ছোটবেলা থেকেই তিনি খুব কাছে থেকে তাঁর মাকে দেখেছেন। তাঁর মা নাট্যকলার সদস্য ছিলেন এবং মঞ্চ নাটকে গান করতেন। সবাই যখন গান শেষে হাততালি দিতো সেটি তমালিকাকে খুব মুগ্ধ করতো। ছোট বেলা থেকেই তিনি তাঁর মায়ের সাথে সিনেমা হলে গিয়ে হিন্দি ও বাংলা সিনেমা দেখতেন ও মঞ্চ নাটক দেখতেন। ছোটবেলায় মঞ্চ নাটক কী তা বুঝতে না পারলেও এভাবে মায়ের সাথে নিয়মিত আসা যাওয়ার মধ্য দিয়ে তিনি ধীরে ধীরে অভিনয় কী তা অনুধাবন করা শুরু করলেন। পর্দার চেয়ে মঞ্চের অভিনয় বেশি প্রানবন্ত ও জীবন্ত যা তমালিকাকে আকৃষ্ট করেছে অভিনেত্রী হয়ে উঠতে। তিনি মনে করেন, ইন্টারনেটের রিভিউ দেখে বা ছবির সমালোচনা দেখে কোনো অভিনয় সম্পর্কে সঠিক ধারণা পাওয়া যায় না, এজন্য সামনে থেকে দেখে তা উপলব্দি করতে হয়।
বাংলাদেশের বর্তমান সময়ের মিডিয়া জগৎ নিয়ে তমালিকা কর্মকারের কিছু আক্ষেপ আছে। বাংলাদেশে এখন মানসম্মত নাটক সিনেমা কম হয় বলে তিনি মনে করেন। নতুনদের সাথে পুরাতনদের গুণগত কোনো পরির্তন রয়েছে কি না এই প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, পূর্বের শিল্পীরা বর্তমান প্রজন্মের শিল্পীদের থেকে মানসিকভাবে অনেক আধুনিক ছিলেন। তিনি মনে করেন এখন বাংলা নাটক ও সিনেমাতে প্রযুক্তিগত উন্নতি হয়েছে তবে তা সামগ্রিক উন্নতি নয়। তাঁর মতে বর্তমানে এ জগতে চাকচিক্য বেঁড়েছে, সিনেমাটোগ্রাফির ধরন পরিবর্তন হয়েছে, আধুনিকতা এসেছে তবে মানসিকতায় ঘুণ রয়েছে। এখন আর প্রাণছোঁয়া নাটক হচ্ছে না এবং নাটকে সাংস্কৃতিক উপাদান কমে যাচ্ছে। বাংলা নাটক সিনেমায় এখন ধীরে ধীরে বাঙ্গালিত্ব হারিয়ে যাচ্ছে বলে দুঃখ প্রকাশ করেছেন তিনি। পর্দার আয়োজনে নিজের সত্ত্বা ও নিজের সংস্কৃতির উপস্থিতি থাকা প্রয়োজন। তিনি বলেন, আমাদের অনেক ভালো ভালো শিল্পী আছে কিন্তু তাদের উপযুক্ত সম্মান দেওয়া হচ্ছে না, সঠিকভাবে ব্যবহার করা হচ্ছে না। আমরা অনেকটা ধার করা সংস্কৃতির উপর নির্ভরশীল হয়ে যাচ্ছি। অন্য দেশের সিনেমা থেকে নকল করা প্রসঙ্গে বেশ খোলাখুলিভাবেই তিনি বলেন, নকল করার জন্যও কিছু কোয়ালিটি থাকে। ভারতীয়রাও নকল করে কিন্তু নকলের মাঝেও একটা শিল্প আছে যেটা আমরা পারছি না। হলিউড-বলিউডে অনেক বয়স্করা অভিনয় করেন এবং তাদের কাছে বয়স একটা সংখ্যা, দক্ষতাই আসল। কিন্তু আমাদের দেশে এমনটা হচ্ছে না বরং বাংলা চলচ্চিত্রের গৌরব অবুলপ্ত হয়ে যাচ্ছে ধীরে ধীরে।
