পৃথিবীর সবচেয়ে বড় মাদকতা হয়তো সুরের মাদকতা। তাইতো সুরের মাঝে যে হারিয়ে যায় অন্য কোন কিছুই আর তাকে টানতে পারে না। আজকে এমন একজন মানুষের কথা বলবো যিনি নিজেকে সুরের মাঝে সবাইকে আসক্ত করেছেন। গানই যার জীবন। বর্তমান সময়ে একের পর এক সফলতা মুঠোবন্দি হয়েছে যার। তিনি হলেন এই প্রজন্মের শ্রোতাপ্রিয় শিল্পী ও সংগীত পরিচালক […]

হারানো দিনের গানওয়ালা : নির্ঝর চৌধুরি

পৃথিবীর সবচেয়ে বড় মাদকতা হয়তো সুরের মাদকতা। তাইতো সুরের মাঝে যে হারিয়ে যায় অন্য কোন কিছুই আর তাকে টানতে পারে না। আজকে এমন একজন মানুষের কথা বলবো যিনি নিজেকে সুরের মাঝে সবাইকে আসক্ত করেছেন। গানই যার জীবন। বর্তমান সময়ে একের পর এক সফলতা মুঠোবন্দি হয়েছে যার। তিনি হলেন এই প্রজন্মের শ্রোতাপ্রিয় শিল্পী ও সংগীত পরিচালক নির্ঝর চৌধুরী। জনপ্রিয় এই রবীন্দ্র শিল্পীর জন্ম পুরান ঢাকার গেণ্ডারিয়াতে। মনোবিজ্ঞানে তিনি স্নাতক ও স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করলেও গানের প্রতি প্রবল আগ্রহ থাকায় পরবর্তীতে সংগীতে উচ্চশিক্ষা গ্রহন করেন। ২০০০ সাল থেকে তিনি ছায়ানট রবীন্দ্রসংগীত বিভাগে শিক্ষকতা করছেন। শাস্ত্রীয় সংগীত থেকে শুরু করে পঞ্চকবির গান বা হারানো দিনের গান, সকল ক্ষেত্রে তাঁর গাওয়া গানগুলো পেয়েছে ব্যাপক জনপ্রিয়তা। সংগীতে তার অবদান বাংলা গানকে আরও সমৃদ্ধ করেছে এবং যুক্ত হয়েছে নতুন মাত্রা।

গানের প্রতি তাঁর ভালো লাগার জন্ম কখন এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, গানের প্রতি কখন থেকে ভালোবাসা জন্মেছে তিনি নিজেও ঠিক বলতে পারবেন না। তাঁর মা নজরুল, লালনগীতি করতেন। সেই সুবাধে খুব ছোটবেলা থেকেই গানের সাথে পরিচয় হয় তাঁর। তিনি আরও জানান, তাঁর দাদা খুব গান প্রেমী ছিলেন। দাদা সবসময় চাইতেন তার ছেলেরা গান করুক। কিন্তু ছেলেদের দিয়ে সেই স্বপ্ন পূরণ করতে পারেন নি তিনি, তাই যখন দেখলেন নাতি ভালো গান করছে, তখন মনে করলেন নাতিকে দিয়েই হয়তো তাঁর দীর্ঘদিনের লালিত স্বপ্ন বাস্তবায়ন করা সম্ভব হতে পারে। সেজন্য তিনি তাকে ৯ বছর বয়সেই ছায়ানটে ভর্তি করেন। তবে, হারমোনিয়ামটা তিনি নিজেই শিখছেন। একা একাই রাগগুলো তুলতে শিখেছিলেন তিনি।

