ড. আসিফ নজরুল বাংলাদেশের মানুষের কাছে অত্যন্ত জনপ্রিয় ও পছন্দের একজন মানুষ। স্পষ্টবাদী এ মানুষটি একাধারে একজন শিক্ষক, লেখক, ঔপন্যাসিক, রাজনীতি-বিশ্লেষক, সংবিধান বিশেষজ্ঞ ও কলামিস্ট। জীবিকাসূত্রে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক। তবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগদানের পূর্বে আসিফ নজরুল ও আমি একই অফিসে সহকর্মী ছিলাম। দীর্ঘদিনের পুরনো এই গুণী সহকর্মীর সাথে ৩০ বছর পর কথা বলতে পেরে সত্যিই অনেক ভাল লাগছিল। আসিফ নজরুলের নামটা শুনতে এখন অনেক ভারিক্কি লাগলেও আমার কাছে এখনো আসিফ নজরুল মানে সেই তারুণ্যে ভরপুর সাংবাদিক, সাপ্তাহিক বিচিত্রার প্রদায়ক, কয়েক ঘন্টার নোটিশে যার কাছ থেকে আসে দুর্ধর্ষ কাভার স্টোরি।
তবে তার নাম আসিফ নজরুল হওয়ার গল্পটা বেশ চমৎকার। তার আসল নাম মোঃ নজরুল ইসলাম। বিচিন্তায় তিনি লেখালেখি শুরু করেন, সম্পাদক ছিলেন মৃণাল মাহমুদ, উনি প্রায়শ বিরক্ত হতেন তার এই নামের জন্য। কারণ তার সার্টিফিকেটের নামটা বাংলাদেশে ছড়াছড়ি, তার ভালো লেখাগুলোর ক্রেডিট কোন নজরুল ইসলামের কাছে যায় বোঝা মুশকিল। তাই মিনার মাহমুদই তাকে নামের পরিবর্তন করতে বলেন। অতঃপর তার ছোটবেলায় যত নাম ছিল সেসব নিয়ে বসা হলো। তার বড় ভাইয়ের রাখতে চাওয়া নাম আসিফই শেষ পর্যন্ত চুড়ান্ত হলো। এভাবেই মোঃ নজরুল ইসলাম হয়ে গেলেন সবার প্রিয় আসিফ নজরুল।
ডঃ আসিফ নজরুলের জ্ঞানের পরিধিটাও বিশাল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর, ইউনিভার্সিটি অফ লন্ডন থেকে পিএইচডি, জার্মানি থেকে পোস্ট ডক্টরাল করে দেশে ফিরে আবার সেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েই যোগাদান করেন শিক্ষক হিসেবে। বাইরের অর্থ ও খ্যাতি ছেড়ে তাঁর দেশে ফিরে আসার টান এবং দেশের প্রতি অগাধ ভালোবাসা আমাকে মুগ্ধ করেছে। তবে তার মতে তার সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি দেশের মানুষের অগাধ ভালোবাসা। দেশ, জাতি, শিক্ষা নিয়ে গভীরভাবে ভাবেন তিনি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসেবে এই ঐতিহ্যবাহী বিদ্যাপীঠ নিয়ে তার ভাবনা অনেককেই ভাবতে সাহায্য করবে।