বর্তমানে তাঁকে আর পর্দায় দেখা যাচ্ছে না কেন এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি সরাসরি জবাব দেন যে তাকে নেওয়া হচ্ছে না। কিছুটা অভিমানের সুরেই এক সময়ের পর্দা কাঁপানো এই গুণী অভিনেত্রী জানান যে তাদের প্রজন্ম এখন আর নেই এবং এখন আর তাদের জন্য গল্প লেখা হয় না। বর্তমানের নাটকগুলোতে এখন পরিবারভিত্তিক তেমন কিছু থাকে না। এখনকার নাটকে ভালো গল্প নেই বলেও দাবী করেন তিনি। তিনি আরও দাবী করেন যে বর্তমানে মিডিয়া জগতে কোন সম্মান কমে আসছে, তাদের নিয়ে ভাবাও হচ্ছে না এমনকি ভালো পরিচালকেরও অভাব এখন। তবে, হয়তো ভালো ভালো নাটক এখনো হয় কিন্তু তিনি জানেন না।
জনপ্রিয় নির্মাতা চয়নিকা চৌধুরী তমালিকা কর্মকারের বোন ও বিশিষ্ট নাট্য নির্মাতা অরুন চৌধুরি তার বোনের স্বামী। চয়নিকার কাজ কেমন লাগে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বলেন, তাঁর বোন হিসেবে ও অরুন চৌধুরি মানুষ হিসেবে অনেক অমায়িক ও ভালো। অরুন চৌধুরি অনেক ভালো লিখেন ও গল্প বলেন কিন্তু ডিরেক্টর হিসেবে কেমন তা বলতে পারবেন না। কেননা, তারা তাঁর জন্য কিছু করেননি। অরুন চৌধুরীর নাটকে তিনি অভিনয় করেছেন কিন্তু গুরুত্বপূর্ন কোন চরিত্র তিনি তাঁকে দেননি এবং ভালো কাজ করার সুযোগও দেননি। তাই তিনি তাঁর বোন পরিচালক হিসেবে কেমন তা বলতে পারছেন না।
তমালিকা কর্মকার কিভাবে আজকের জনপ্রিয় তমালিকা কর্মকার হয়েছেন অর্থাৎ তার অভিনেত্রী হবার পেছনে কার অবদান রয়েছে এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, তার অভিনেত্রী হবার পেছনে কারও অবদান নেই। তবে তিনি ভালো পরিচালক, দর্শক ও সমালোচকদের প্রশংসা করেছেন। তমালিকা বলেন, তাঁর আজকের এই অবস্থানের জন্য যদি কারোর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে হয় তবে তিনি হলেন তাঁর মা। আবেগভরা কন্ঠে তিনি বলেন, মা যদি তাকে এভাবে গড়ে না তুলতেন তবে তাঁর পক্ষে সম্ভব হতো না আজকের এই অবস্থানে পৌঁছানোর। তবে তিনি বিশেষভাবে একজনের প্রতি কৃতজ্ঞ, তিনি হলেন মামুনুর রশিদ। মামুনুর রশিদের কাছে মঞ্চের জন্য তিনি কৃতজ্ঞ। ১৯৯২ সালে আরণ্যক নাট্যদল প্রযোজিত মানুনুর রশিদের লেখা ও আজিজুল হাকিম নির্দেশিত নাটক ‘পাথর’ এর মাধ্যমে তিনি মঞ্চনাটক শুরু করেন। এরপর আরণ্যক দলের অন্যতম নাটক ইবলিশ, জয়জয়ন্তী, খেলা খেলা, ওরা কদম আলী, প্রাকৃতজনের কথা, রঢ়াঙ, বিদ্যাসাগর, ময়ূর সিংহাসন নাটকে অভিনয়ের মধ্য দিয়ে থিয়েটার অনঙ্গনে জনপ্রিয়তা লাভ করেন।
তমালিকা চৌধুরির এত ভালো কাজের মধ্যে পছন্দের চরিত্র কোনটি এমন প্রশ্নের জবাবে তমালিকা জানান, মঞ্চ তাঁর কাছে অনেক কিছু এবং মঞ্চ তাকে অনেক কিছু দিয়েছে। পাথর নাটকের গ্রামের মেয়ের সাজ, বিদ্যাসাগরের চরিত্র এসব তার কাছে পছন্দের। তমালিকা নিজে যেমন অন্যদের কাছে জনপ্রিয়, অন্যদের ভালোলাগার কিংবা পিছন্দের শিল্পী ঠিক তেমনি তারও পছন্দের শিল্পী রয়েছেন। তমালিকার পছন্দের মানুষ হলেন আফজাল হোসেন।