বাংলাদেশ ও কলকাতায় রবীন্দ্র সংগীত শিল্পী হিসেবে তিনি বিশেষভাবে সমাদৃত। শুধু রবীন্দ্র সংগীত নয়, সকল ধরণের গানের চর্চা তিনি করেন। এইসব গানের জন্য ‘ধারক’ নামে একটি ফিউশন ব্যান্ড সৃষ্টি করেছিলেন তিনি। ধারকের ধারণার পেছনের গল্প শুনতে চাইলে তিনি জানান, তিনি যখন ছায়ানটে ছিলেন তখন তিন বছর পর তাদের একটি নির্দিষ্ট গানের ধারা পছন্দ করতে হয়। তখন তিনি রবীন্দ্র সংগীতের উপর নিজের পারদর্শিতা দেখানোর জন্য মনস্থির করেন। তারপর তাদের নজরুল সংগীতের শিক্ষিকা শামিয়া পারভীন শিমুর কিছু কথায় তিনি নতুন করে ভাবেন যে রবীন্দ্র সংগীতের চর্চা করলে তিনি অন্য কোন ঘারানার গানগুলো গাইতে পারবেন না। কিন্তু তাঁর মনে হয়েছিলো তিনি শুধু রবীন্দ্রসংগীত না, সবধরনের গানের চর্চা করে যেতে চান। সেই লক্ষ্যেই মূলত ধারকের জন্ম। ধারকে নজরুল গীতি, রবীন্দ্র সংগীত, পঞ্চ কবির গান, হারানো দিনের গান সবকিছু থাকবে। তবে ধারক এখন বন্ধ আছে। তবে শিঘ্রই ধারক আবার চালু হবে বলে আশা দেখছেন তিনি।

সুরের জাদুকর নির্ঝর চৌধুরি শুধু গানের মাঝেই নিজেকে সীমাবদ্ধ করে রাখেন নি। গানের পাশাপাশি তিনি উপস্থাপক হিসেবেও পেয়েছেন ব্যাপক জনপ্রিয়তা। বিভিন্ন টিভি শো এবং স্টেজ পারফরমেন্সেও সঞ্চালকের ভূমিকায় দেখা যায় তাকে। দীপ্ত টিভি, চ্যানেল আই, এটিএন বাংলা ও যমুনা টিভিতে সঞ্চালক হিসেবে অসংখ্যবার তিনি অনুষ্ঠান পরিচালনা করেছেন। দীপ্ত টিভিতে তিনি রান্নার অনুষ্ঠান পরিচালনা করতেন। এই প্রসঙ্গে জানতে চাইলে তিনি বলেন, রান্নার প্রতি তার আগ্রহ অনেক আগে থেকেই। যখনই তিনি কোন কারনে অন্যমনষ্ক থাকেন বা কোন কিছু নিয়ে খারাপ লাগা কাজ করে তখন তিনি রান্না করেন। তিনি আরও জানান, সঞ্চালক হিসেবে তার আত্মপ্রকাশ ছায়ানটেই। ছায়ানটে প্রতিবছর নবীন বরণ ও পুরষ্কার বিতরণী অনুষ্ঠান হয়। এক বছর ছায়ানটের অধ্যক্ষ তাঁকে ডেকে বলেন সঞ্চালনা করতে হবে। তখন থেকেই মূলত তিনি সঞ্চালক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন।

এছাড়াও তাঁর আরও একটি বড় পরিচয় হলো তিনি একজন মনোবিজ্ঞানী। জানতে চেয়েছিলাম সংগীতের সাথে মনোবিজ্ঞানের কোন সম্পৃক্ততা আছে কি না। এই প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, শিল্প ও সাহিত্যের সাথে সংগীতের এক মেলবন্ধন আছে। ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিতে মিউজিক থেরাপি বেশ জনপ্রিয় বলে জানান তিনি। বাংলাদেশে মিউজিক থেরাপির খুব বেশি প্রয়োগ দেখা যায় না এখনো। তবে খুব অল্প পরিসরে মিউজিক থেরাপি প্রচলিত আছে। তিনি যেহেতু সংগীতের শিক্ষকতার পাশাপাশি একজন মনোবিজ্ঞানি সেক্ষেতে তিনি ভবিষ্যতে মিউজিক থেরাপি নিয়ে কাজ করতে চান। এখন অল্প পরিসরে এটি শুরু করেছেন এবং ভবিষ্যতে আরও বড় পরিসরে কাজ করার পরিকল্পনা করছেন বলেও জানিয়েছেন তিনি। তাঁর কাজের ক্ষেত্রটা বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুদের জন্য হবে বলেও তিনি জানিয়েছেন। এই কাজে তিনি আত্মতৃপ্তি খুঁজে পান।

