১৯৬৫ সালের জানুয়ারী থেকে ২০১১ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত, বাংলাদেশ টেলিভিশন এবং ভয়েস অব আমেরিকা বাংলা বিভাগ মিলিয়ে ৪৬ বছর দর্শক শ্রোতাদের নিয়ে ছিলেন মাসুমা খাতুন । এটি ছিল তার জীবন ও জীবিকা, পেশা ও নেশা। আর দর্শক শ্রোতারাই ছিলেন তার সকল কাজের অনপ্রেরণা। বাংলা ভাষায় প্রচারিত পৃথিবীর প্রথম টেলিভিশন অনুষ্ঠানমালা উপস্থাপন করেছেন আটবছর। বাংলাদেশের মহান […]

মাসুমা খাতুন : বাংলায় প্রচারিত পৃথিবীর প্রথম টেলিভিশন অনুষ্ঠানমালার উপস্থাপিকা

১৯৬৫ সালের জানুয়ারী থেকে ২০১১ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত, বাংলাদেশ টেলিভিশন এবং ভয়েস অব আমেরিকা বাংলা বিভাগ মিলিয়ে ৪৬ বছর দর্শক শ্রোতাদের নিয়ে ছিলেন মাসুমা খাতুন । এটি ছিল তার জীবন ও জীবিকা, পেশা ও নেশা। আর দর্শক শ্রোতারাই ছিলেন তার সকল কাজের অনপ্রেরণা বাংলা ভাষায় প্রচারিত পৃথিবীর প্রথম টেলিভিশন অনুষ্ঠানমালা উপস্থাপন করেছেন আটবছর। বাংলাদেশের মহান স্বাধীনতা আন্দোলন, ১৯৭০ সালের নির্বাচনে পূর্ব পাকিস্তানের বিপুল বিজয় এবং অবশেষে জল্লাদ পাক বাহিনীর গণহত্যার মুখে মুক্তিবাহিনীর যুদ্ধ ও বিজয়লাভ, পাকিস্তানের কারাগার থেকে স্বাধীন বাংলা দেশের মাটিতে বঙ্গবন্ধুর প্রত্যাবর্তন, ইন্দিরা গান্ধীর বাংলাদেশ সফর এমনি সব ঐতিহাসিক ঘটনার কথা দর্শকদের সামনে উপস্থাপন করছেন তিনিটেলিভিশনে তার সবচেয়ে প্রিয় কাজ ছিল বিভিন্ন অনুষ্ঠান উপস্থাপনা, ছোটদের আসর পরিচালনা, ক্যামেরায দর্শকদের চিঠিপত্রের জবাব, বিদেশী শিল্পী ও শিল্পীদলের পরিবেশনা উপস্থাপনা। তাদের নাম সঠিক উচ্চারন করা ছিল মাসুমা খাতুনের কাছে সবচেয়ে বড় চ্যালেন্জ।

মাসুমা খাতুনের কর্মজীবন শুরু হয় ১৯৬০ সালে ৷ পড়াশোনার বদলে ব্যক্তিগত কিছু কারণে তাকে পেশাজীবনে প্রবেশ করতে হয়৷ তিনি ক্লাস ৮ পর্যন্ত প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাগ্রহণ করেছেন এবং বেসরকারিভাবে মাধ্যমিক পাশ করেন৷ এইটুকু শিক্ষাগত যোগ্যতা নিয়েই তিনি পেশাজীবনে প্রবেশ করেন৷খুব বড় কিছু করার স্বপ্ন থেকে তিনি পেশাজীবনে প্রবেশ করেননি বরং কিছু একটা করার জন্যই তিনি চাকরিতে প্রবেশ করেন৷ পরিবারের সাথে তিনি থাকতেন মতিঝিলে৷ সেখানেই ছিল পি আই এ র অফিস৷ সেখান থেকে চাকরিতে যোগদানের প্রস্তাব পান তিনি ৷ সে লক্ষ্যে ৬ মাসের প্রশিক্ষণ গ্রহণ করলেও এরপর স্থায়ীভাবে যোগদানের বদলে ইস্তফা দেন৷ এরপর বড় ভাইয়ের পরামর্শে পাকিস্তান পর্যটন এ আবেদন করেন এবং সেখান থেকে অপ্রত্যাশিতভাবে চাকরির প্রস্তাব পান এবং যোগদান করেন৷ এরপর জীবিকাই হয়ে ওঠে তার জীবন ও শিক্ষার জায়গা তিনি চাকরির সুবাধে পাকিস্তানের ভৌগোলিক পরিবেশ, ইতিহাস ও ঐতিহ্য নিয়ে অনেক পড়ালেখা করেন৷ এর সুবাদে তাকে অফিস থেকে পর্যটকদের সাথে পাকিস্তানের বিভিন্ন দর্শনীয়স্থানে পাঠানো হত৷ তিনি তার এই পেশাজীবনে কোথাও বৈরিতার সম্মুখীন হন নি বরং সবখানে সবার স্নেহ ও সমীহ পেয়েছেনএভাবেই তিনি তার পেশাজীবনে প্রবেশ করেন৷ 

