কিছু কিছু মানুষের পরিচয় কখনোই একটি শব্দে কিংবা কয়েকটি বিশেষণে প্রকাশ করা যায় না, তেমনি একজন মানুষ হলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞানের সহযোগী অধ্যাপক, ডঃ রাশেদা রওনক খান। শিক্ষক, সমাজ বিশ্লেষক, গবেষক ও কলাম লেখক হওয়ার পাশাপাশি তিনি জনপ্রিয় একজন টেলিভিশন উপস্থাপকও, সুতরাং তাঁর পরিচয়ের সীমা যাচাই করতে যাওয়া রীতিমতো দুঃসাহস। “কবিতার সাথে” অনুষ্ঠানের মাধ্যমে কথা […]

একজন সামাজিক বিশ্লেষক ও আদর্শ শিক্ষক: রাশেদা রওনক খান

কিছু কিছু মানুষের পরিচয় কখনোই একটি শব্দে কিংবা কয়েকটি বিশেষণে প্রকাশ করা যায় না, তেমনি একজন মানুষ হলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞানের সহযোগী অধ্যাপক, ডঃ রাশেদা রওনক খান। শিক্ষক, সমাজ বিশ্লেষক, গবেষক ও কলাম লেখক হওয়ার পাশাপাশি তিনি জনপ্রিয় একজন টেলিভিশন উপস্থাপকও, সুতরাং তাঁর পরিচয়ের সীমা যাচাই করতে যাওয়া রীতিমতো দুঃসাহস। “কবিতার সাথে” অনুষ্ঠানের মাধ্যমে কথা হল অমিত প্রতিভার অধিকারী এই শিক্ষকের সঙ্গে, যেখানে উঠে এসেছে তাঁর সংসার, সমাজ ও পেশাগত জীবনসহ আরও অনেক বিষয়ের অজানা সব তথ্য। করোনার অচলাবস্থা নিয়ে বলতে গিয়ে নিজের ব্যক্তিগত স্বাস্থ্য ছাপিয়ে তাঁর কথায় উঠে এসেছে সামাজিক অসুস্থতা ও অচলাবস্থার কথা, যেভাবে চিন্তা করা হয়তো তাঁর মতো একজন সমাজ বিশ্লেষকের পক্ষেই সম্ভব।

রাশেদা রওনক খান ব্রাহ্মণবাড়ীয়ার সম্ভ্রান্ত একটি মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর মা সরকারি কলেজের অধ্যক্ষ এবং তিন ভাই- বোনের মধ্যে সবার ছোট। বড় বোন জাবির ২৩ ব্যাচের ছাত্রী এবং বর্তামানে সিলেটের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। ভাই ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল থেকে এমবিবিএস পাশ করে কুমিল্লা মেডিকেল কলেজে সহকারী অধ্যাপক হিসাবে কর্মরত আছেন। এবং রাশেদা রওনক ২০০৬ সালে জাবিতে শিক্ষক হিসাবে যোগদান করেন। বেশ কয়েক বছর জাবিতে পড়িয়ে পরবর্তিতে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগদান করেন। বর্তমানে ঢাবির নৃবিজ্ঞান বিভাগে সহকারী অধ্যাপক হিসেবে কর্মরত আছেন।

“রত্নগর্ভা” এবং “বেগম রোকেয়া” সম্মাননা পাওয়া মা প্রফেসর জোহরা আনিস সম্পর্কে বলতে গিয়ে রাশেদা রওনক খান বলেন, শুধু তাঁর নিজেরই নয়, পৃথিবীর যেকোনো মানুষের সাফল্যের পেছনে সর্বোচ্চ পরিশ্রমকারী ব্যক্তি হলেন মা। তিনি জানান যে, ছোটবেলার শাসনকারী সেই কড়া মা এখন তাঁর সবচেয়ে কাছের বন্ধু। নিজের ব্যক্তিজীবনে প্রফেসর জোহরা আনিস শিক্ষকতার পাশাপাশি শতাধিক সংগঠনের সাথে জড়িত ছিলেন। এত কিছুর পরও নিজের সন্তানদেরকে তিনি যে প্রয়োজনীয় সময় দিয়েছেন এবং যত্নের সাথে লালন করেছেন, সে জন্যে রাশেদার কন্ঠে তাঁর মায়ের জন্য বারবার কৃতজ্ঞতা ফুটে উঠেছে। রাশেদা বলেছেন তাঁর মায়ের যত্নে ও অনুপ্রেরণায় কীভাবে অসংখ্য শিক্ষার্থী সুন্দর ও সাফল্যমন্ডিত শিক্ষাজীবন পেয়েছে।