বর্তমানে ১৮-২৪ বছর বয়সী ছেলেমেয়েদের মাঝে আত্নহত্যা প্রবণতা অনেক বেশি। তারা একাকিত্বে ভোগেন, হতাশায় থাকেন এবং এর ফলে দেখা যায় হয় আত্মহত্যা করেন কিংবা বিভিন্ন অনৈতিক কাজ করেন। যেহেতু নির্ঝর চৌধুরী লুবনা মরিয়মের প্রতিষ্ঠিত স্কুল ‘কল্পতরু’ তে অধ্যক্ষ হিসেবে আছেন সেজন্য তার কাছে প্রশ্ন ছিলো তরুনদের জন্য কল্পতরু কোন কাজ করছে কি না? উত্তরে তিনি জানান, কল্পতরু মূলত গুলশান বনানির উচ্চবিত্ত পরিবারের সন্তানদের বাংলা সাহিত্য সংস্কৃতির সাথে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার উদ্যেশ্য নিয়ে প্রতিষ্ঠা করা হয়। গুলশান বনানিতে ছেলেমেয়েরা সব ইংরেজি মাধ্যমে পড়াশোনা করে। আর সম্পূর্ণ বাইরের সংস্কৃতির সাথে তাল মিলিয়ে পড়াশোনা করার কারনে দেখা যায় তারা বাংলাটাও ঠিকমতো উচ্চারণ করতে পারে না। বাংলা সংস্কৃতর সাথে তাদের সেভাবে পরিচয় হয়ে উঠে না। আর নিজের সংস্কৃতি সম্পর্কে ভালোভাবে না জানলে দেশপ্রেমও জাগ্রত হয় না। তাই কল্পতরু আমাদের সংস্কৃতির বিষয়গুলো তাদের সামনে তুলে ধরার চেষ্টা করে। তিনি আরও বলেন, যান্ত্রিকতার কারনে আমরা একা হয়ে যাই। এককেন্দ্রিক চিন্তাভাবনার কারনে শেয়ারিং-কেয়ারিং এই ব্যাপারগুলো এখনকার ছেলেমেদের মাঝে আসে না। ছোটবেলায় কেউ যদি আমাদের প্রিয় বন্ধু কে জানতে চাইতো আমরা দ্বিধায় পড়ে যেতাম। কেননা আমাদের প্রিয় বন্ধু কখনো একজন ছিলো না, আমাদের অনেক বন্ধু ছিলো। কিন্তু বর্তমানে ছেলেমেয়েদের জিজ্ঞেস করলে দেখা যায় বেশিরভাগেরই কোন বন্ধু নেই। যদি বন্ধু থাকেও তবে প্রিয় বন্ধুর তালিকায় কারোরই নাম তারা দিতে পারে না। এসবের কারনেই আত্নহত্যা, হতাশা এসব বেড়েই চলছে। তবে তিনি বলেন, কল্পতরু প্রত্যক্ষ ভাবে হতাশা, আত্মহত্যা কিংবা তরুন প্রজন্মের মানসিক বিকাশ নিয়ে কাজ না করলেও পরোক্ষ ভাবে করছে। কেননা, প্রতিটা সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন বন্ধুত্বের বন্ধন তৈরি করে। একসাথে নাচ, গান, আবৃত্তি এসবের চর্চার ফলে তাদের মানসিক বিকাশ হয়, শিশুরা ধীরে ধীরে সামাজিক হয়ে উঠে, তাদের মাঝে শেয়ারিং ও কেয়ারিং এর বোধের সৃষ্টি হয়।

তিনি বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রে সফররত আছেন এবং বিভিন্ন ধরনের অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করছেন। প্রবাস জীবনের অভিজ্ঞতা জানতে চাইলে তিনি বলেন, প্রবাসীরা দেশকে অনেক মিস করেন। বর্তমানে দেশীয় সংস্কৃতি ও কৃষ্টি এসব থেকে মানুষজন দূরে সরে যাচ্ছে। তবে তিনি এটাও জানান, বর্তমানেও অনেক রুচিশীল শ্রোতা রয়েছেন। প্রত্যেকে পুরনো দিনের গানগুলো উপভোগ করেন, হারানো দিনের গানগুলোতে তারা ভালোবাসা খুঁজে পান। এসব দেখে তিনি মুগ্ধ হোন। আরও বেশি করে হারানো গানগুলোকে তখন আকড়ে ধরতে ইচ্ছা হয় তাঁর। সেজন্যই তো আধুনিকতার চেয়েও হারানো দিনের গানগুলো বেশি টানে তাঁকে।