তিনি টেলিভিশনে যোগদান করেন ১৯৬৫ সালেতখন থেকেই দেশের পরিস্থিতি অশান্ত হতে শুরু করেছিলসবকিছুই অনেক সংগ্রামের মাধ্যমে টেলিভিশনে প্রচার করতে হত৷ তিনি সে সময় ১৯৬৫ সালের ভারত – পাকিস্তান যুদ্ধ নিয়ে কাজ করেন টেলিভিশনে৷ ১৯৭০ সালের নির্বাচন সংক্রান্ত অনুষ্ঠান পরিচালনার দায়িত্ব ও লাভ করেন এ নির্বাচন নিয়ে তার অভিজ্ঞতাও হয় দারুণতবে শেষ পর্যন্ত এ নির্বাচনই ডেকে আনে অনেকের জীবনের শেষ এবং জন্ম হয় এক নতুন দেশের৷ ২৩ মার্চ ১৯৭১ সালে অনুষ্ঠান প্রচারের সময় পাকিস্তানের পতাকা প্রদর্শন ন্স করায় তিনি চাকরিও হারিয়ে ফেলেন। 

মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময় তিনি ভয়েস অব আমেরিকায় পরীক্ষা দেন এবং ১৯৭২ সালে তার ডাক আসে৷ ১৯৭৩ সালের জুলাই মাসে তিনি ভয়েস অব আমেরিকাতে যোগদান করেন তার স্বামীর সাথে মিলে ১৯৯৫ সালে শুরু করেন ‘ বাংলা ভালবাসি’ নামে একটি অনুষ্ঠান যা তুমুল জনপ্রিয়তা লাভ করে২০০৭ সাল পর্যন্ত অনুষ্ঠান প্রচারিত হতএটি ছিল তার কাছে সবথেকে আনন্দের কাজ। 

সাংস্কৃতিক বিপ্লব পোশাকের পরিবর্তন নিয়ে মাসুমা খাতুন বলেন, তিনি মনে করেন না সাংস্কৃতিকভাবে আমরা পেছনের দিকে চলে যাচ্ছিএখন পুরো বিশ্ব আমাদের হাতের মুঠোয়নারীরা বিভিন্ন কাজে দূর-দূরান্তে বেরিয়ে পরছেনযার কারণে শাড়িতে প্রতিদিনের কাজ করা সম্ভব হয়ে উঠছে নাতাই পোশাকের পরিবর্তনকে তিনি খুব গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করেন নাতবে তিনি শালীনতার বিষটিকে গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করেন এবং বর্তমান দুনিয়ায় পোশাককে তিনি খুব বেশি গুরুত্বপূর্ণ মনে করেন না। 

বাংলাদেশের বিরাট জনসংখ্যা এবং এখনকার সমাজ বাস্তবতায় মেয়েরা নানান কাজে ঘরের বাইরে বের হচ্ছেযৌন হয়রানি ধর্ষণের পিছনে তিনি যাতায়াত ব্যবস্থাকে কিছুটা দায়ী মনে করেনএছাড়াও আইন ব্যবস্থায় নিরাপত্তার অভাব, সামাজিক অবক্ষয় এর পেছনে দায়ীএসব রোধে তিঞ্জ মনে করেন নিরাপত্তা সংখ্যা, নারী সংগঠন এবং পুরুষদের এগিয়ে আসতে হবেদোষীদের কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবেএতে ধরনের কাজ কমতে পারে বলে তার অভিমততবে তিনি এসকল অপ্রীতিকর ঘটনার থেকে সামগ্রিক উন্নতিকেই বেশি গুরুত্ব দেন৷ নারী স্বাধীনতা এবিং নারীর স্বনির্ভরতাকেই তিনি গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে দেখেনএছাড়াও নারীর বিরুদ্ধে হয়রানি মূলক বিভিন্ন ঘটনা গুলো যে মেয়েরা সামনে আনছে প্রকাশ করছে বিষয়গুলোকে তিনি ইতিবাচক হিসেবে দেখেন। 

ছেলেবেলা থেকেই প্রচন্ড সাহিত্যানুরাগী মানুষ মাসুমা খাতুননজরুল রবীন্দ্রনাথ তার জীবিনে অনেক বড় প্রভাব রেখেছেনতিনি তাদের কবিতা লেখাগুলো পড়তেন এবং এখনো পড়েনতিনি মনে করেন এই দুইজন না থাকলে তিনি  হয়ত দুদন্ড নিশ্বাস নিতে পারতেন না কিংবা বাঁচতে পারতেন নাতিনি একজন অসাধারণ আবৃত্তি শিল্পীও বটে।