দেশের বর্তমান শিক্ষার অবস্থা নিয়ে বলতে গিয়ে এ শিক্ষক বলেন, যদিও আমরা নীতিগত দিক থেকে প্রয়োজনীয় বেশকিছু পদক্ষেপ নিয়েছি, কিন্তু সেগুলোর বাস্তবিক প্রয়োগে এখনও অসংখ্য বাঁধা রয়েছে। বিশেষ করে, নিম্নবিত্ত জনগোষ্ঠীর বাচ্চাদের স্কুলমূখী করার ক্ষেত্রে নানা ধরণের চ্যালেঞ্জ আছে। যেমন, অর্থনীতির যে যে ক্ষেত্রে বাংলাদেশ উন্নতি করেছে, তার অনেকগুলোতেই শ্রমের মূল্য কমিয়ে আনতে কর্মী হিসেবে নারী ও শিশুদের নেয়া হয়। নিম্ন আয়ের পরিবারে পরিবারের আয়ের জন্য শিশুদেরকে বাসাবাড়িতে কিংবা দোকানে কাজ করতে হয়। এসব জায়গা থেকে বের করে এনে শিশুদেরকে স্কুলমূখী করতে হবে। এতে করে আমাদের ভবিষ্যত শ্রমবাজার আরও বেশি দক্ষ হবে। উদাহারন হিসেবে তিনি বলেন, আমাদের প্রবাসী শ্রমিকরা এখন বিভিন্ন ভারী কাজের সাথে যুক্ত আছেন এবং অনেক ক্ষেত্রেই তারা নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন। এ ধরণের সমস্যাগুলো থেকে পরিত্রাণের জন্য অন্তত কর্মমূখী শিক্ষায় এসব নিম্নমধ্যবিত্ত শিশুদের অন্তর্ভূক্ত করতে আমাদেরকে ও এ সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়কে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হবে। এতে করে এদের ভবিষ্যত কর্মক্ষেত্র আরও উন্নত ও উৎপাদনশীল হবে।

বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররাজনীতিকে খুব কাছে থেকে দেখা ডঃ রাশেদা রওনক খান এ বিষয়ে বেশ খোলামেলা কথা বলেন। তিনি বলেন, বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে ছাত্র রাজনীতি শুরু হয় হয়তো মতাদর্শ বা ক্ষমতার লোভ থেকে, কারো কারো ক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে সিট পাওয়ার মত সাধারন ব্যাপারের জন্যেও হতে পারে। কিন্তু, ধীরে ধীরে রাজনীতি কিংবা নেতাদের সাথে সাধারণ শিক্ষার্থীদের বড় একটি দূরত্বের সৃষ্টি হয়। ছাত্রনেতাদের সাথে সাধারণ শিক্ষার্থীদের এ দুরত্বের ওপর গুরুত্বারোপ করে তিনি বলেন, ছাত্ররাজনীতি হতে হবে শিক্ষার্থীদের কল্যানে, ছাত্রনেতাদের থাকতে হবে শিক্ষার্থীদের আরও কাছাকাছি, আলাদা কোনো সত্ত্বা হিসেবে নয়। সামাজিক সমস্যায় জর্জরিত এদেশের একটি বড় সমস্যা হল ধর্ষণের মত অপরাধের উত্তরোত্তর সংখ্যাবৃদ্ধি। এ ব্যাপারে তিনি বলেন, পুনর্বাসনের মতো ব্যাপারে সরকারের পাশাপাশি এনজিও ও অন্যান্য উদ্যোগেরও এগিয়ে আসতে হবে। এছাড়াও, পতিতালয় হ্রাস বা তুলে দেয়া কখনো ধর্ষণের সমাধান হতে পারেনা বলেও জানান তিনি। তিনি দাবী করেন, ধর্ষকরা আমাদের চারপাশেই আছে, ভাল মানুষের মতই তারা আমাদের আশেপাশে ঘুরে বেড়ায় । তাই, বিশেষত শিশুদের আরও সতর্ক করতে হবে এবং তাদেরকে প্রয়োজনীয় শিক্ষা দিতে হবে যাতে করে তারা নিজেদের এ ধরনের ঘটনা থেকে বাঁচাতে পারে। ধর্ষন রোধে তিনি সম্মিলিত সামাজিক উদ্যোগের ওপর জোর দেন। পর পর এমন অনেকগুলো ধর্ষণের ঘটনায় মানসিকভাবে দগ্ধ এক শিক্ষকের আক্রোশও যেন ফুটে ওঠে তাঁর কথায়, যে আক্রোশ আমাদের অনেকেরই প্রতিচ্ছবি। তিনি স্পষ্ট সুরে সর্বোচ্চ শাস্তি দাবী করেন ধর্ষণকারী নরপশুদের এবং তাদেরকে তেমনই কঠিন কোনো যন্ত্রণার মধ্যে নিপতিত করা উচিৎ বলে মনে করেন তিনি।