তার মতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ভাগ্যবান একটি প্রতিষ্ঠান, সেখানে সারাদেশ থেকে মেধাবীরা এসে একত্রিত হয়। তবে তিনি মনে করেন, এখান থেকে যত মেধাবী, জ্ঞানী-গুনী বের হয়েছেন তার ক্রেডিট শুধু বিশ্ববিদ্যালয়ের না। বিভিন্ন দেশের বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রাপ্ত অভিজ্ঞতা থেকে বিবেচনা করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ হিসেবে মানতে তিনি সন্দেহ প্রকাশ করেন। তিনি যেই জায়গাটি বিশেষ করে দেখিয়েছেন যে, স্কুল আর কলেজের সাথে বিশ্ববিদ্যালয়ের যে পার্থক্য ‘নলেজ প্রডিউস ও ইউটিলাইজ করা’, সেখানে কীভাবে পিছিয়ে রয়েছে এই বিদ্যাপীঠ। কলম্বিয়া, হার্ভাড, ইয়েল ও নামকরা নানা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে বড় বড় বিনোয়গকারীরা সেখানে বিনিয়োগ করে, বিভিন্ন গবেষণা, নতুন আবিষ্কার হয় তাই। কিন্তু ঢাবির ক্ষেত্রে তিনি হতাশা প্রকাশ করে জানান, কিছু ব্যতিক্রম ব্যতীত সবাই গতবাধা বই রিডিং আর মুখস্ত পড়ায়। নলেজ ক্রিয়েশনের নিম্নমান, পুরাতন পদ্ধতিতে পাঠদানের পরেও বিশ্ববিদ্যালয়ের যা সাফল্য, তিনি তার কৃতিত্ব দিতে চান শিক্ষার্থীদের।
তবে বর্তমান এই বিশ্ববিদ্যালয়ের কালচারাল মানের অবনতি আরও ভয়াবহ। শিক্ষার্থীদের অনেকাংশের কাজ তাকে ব্যথিত করে। অন্যায় অবিচারের বিরুদ্ধে প্রথম রুখে দাঁড়ানো এই প্রতিষ্ঠান, অনেকাংশে তার ঐতিহ্য ভুলে গিয়েছে।
নিজের লেখালেখি ও নানা বিষয়ের জন্য বেশ কিছু নাটকীয় মামলার জালে আটকে আছেন তিনি। দেশের চিন্তা করেও আছেন যেন আরেক বিপদে। এই মামলা মোকদ্দমার ভয় কিছুটা প্রভাব ফেলেছে তার লেখালেখিতে। আগের মতো চাইলেই মন প্রাণ খুলে লিখতে পারেন না বলে জানান।
তবে এমন জ্ঞানী প্রতিভাবান মানুষ অনেকের ভালোবাসা পাবেন সেটাই সত্য। তিনি জানান ক্রান্তিকালে তিনি পাশে পেয়েছেন নানা বিশিষ্টজনকে। বিভিন্ন আইনজীবীর প্রতি কৃতজ্ঞতা জানান আসিফ নজরুল। এছাড়াও সুশীল সমাজের কথার উল্লেখ করেন তিনি।
কথা হচ্ছিল দেশের দুই নেত্রীকে নিয়ে৷ আলাপের মধ্যে একটা ইন্টারেস্টিং বিষয় তুলে ধরেন তিনি। তার মতে দেশ ও বিদেশি কিছু কুচক্রী মহল এই দেশের দুই নেত্রীর মধ্যে বৈরী সম্পর্ক তৈরীতে প্রভাবক হিসেবে কাজ করে। কারণ এতে সেই সব মানুষের স্বার্থ উদ্ধার হয়, বাংলাদেশকে দুর্বল করে। এই দুই নেত্রীর আশেপাশের স্বার্থান্বেষী মানুষগুলোই এই বাধা হয়ে দাঁড়িয়ে আছে, এই সম্পর্কের ফাটল হলে তাদের লাভ। তার মতে, যদি এই দুই নেত্রীর মধ্যে সুসম্পর্ক ও পারস্পরিক সম্মানবোধ থাকতো তবে দেশের আরও অগ্রগতি হতো। কথা হচ্ছিল দেশের বিভিন্ন ক্ষেত্রের উপদেষ্টা প্যানেল নিয়ে। তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করেন যে দেশে সৎ, নিষ্ঠাবান ও নির্মোহ লোক থাকা সত্ত্বেও দেশের বড় বড় এনজিও ও প্রতিষ্ঠানে তাদের কাজে লাগানো হয়না। গুনী লোকের কদর এদেশে যথাযথ হয়না তা নিয়ে তিনি দুঃখ প্রকাশ করেন।
