ভয়েস অব আমেরিকা (ভিওএ) বাংলা বিভাগের প্রধান জনপ্রিয় বেতার-মাল্টিমিডিয়ার নারী সাংবাদিক রোকেয়া হায়দার।বাংলাদেশের সাংবাদিকতায় রোকেয়া হায়দার নিজেকে অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছেন। তিনি আজ নারী সাংবাদিকতার অহংকার। অনেক প্রতিকূলতার মধ্যেও তিনি সাহস হারাননি। আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে এগিয়ে গেছেন। নিজের মেধা, যোগ্যতা ও পেশার প্রতি দায়িত্বশীল ছিলেন বলেই তিনি সফলতা পেয়েছেন। শাড়ি পরে সাংবাদিকতা করা যায়, যার একমাত্র […]

সাংবাদিকতায় অনন্য নামঃ রোকেয়া হায়দার

ভয়েস অব আমেরিকা (ভিওএ) বাংলা বিভাগের প্রধান জনপ্রিয় বেতার-মাল্টিমিডিয়ার নারী সাংবাদিক রোকেয়া হায়দার।বাংলাদেশের সাংবাদিকতায় রোকেয়া হায়দার নিজেকে অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছেন। তিনি আজ নারী সাংবাদিকতার অহংকার। অনেক প্রতিকূলতার মধ্যেও তিনি সাহস হারাননি। আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে এগিয়ে গেছেন। নিজের মেধা, যোগ্যতা ও পেশার প্রতি দায়িত্বশীল ছিলেন বলেই তিনি সফলতা পেয়েছেন। শাড়ি পরে সাংবাদিকতা করা যায়, যার একমাত্র উদাহরণ রোকেয়া হায়দার। তাই আজ তিনি ভয়েস অব আমেরিকার মতো আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানের বাংলা বিভাগের প্রধান সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।

১৯৬৮ সালে চট্টগ্রাম বেতারের নিয়মিত অনুষ্ঠান ঘোষিকা হিসাবে জীবন শুরু করেন। ১৯৭৪ সালে পেশাদার সাংবাদিক হিসেবে কাজ শুরু করেন। তখন থেকেই ঢাকা বেতার ও টিভিতে নিয়মিত খবর পড়তেন।১৯৮১ সালে যুক্তরাষ্ট্রের ভয়েস অব আমেরিকার (ভিওএ) আমন্ত্রণে ওয়াশিংটন ডিসিতে যান। সেই থেকে পুরাদস্তুর সাংবাদিক বনে যান। ২০১১ সাল থেকে ভিওএ’র বাংলা বিভাগের প্রধানের দায়িত্ব পালন করেন। আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠানের বাংলা বিভাগে তিনিই প্রথম নারী।৩৭ বছরের পেশাগত দায়িত্ব পালনে অসামান্য কৃতিত্বের জন্য আমেরিকার সম্মানজনক ‘অল স্টার অ্যাওয়ার্ড’ রোকেয়া হায়দারের ঝুড়িতে এসেছে।

ছেলে বেলা থেকেই কথা বলতে প্রচন্ড ভালবাসতেন রোকেয়া হায়দার। তিনি বেড়ে ওঠেন কলকাতায় এবং সেখানে ছিলেন মাধ্যমিক পর্যন্ত। মাধ্যমিকে পড়ার সময় স্কুলের ক্লাস থেকেই কথা বলার শুরু তার। এরপর কলকাতায় অবস্থানকালীন সময়ে আকাশবাণীতে কবিতা আবৃত্তি করেছেন এবং সেখানেই অনুষ্ঠান ঘোষিকা হিসেবেও কাজ করেছেন। এরপর যখন চট্টগ্রামে চলেন আসেন সে সময় বড় বোনের সাথে চট্টগ্রাম বেতারে যেতে শুরু করেন। চট্টগ্রাম বেতারের তৎকালীন আঞ্চলিক মহাপরিচালক আশরাফুজ্জামানের হাত ধরে সংবাদ পাঠ শুরু করেন৷ এভাবেই শুরু এরপর শুধুই এগিয়ে গেছেন স্বমহিমায়৷

রোকেয়া হায়দার বলেন, প্রতিটি পরিবারের হাল ধরে থাকেন একজন মা। পরিবারে মা বা বোনের উপস্থিতি না থাকলে সে পরিবার অনেকটাই অগোছালো থাকে। বাংলাদেশ নারীর ক্ষমতায়ন বা উন্নয়নে অনেকখানি এগিয়েছে এবং অনেক বিধিনিষেধ থাকার পরও বাংলাদেশ এ বিষয়ে অনেক সাফল্য পেয়েছে যা বিশ্বব্যাপী সমাদৃত।  একটা সময় পরিবারের হাল ধরবে ছেলে সন্তান এরকম ধারণা প্রচলিতে থাকলেও এখনকাএ সমাজ বাস্তবতায় ছেলে মেয়ে উভয়েই পরিবারকে নিজেদের সর্বোচ্চটাই দিচ্ছে। পরিবারের মা তার সবটুকুই পরিবারকেই দেন যা সকল সমাজ ব্যবস্থা বা সংস্কৃতির জন্য সত্য।  পাশ্চাত্য সমাজের দিকে তাকালে আমরা দেখি নারীদের বিভিন্ন সময় তাদের ন্যায্য অধিকার নিয়ে আন্দোলন করতে হয়েছে। ন্যায্য মজুরি বা ভোটের অধিকার অনেক আন্দোলনের পর তারা পেয়েছে। সেখানে বাংলাদেশের দিকে তাকালে আমরা দেখি সেই স্বাধীনতালগ্ন থেকেই রাজনৈতিক অধিকার পেয়েছেন আমাদের নারীরা। আমাদের প্রধানমন্ত্রী, বিরোধীদলীয় নেত্রী কিংবা স্পিকার সবাই একজন নারী। নারীর ক্ষমতায়নে অন্য অনেক দেশের চেয়ে আমরা অনেক এগিয়ে আছি।