আড্ডা দিতে দিতে তিনি আলোকপাত করেন আমাদের বর্তমান পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থার উপরে। যেখানে কর্পোরেট নিয়ন্ত্রিত আর্থসামাজিক ব্যবস্থায় অর্থই মূলকথা, সেখানে মানবতার সুযোগ খুব কম বলেই মনে করেন তিনি। তিনি বলেন, এই পুঁজিবাদী প্রতিযোগিতাই ধ্বংস করে দিচ্ছে আমাদের সমাজের পারস্পরিক সৌহার্দ, সহাবস্থান এবং সাহায্যের মনোভাব। তাঁর মতে এর প্রভাব সাধারণ অনেক ঘটনার মধ্য দিয়েও আমরা প্রতিফলিত হতে দেখি, যেমন ঈদ বা অন্য কোনো উৎসব আসলেই যেভাবে সব কিছুর দাম বাড়িয়ে দেয়া হয় সাধারন মানুষের চিন্তা না করে, এটাও এই মানবতাহীন, প্রতিযোগিতামূলক, আর্থকেন্দ্রীক ব্যবস্থারই ফসল।

বর্তমানে নিজস্ব সংস্কৃতি থেকে সরে যাওয়ার যে প্রবণতা বাঙালিদের মধ্যে প্রতীয়মান সে ব্যাপারে ডঃ রাশেদা আক্ষেপ করে বলেন, বর্তমানে আমরা একটা হাইব্রিড সংস্কৃতির মধ্যে বাস করছি যেখানে বিভিন্ন দেশের সংস্কৃতির সাথে পরিচয়ের ফলে আমরা আমাদের নিজস্ব অবস্থান থেকে সরে যাচ্ছি। যদিও পরিবর্তনই সংস্কৃতির ধর্ম, তবুও আমাদের নিজস্ব সংস্কৃতির শেকড় আঁকড়ে ধরেই তা করা উচিৎ বলে মন্তব্য করেন তিনি।

“ফার্স্ট ভোটার” এর মতো বেশ কিছু ভিন্নধর্মী টকশোর উপস্থাপক রাশেদা রওনক খান তাঁর বিষয়বস্তু নির্বাচন নিয়ে বলেন, নিজস্ব মতাদর্শ, চিন্তাধারা এবং ইচ্ছার সাথে মিললে তবেই তিনি টক শো এর কাজ করেন। তাই নিয়মিত উপস্থিতি কখনোই তাঁর প্রাধান্য নয়, বরং তিনি চেষ্টা করেন নিজের অবস্থান থেকে রাজনৈতিক সচেতনতা তৈরির কাজ করে যাওয়ার। এ ব্যাপারে তিনি বিশেষ কৃতজ্ঞতা ব্যক্ত করেন দুই বরেণ্য ব্যক্তিত্ব ফরিদুর রেজা সাগর ও শাইখ সিরাজের প্রতি, যাদের অনুপ্রেরণায় ও সহযোগীতায় তিনি স্বাধীনভাবে কাজ করতে পেরেছেন। নিজের বাকস্বাধীনতার প্রতি সম্মান রেখেই, কোনো ব্যক্তি বা আদর্শিক মনোভাবে যাতে আঘাত না লাগে সেভাবে অনুষ্ঠানগুলো পরিচালনা করেছেন বলে জানান তিনি।