ধর্ষকের ফাঁসি নিয়ে যখন বাংলাদেশের নানা মঞ্চ যখন সরব তখন আসিফ নজরুল প্রকাশ করেছেন ভিন্ন মত। তার যুক্তি ছিল এদেশে নারী ও শিশুরা সাধারণত ধর্ষণের স্বীকার হয় পরিচিত কারো দ্বারা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই। এইক্ষেত্রে ধর্ষণের শাস্তি মৃত্যুদন্ড দিলে তারা ভুক্তভোগীকে মেরে ফেলবে, পরিচয় প্রকাশের সাথে শাস্তির ভয়ে। তার মতে দেশে হয়রানি মূলক মামলা বেড়ে যেতে পারে। আইনের অপপ্রয়োগে ও আরো নানাধরণের বেআইনি কাজ বাড়বে। মূলত আজীবন স্বশ্রম কারাদন্ড বা নির্দিষ্ট সময়ের শাস্তি, যথাযথ ভাবে বাস্তবায়নের কথা বলেন। তিনি প্রশ্ন তোলেন, বিচারের জন্য মিডিয়ায় কেন ভাইরাল হতে হবে?
ইতিহাস ও ইতিহাসের বিকৃতি নিয়ে কথা হচ্ছিল। তার মতে, ইতিহাসের তো বিভিন্ন ধারণা থাকবেই, ইতিহাস তো অংক না তাই ভিন্নমত থাকবেই। তিনি আশা করেন, সঠিক ইতিহাসের চর্চা হবে ভবিষ্যতে। একজনের নাম বলতে গেলে আরেকজনের নাম মুছে ফেলার সংস্কৃতি পাল্টাতে হবে। বিভিন্ন মহল জিয়া মুজিবের বীরত্বকে ধারণ না করে বরং সেটাকে ব্যবহার করে নিজেদের স্বার্থে। তবে এদেশে যে বিকৃত ইতিহাস ব্যতিত অল্পকিছু বই আছে সে বিষয়েও উল্লেখ করেন।
আরেকটি বিষয় তিনি আলোকপাত করছিলেন নেতৃত্ব চর্চার ক্ষেত্রে জাতীয় রাজনীতিতে পরিবারের বাইরের যোগ্য লোকদের সুযোগের কথা। তিনি উল্লেখ করেন, আমেরিকার নির্বাচনের কথা। তিনি জানান যে, উত্তরাধিকার কেন্দ্রিক রাজনীতি ছাড়াও সে দেশে যথাযথভাবে রাজনীতি ও সরকার পরিচালিত হয়। বাংলাদেশের পররাষ্ট্র নীতি নিয়ে ভুল ধারণা ভাঙাতে কাজ করার পরামর্শ দেন তিনি। কথা প্রসঙ্গে ভারত বাংলাদেশর সম্পর্ক নিয়ে কথা হচ্ছিল। তিনি আশা করেন, বন্ধুত্বের আড়ালে যেন একপাক্ষিক সম্পর্ক না হোক। সত্যিকারের সুসম্পর্ক এই দুই দেশকেই আরও দৃঢ় করবে বলে মনে করেন।