নারীর যৌন হয়রানি এবং ধর্ষণ এর বর্বরতা রোধে সবার আগে দরকার দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন। প্রায় সব সমাজেই দেখা যায় নারীর বিরুদ্ধে হওয়া নানা হয়রানির জন্য নারীকেই দোষারোপ করা হয়, তার পোশাক সম্পর্কে কথা বলা হয়। এছাড়াও ধর্ষণ বা নির্যাতনের শিকার নারীদের বিভিন্নভাবে বিব্রত করা হয়৷ এ সমস্যা দেখে উত্তরণের জন্য পুরুষের মনমানসিকতায় পরিবর্তন আনতে হনে পাশাপাশি পুরো সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন করতে হবে। শিক্ষা, সংস্কৃতি, সমাজ এই তিনের ভূমিকা বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। পেশাগত জীবনেও নারীরা অনেক অন্যায়ের শিকার হন। সে ক্ষেত্রগুলোয় তাদের নিজেদের যোগ্যতায় মোকাবিলা করতে হবে এবং এগিয়ে যেতে হবে।

পেশাজীবনের পুরোটা সময়ই তিনি শাড়িপরে দায়িত্ব পালন করেছেন এমনকি ক্রীড়া সাংবাদিকতাও করেছেন এই শাড়িতেই। তবে রোকেয়া হায়দার মনে করেন তার পোশাকের কারণে অনেকখানে সমীহ পেয়েছেন যা তার পেশাগত জীবনে সহায়ক হয়েছে। তিনি তৎকালীন ফিফা সভাপতি সেফ ব্ল্যাটারের একটি সাক্ষাৎকার নিয়েছিলেন যা ভয়েস অফ আমেরিকার নিউজরুমে এবং বাংলায় প্রচারিত হয়েছিল। তিনি বিশ্বাস করেন এগিয়ে যেতে হবে৷ যেখানে প্রয়োজন সেখানেই নিজের মত করে অগ্রসর হতে হবে।

স্বামীকে হারান ১৯৭১ এ। তিনি এখনকার সেই সময়টাকে মনে করতে চান না। প্রায় ২০ দিন চট্টগ্রামে একা ছিলেন সন্তানদের নিয়ে। সেখান থেকে পাকিস্তান আর্মির চোখ ফাঁকি দিয়ে তিনি কিভাবে বাবা মার কাছে পৌঁছান তা এখনো তার কাছে অবিশ্বাস্য লাগে। এ কারণে এখনো সেই মুক্তিযুদ্ধের সময়ের দিকে তাকালে তিনি বাধাগ্রস্ত হয়ে পড়েন। সে সময়টাকে তিনি তার স্মৃতিতে রাখতে চান না।

বাংলাদেশ উন্নয়ন,নারীর ক্ষমতায়ণ বা অর্জনে অনেক দূর এগিয়ে গেছে৷তবে রাজনৈতিক প্রতিহিংসা, দুর্নীতি, পরমতসহিষ্ণুতার অভাব এ দেশকে বিভিন্ন সময় বিভিন্নভাবে কলুষিত করছে। এ থেকে উত্তরণে সরকারের পাশাপাশি জনগণকেও বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখতে হবে বলে মনে করেন তিনি। এছড়াও নতুন প্রজন্ম যারা আগামীর নেতৃত্বে আসবে তাদেরকেও এ ব্যাপারগুলোয় সচেতন থাকতে হবে। পাশাপাশি নারী পুরুষের সমান অধিকার নিশ্চিত করতে হবে সবক্ষেত্রে তাহলেই দেশ এগিয়ে যাবে।

রোকেয়া হায়দার তার জীবনে পেশাগত কারণে অনেক বিখ্যাত মানুষের সাক্ষাৎকার নিয়েছেন। তবে এর মাঝে তার নেওয়া মাদার তেরেসার সাক্ষাৎকারটি তার কাছে চির স্মরণীয়। অনেক চেষ্টার ফসল হিসেবে ১৯৮৭ সালে তিনি মাদার তেরেসার সাক্ষাৎকার নিয়ে সফল হন।

ছেলেবেলা থেকে ক্রিকেটের দারুণ ভক্ত ছিলেন তিনি। এরপর যুক্তরাষ্ট্রে এসে টেনিস খেলার প্রতি তার আগ্রহ জন্মায়৷ ক্রিকেটারদের মধ্যে সৌরভ গাঙ্গুলী, শচীন টেন্ডুলকার, সাকিব আল হাসান বা মোহাম্মদ আশরাফুল সবাই তার অনেক পছন্দের। তবে বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের প্রতি তিনি সবসময় আলাদা একটা টান অনুভব করেন। শৈশবে তার প্রিয় ক্রিকেটার ছিলেন নীল-সবুজ চোখের পাকিস্তানি ক্রিকেটার ফজল মাহমুদ। এই ক্রিকেটারের প্রতি তার বিশেষ একটা আকর্ষণ কাজ করত৷ এভাবেই তার ক্রিকেটের প্রতি ভাল লাগার শুরু এবং এ কারণে পেশাগত জীবনেও অনেক সাফল্যও পেয়েছেন তিনি।

লিখেছেনঃ রোমান উদ্দীন