তমালিকাকে প্রশ্ন করেছিলাম এমন কোনো চরিত্র নিয়ে আক্ষেপ আছে কি না যেটায় তিনি অভিনয় করতে পারেন নি। উত্তরে তিনি “চাঁদনী” ছবিটির কথা উল্লেখ করেন। সেখানে তাঁর অভিনয় করার কথা থাকলেও পরে তিনি করতে পারেন নি। তবে, চাঁদনীতে অভিনয় করার আক্ষেপ থাকলেও তাঁর রয়েছে বৈচিত্রপূর্ণ অভিনয়ের অভিজ্ঞতা। প্রাগৈতিহাসিক পুতুল নাচের ইতিকথা, সূর্যসেনের প্রীতিলতা, চতুর্থমনা ও অনিমেষ আইচের বহু নাটকে অভিনয় করেছেন এই গুণী শিল্পী।
নতুন প্রজন্মের জন্য কোনও উপদেশ আছে কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে তমালিকা জানান উপদেশ কেউ পছন্দ করেন না, তাই তিনি উপদেশ দিতে চাননা। কথার প্রসঙ্গে তিনি জানান অভিনয় তাঁর কাছে প্রার্থনার মতো এবং তাঁর ব্যক্তিগত জীবনে অনেক ভুল ত্রূটি থাকলেও কাজের ক্ষেত্রে তিনি কখনও ভুল করেননি। তাই নতুন প্রজন্মকে উপদেশ না দিতে চাইলেও নিজেদের কাজের প্রতি মনোযোগী হতে আহ্বান জানিয়েছেন তিনি।
বর্তমান সময়ের শিল্পীদেরকে মূল্যায়নের প্রসঙ্গে তিনি জানান এখন আর তেমন একটা বাংলা নাটক দেখেন না, তাই নতুন শিল্পীদেরকেও তেমন চিনেন না তিনি। তবে কেউ কোনও নাটক দেখার কথা বললে সেসব তিনি দেখেন। তিনি বিশেষভাবে কয়েকজনের নাম বলেন যাদের অভিনয় তার কাছে ভালো লাগে। তারা হলেন অপূর্ব, মোশারফ করিম, তিশা, চঞ্চল চৌধুরী, বাবু, সিয়াম, মেহজাবিন, কল্যান, শ্যামল প্রমুখ।
অভিনয় ক্যারিয়ারে তমালিকা কর্মকার মঞ্চ নাটকের সাথে বেশি সম্পৃক্ত থাকলেও বেশ কয়েকটি জনপ্রিয় সিনেমাতেও অভিনয় করেছেন তিনি। যেমন – এই ঘর এই সংসার, কিত্তনখোলা, ঘেটুপুত্র কমলা। নাট্যকার গোলাম মোস্তফার হাত ধরে অভিনয় জীবনের সূচনা হয় এবং এরপরে হুমায়ুন আহমেদের কোথাও কেউ নেই নাটকের মধ্য দিয়ে তিনি আলোচিত হোন। আর চলচ্চিত্রে অভিনয়ের যাত্রা শুরু করেন ‘অন্যজীবন’ এর মধ্য দিয়ে।
অনবদ্য অভিনয় জীবনে বহু পুরস্কার ও সম্মাননা অর্জন করেছেন তমালিকা কর্মকার। তিনি কীত্তনখোলা ছবির জন্য শ্রেষ্ঠ পার্শ্বচরিত্র অভিনেত্রী ক্যাটাগরিতে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরষ্কার লাভ করেন। ২০১৪ সালের ২১ জুন যুক্তরাষ্ট্রের কালচারাল সোসাইটি অফ নর্থ আমেরিকা সম্মাননা, ২০১৬ সালে তিনি মেগা সার্ট ম্যাগাজিন থেকে ‘মেগা স্টার্ট মিউজিক এন্ড এন্টারটেনমেন্ট এওয়ার্ড, ২০০৮ সালে কেরালা থিয়েটার ফেস্টিভাল স্মারক, ১৯৮২ সালে তিনি বাংলাদেশ টেলিভিশনের নতুন কুঁড়িতে গল্প বলা ক্যাটাগরিতে সেরা শিশু শিল্পী পুরস্কারসহ অসংখ্য পুরস্কার ও সম্মাননা অর্জন করেছেন। দর্শকনন্দিত ও জনপ্রিয় এই রুচিশীল অভিনেত্রী তাঁর পুরো ক্যারিয়ারজুড়ে অভিনয়কে প্রার্থনার মত পবিত্র অনুষঙ্গ হিসেবে লালন করে গিয়েছেন। বর্তমানে দেশের বাইরে থাকা এই গুনী শিল্পী সবসময়ই প্রত্যাশা করেন দেশের চলচ্চিত্র ও নাটক আরও সমৃদ্ধ হবে এবং দর্শকের হৃদয় জয় করে যাবে।