দেশ ও জাতি নিয়ে আলোচনার পর আসিফ নজরুলের ব্যক্তিগত জীবনের প্রতি জিজ্ঞাসা তো কিছুটা স্বাভাবিক। প্রথমেই আসে জীবন সঙ্গীর কথা। স্ত্রী শিলাকে নিয়ে বলেন শিলা একজন ইকোনোমিস্ট, একটি এম্বাসিতে ইকোনমিক এডভাইসর হিসেবে কর্মরত আছেন। এর আগেও অনেক বড় কনসালটেন্সির কাজ করেছেন। শীলার মেধার প্রশংসায় আরেকটি জিনিস উল্লেখ করেন, তার জনপ্রিয়তা, খ্যাতির মোহ থেকে দূরে থাকার বিষয়টি। আসিফ জানান তার আরেকটি নতুন জন্ম হলে আল্লাহ যদি সুযোগ দেন তিনি শিলাকেই আবার তাঁর জীবনসঙ্গী হিসেবে চাইবেন।
আসিফ নজরুলের জীবনে আদর্শ মানুষ কারা এবং কাদেরকে তিনি আদর্শ হিসেবে মেনে চলেন এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি ইফতেখারুজ্জামান, ডাঃ কামাল, শাহাদাৎ চৌধুরী, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও জিয়াউর রহমানের মত ব্যক্তিত্বদের কথা উল্লেখ করেন। দুরদর্শী ও সৃজনশীল শাহাদাৎ চৌধুরীর জিয়াউর রহমানের শাসনামল নিয়ে করা “জিয়াউর রহমান সেভাবেই দেশ চালিয়েছেন যেভাবে বঙ্গবন্ধু দেশ চালাতে চেয়েছিল” উক্তিটি এখনও আসিফ নজরুল অবাক করে। তিনি জানান ডাঃ কামালের বঙ্গবন্ধুর প্রতি লয়্যালটি, জিয়াউর রহমানের দেশপ্রেম, বাংলাদেশের জন্মের জন্য বঙ্গবন্ধুর আত্মত্যাগ তাঁকে অনুপ্রেরণা দেয় এবং মুগ্ধ করে।
এসবের সাথে বাংলাদেশের চলচিত্র নিয়ে কথা হচ্ছিল। তিনি জানালেন দেশীয় চলচিত্র কম দেখা হয় তার। তারমধ্যে পছন্দের সিনেমা হলো তৌকিরের শ্যামল ছায়া, তারেক মাসুদেরর অনেক ছবি এবং মোস্তফা সারোয়ার ফারুকীর টেলিভিশন। পছন্দের তালিকায় বিদেশী লেখক অনেক। দেশের মধ্যে হুমায়ূন আহমেদ, সৈয়দ শামসুল হকের কিছু বই, মশিউরের গল্প, সাবের ভাই, আনিসুল হক। বাংলাদেশের লেখকদের বিচারে তিনি নিজেকে লেখক হিসেবে এ মাইনাস গোত্রের লেখক হিসেবে মনে করেন। তবে তিনি আরও ভাল কিছু লেখার স্বপ্ন দেখে যাছেন। তিনি জানান বিচিত্রায় লেখা আর টকশো – এ দুইটা কাজ তিনি তৃপ্তি নিয়ে করতেন এবং করেন।
মৃত্যুর পরে মানুষ তাঁকে কী হিসেবে মনে রাখবে এমন কথার প্রসঙ্গে তিনি অভিব্যাক্তি প্রকাশ করেন যে ঐ সময়ে মানুষ কী ভাববে সেটি নিয়ে তিনি মোটেই চিন্তা করেন না। তাঁর কাছে ঐ সময়ের সবকিছুই অর্থহীন। তবে একজন পিতা হিসেবে তিনি চান সন্তানরা যেন তাঁর মৃত্যুর পরে কখনও তাঁর নামে কোনো খারাপ কিছু না শোনে।
সর্বপরি, আসিফ নজরুলের সাথে কথা বলতে গিয়ে সময় কিভাবে গড়িয়ে গেল টের পাইনি। এমন গুনী ও সুবক্তার কথা শুনতে কখনও ক্লান্তি আসেনা। দেশমাতৃকার প্রেমে নিবেদিত প্রাণ আসিফ নজরুলরা যেন সোনার বাংলাদেশ গড়ে তুলতে পারেন এ প্রত্যাশা থাকলো।
—
ফটো: দৈনিক যুগান্তর