নির্ঝর চৌধুরী বর্তমান বাংলা চলচ্চিত্রে ভিন্ন এক মাত্রা যোগ করেছেন। কিভবে পরিচালক হিসেবে তার আত্নপ্রকাশ ঘটে এই প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, সংগীত পরিচালক হিসেবে তার আত্নপ্রকাশ খুব বেশি দিনের নয়। ২০০৮ সালে ‘মাটির সুরে’ এলবামের মাধ্যমে তিনি পরিচালক হিসেবে নিজেকে উপস্থাপন করেন। এরপরে আরও প্রায় ১০ টি মিশ্র এলবাম পরিচালনা করেছেন তিনি। কোভিডের সময়ে পন্মপূরাণ সিনেমার মাধ্যমে বাংলা চলচ্চিত্রে সংগীত পরিচালক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন তিনি। তবে যদিও তার পরিচালনা করা গানটি আর থাকে না সিনেমাটিতে কিন্তু ওই গানের সুবাদে আরও অনেক চলচ্চিত্রে সংগীত পরিচালক হিসেবে কাজ করার সুযোগ হয়েছে তাঁর। কমার্শিয়াল দুটি সিনেমা -বিফোর আই ডাই ও ফুলজান সিনেমার জন্য গান রচনা করেন তিনি। এরইমধ্যে আফজাল হোসেনের পরিচালিত ‘মানিকের লাল কাঁকড়া’ সিনেমাতে ৩টি গান রচনা করেন এবং ওয়েব ফিল্ম ‘ডার্ক রুমের’ জন্যও তিনি গান লিখেছেন।

মানুষ নিজে যতই সফল হোক একটা নির্দিষ্ট সময় পর গিয়ে প্রত্যকেরই শান্তির দরকার হয়। কেননা ক্লান্তি, মন খারাপ, হতাশা সবার জীবনেই আসে। নির্ঝর চৌধুরীও তার ব্যতিক্রম নয়। তিনি কান্ত হয়ে গেলে মনকে শান্ত করার জন্য কী করেন? এই প্রশ্নের উত্তরে তিনি জানান, গান তার নিত্যসঙ্গী তাই অনেকে মন খারাপে গান শুনলেও তিনি শোনেন না। কেননা গান তাকে আরও আবেগপ্রবণ করে তোলে। তিনি ইয়োগা করেন ও মেডিটেশন করেন। মেডিটেশন করলে তার মন ভালো থাকে। তাই প্রতিদিন অল্প সময়ের জ্যন হলেও, নিজেকে ধরে রাখার জন্য তিনি মেডিটেশন করেন।

এই গুণী শিল্পী ২০০৫ সালে শাস্ত্রীয় সংগীত বিভাগে জাতীয় পর্যায়ের সেরা পুরষ্কার অর্জন করেন।
সকলের মন জয় করা এই শিল্পী ১০ বছর পরেও নিজেকে একজন সুখী ও সুস্থ মানুষ হিসেবে দেখতে চান। কেননা প্রতিটা মানু্ষেরই জীবনের একমাত্র উদ্যেশ্য সুখ শান্তি অর্জন। এই সুখ শান্তি অর্জন করতে গিয়েই মানুষের জীবনে এতো সংগ্রাম, এতো কষ্ট, এতো চাহিদা। প্রেম, ভালোবাসা ও সফলতা এসবের মাঝে সুখ খুঁজতে গিয়ে মানুষ অনেক সময় জীবনের মানে হারিয়ে ফেলে, প্রকৃত সুখ-শান্তি হারিয়ে ফেলে। তাইতো তিনি আজ থেকে ১০ বছর পরেও নিজেকে সুখী মানুষ হিসেবে দেখার ইচ্ছা পোষণ করেন।