১৯৬০ বা ৭০ এর দশকে রেডিও শুনেছেন অথচ সরকার কবির উদ্দিনকে চিনবেন না এমন লোক পাওয়া দুষ্কর। তৎকালীন রেডিও পাকিস্তান করাচি থেকে প্রচারিত বাংলা খবর ঢাকাসহ চট্টগ্রাম, রাজশাহী, খুলনা, রংপুর ও সিলেট কেন্দ্র থেকে রিলে করা হতো। যাদুকরী কন্ঠের মুগ্ধতায় আচ্ছন্ন হয়ে সংবাদ পাঠক হিসেবে সবাই মনের অজান্তেই ভালোবেসে ফেলেছিলেন তাকে। তিনি ব্রডকাস্ট মিডিয়ার অতি নন্দিত জন তথা বেতারের কিংবদন্তি সংবাদ পাঠক সরকার কবির উদ্দিন। রেডিও পাকিস্তান থেকে পরবর্তীতে বাংলাদেশ বেতার ঢাকা অতঃপর ভয়েস অফ আমেরিকার বাংলা বিভাগে সুদীর্ঘ চার দশক কর্মজীবন শেষ করে এখন অবসরে। তিনি ভিওএ বাংলার সাবেক ম্যানেজিং এডিটর। তিনি একটা সময় ছিলেন বিখ্যাত নায়ক ও।
সরকার কবির উদ্দিনের ছোটবেলা থেকেই শখ ছিল চলচ্চিত্রে অভিনয়ের। ছেলে বেলার এই স্বপ্ন একটা সময় পূরণ হলেও পরে সেখান থেকে সরে আসেন। কারণ মিডিয়াতে মানুষ যেভাবে চায় সবসময় সেভাবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করতে পারে না৷ দর্শক শ্রোতারা যেভাবে যে পরিচয়ে চায় সেই পরিচয়েই প্রতিষ্ঠিত হতে হয়। তাকেও দর্শক শ্রোতারাই টিভি ও বেতার শিল্পী হিসেবেই প্রতিষ্টিত করেছে। এছাড়াও পারিবারিক কারণে সিনেমা থেকে সরে আসতে হয় সরকার কবির উদ্দিনকে।
সরকার কবির উদ্দিন সাংবাদিকতা শুরু করেন চলচ্চিত্রে আসার অনেক আগেই সেই ১৯৬০ এর দশকে। শুরুটা হয় করাচি সেন্ট্রাল কলেজের ছাত্র থাকা অবস্থায়। সেই সময়ই রেডিও তে খবর পড়া শুরু করেন। তিনি নিখিল পাকিস্তান সংবাদে খবর পাঠ করতেন যা পুরো পাকিস্তানের সব রেডিও স্টেশনে প্রচার করা হত। এ সুযোগ লাভের জন্য পরীক্ষা দিয়েছিলেন এবং সেখানে প্রথম স্থান অধিকার করেছিলেন। এরপর ১৯৬৪ সালে পাকিস্তান টিভি চালু হলে সেখানে বাংলায় সংবাদ পাঠ শুরু করেন তিনি। পাশাপাশি তিনি পি আই এ তেও প্রশিক্ষক হিসেবে যোগ দেন। এভাবেই পেশাগত জীবন শুরু করেন সরকার কবির উদ্দিন৷ এরপর ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের পর তিনি পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশে চলে আসেন এবং বাংলাদেশ বিমানে যোগদান করেন। ভয়েস অব আমেরিকাতে যোগদানের আগ পর্যন্ত বাংলাদেশ বিমানের জনসংযোগ দপ্তরের প্রধান হিসেবে কর্মরত ছিলেন তিনি। ১৯৮৪ সালে তিনি ভয়েস অব আমেরিকাতে যোগদান করেন। কন্যার মৃত্যু এবং একারণে স্ত্রীর দেশ ছাড়তে চাওয়া তাকে এই চাকরিতে যোগদানের একটা বড় কারণ ।