মানব পাচারের মত ভয়ংকর সামাজিক সমস্যা নিয়ে কথা বলতে গিয়ে তিনি বলেন, প্রথমেই আমাদের দরকার সচেতনতা। বিশেষত গ্রাম পর্যায়ে আমাদের উচিৎ যত বেশি সম্ভব মানব পাচারের ভয়াবহতা নিয়ে মানুষকে অবহিত করা। তিনি মনে করেন, এই পাচারকারীদের অবশ্যই সরকারের কোনো না কোনো মহলে যোগাযোগ রয়েছে। তাই সরকারকে এদের চিহ্নিত করে যথাযথ আইনের আওতায় আনতে হবে বলে জানান তিনি। আমাদের দেশের মানুষেরা হয়তো একটি ভালো জীবনের আশায় বিদেশে যেতে চায়, পরিবারের হাল ধরতে চায়, কিন্তু অনেক স্বপ্নই বিনষ্ট হয় পাচারকারীদের পাল্লায় পড়ে। ডঃ রাশেদা গবেষণা করেছেন নগরায়ণের রাজনীতি এবং এই রাজনীতির কারণে নাগরিক সুবিধা থেকে দরিদ্রদের বঞ্চিত হওয়া নিয়ে। তিনি জানান, নিজের গবেষণার জন্য ২ বছর ঢাকার বিভিন্ন বস্তিতে গিয়ে মানুষের জীবনযাপন অনুধাবন করেছেন তিনি। যেখানে শহরের কিছু মানুষ খুব ভাল আছেন, সেখানেই আবার কিছু মানুষ আছেন নিদারুন কষ্টে। অথচ এই মানুষগুলো কিন্তু কর্মঠ মানুষ, তাদের এই পরিশ্রমকে সঠিকভাবে কাজে লাগিয়ে তাদের জীবনযাত্রার মানোন্নয়ন করতে হবে বলে মন্তব্য করেন তিনি। তিনি আরও বলেন, যে গার্মেন্টস শিল্প নিয়ে আমাদের এত সুনাম, এত অর্জন, সেই গার্মেন্টস শিল্পের নারীদেরকে কি আমরা যথাযথ মূল্যায়ন করতে পেরেছি? তাদের ব্যক্তিজীবনের সামাজিক, শারীরিক বা অর্থনৈতিক সুরক্ষা নিশ্চিত করতে পেরেছি? এই ভেদাভেদের পরিবর্তে বরং সবাইকে নিয়ে কাজ করলেই আমাদের দেশ ও সমাজ এগিয়ে যাবে।

নিজের সম্পর্কে ডঃ রাশেদা বলেন, নিজের বর্তমান জীবন নিয়ে তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি অত্যন্ত ইতিবাচক এবং নিজের অবস্থানে অত্যন্ত সন্তুষ্ট তিনি। তিনি মনে করেন রাষ্ট্র, সমাজ এবং পরিবারের প্রতি তিনি দায়বদ্ধ। তিনি তথা বাংলাদেশের যেসকল শিক্ষার্থীরা নামমাত্র খরচে উচ্চশিক্ষা নিয়েছেন এবং নিচ্ছেন, তাদের এই শিক্ষার পেছনে অবদান রয়েছে মানুষের পরিশ্রমের। তাই কোনোদিন সুযোগ পেলে সেই মানুষদের জন্য ব্যক্তিগত অবস্থান থেকে যতটুকু সম্ভব করে যেতে চান তিনি, তাঁর গবেষণার বিষয়বস্তুতেও সেটি প্রতিফলিত হয়। এই কারণেই হলি আর্টিজানের হামলার পরপরই তিনি টানা বিভিন্ন টকশোতে গিয়েছেন মানুষকে সচেতন করার উদ্দেশ্যে। আবারও প্রয়োজন পড়লে তিনি মানুষের জন্য একইভাবে কাজ করবেন বলে জানিয়েছেন। সমাজের সকল স্তরে বিচরণ করা এই গুণী ব্যক্তিত্বের বিচরণ কিন্তু রবিঠাকুর, নজরুল এবং জীবনানন্দের কবিতার জগতেও। সামাজিক নানা সমস্যা নিয়ে প্রতিবাদী এই কন্ঠ থেকে তাই বিদায়ী মূহুর্তে শান্তভাবে ঝরে পড়ে “বনলতা সেন” ও। সুন্দর এই মানুষটির জীবন যাতে সুন্দরতর হয়, সফল হয়, এই কামনায় রইল তাঁর জন্য।