৬০ বছরের কর্মজীবন সরকার কবির উদ্দিনের। টিভি ও রেডিওতে কাজ করা প্রতিটি মুহূর্ত তিনি উপভোগ করেছেন। তিনি যাদেরকে অনুসরণ করেছেন তাদের মধ্যে অন্যতম হলেন ভয়েস অব আমেরিকার এরিক ওয়ার্নার, দিল্লী রেডিওতে কাজ করা বিজন বোস, বাংলাদেশের আব্দুর রউফ ও পাকিস্তানে তার শিক্ষক প্রফেসর মুজিবুর রহমান খান । এই মানুষগুলোকে সবসময় শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করেন তিনি। তারা নিজেদের অজান্তেই কবির উদ্দিনকে অনুপ্রেরণা যুগিয়েছেন এবং সঠিক পথ নির্দেশনা দিয়ে গেছেন। পাশাপাশি তিনি য়ার সাথে কাজ করা সকল সহকর্মীর কাছেও কৃতজ্ঞ কারণ তাদের কাছেও অনেক কিছু শিখেছেন এবং অনুপ্রেরণা পেয়েছেন।
নিজে অনেক সাক্ষাৎকার নিলেও যারা তার নিজের সাক্ষাৎকার নিয়েছেন তাদের মধ্যে শ্যামল রোধ, কি কথা তাহার সাথে অনুষ্ঠানে ইমদাদুল হক মিলন, তৃতীয় মাত্রায় সাইফুল ইসলাম এবং আনকাট ৫৫ মিনিটে মুন্নী সাহার নেওয়া সাক্ষাৎকার তিনি স্মরণে রেখেছেন৷ সবাইকে তিনি অসম্ভব স্নেহ ও শ্রদ্ধা করেন।
৬০ বছরের পেশাগত জীবনে তিনি অনেক শিখেছেন এবং অনেক কিছুর পরিবর্তন দেখেছেন। অনেক ক্ষেত্রে ব্যাপক উন্নতি ও সাধিত হয়েছে। হালের মোবাইল ফোন অনেক পরিবর্তন এনেছে বলেও তার মত। তবে এখন নিরপেক্ষতা অনেক ক্ষেত্রেই বজায় রাখা যায় না। কারণ এখন নিয়ন্ত্রণের অনেক অভাব পরিলক্ষিত হচ্ছে বিশেষ করে সোশ্যাল মিডিয়াগুলোতে। এজন্য নিয়ন্ত্রণ জরুরি৷ তবে তিনি এটাও মনে করেন না যে পুরো নিয়ন্ত্রণ রাখা উচিত। সবার উচিত ভেবে চিন্তে দায়িত্ব নিয়ে কাজ করা। তাহলেই পরিবর্তন সম্ভব।
নিজের ব্যক্তিজীবনে একজন সাহিত্য প্রিয় মানুষ তিনি। তার ‘ সেন্টু ভাই ‘ অর্থাৎ প্রখ্যাত সাহিত্যিক আবু জাফর ওবায়দুল্লাহর লেখা আমি কিংবদন্তীর কথা বলছি তার প্রিয় কবিতা। নিজের পেশাগত জীবনে তিনি সবসময় মানুষের ভালবাসা পেয়েছেন। রাস্তায় আনসার সদস্যরা তাকে চিনতে পেরে একসাথে ছবি তুলেছিলেন, বঙ্গোপসাগরের মাঝি তাকে বলেছিলেন তার পাঠ করা খবর তিনি নৌকায় বসে শুনেন। এইসব কবির উদ্দিনের জীবনের বড় পাওয়া। এই মানুষগুলোর কারণেই তার সাফল্য। তিনি বেচে থাকতে চান একজন অত্যন্ত সাধারণ মানুষ হিসেবে। একজন বন্ধু, ভাই, সহকর্মী বা দেশের নাগরিক হিসেবে৷ তরুণদের তিনি বলেন ক্যামেরা ও মাইক্রোফোনের সামনে বসলে মনে করতে হবে এটাই উপাসনালয় এবং এরসাথে কখনোই বেঈমানি করা যাবে না।
লিখেছেনঃ রোমান উদ্দীন