বাংলাদেশের ক্রিকেটের এক সুপরিচিত মুখ মোহাম্মদ আশরাফুল, যিনি ক্রিকেটের সব ফরম্যাটে অধিনায়কত্ব করার মাধ্যমে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশ জাতীয় ক্রিকেট দলের প্রতিনিধিত্ব করেছেন। দৃষ্টিনন্দন স্ট্রোক-প্লেতে অনুরাগী একজন টপ-অর্ডার ব্যাটসম্যান আশরাফুল শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে ২০০১ সালে ১৭ বছর বয়সী হিসেবে অভিষেকের মাধ্যমে টেস্ট ক্রিকেটে সেঞ্চুরি করা সর্বকনিষ্ঠ ক্রিকেটার হন। ২০০৭ থেকে ২০০৯ সালের মধ্যে, আশরাফুল তেরোটি টেস্ট এবং আটত্রিশটি একদিনের আন্তর্জাতিক ম্যাচে তার দেশের অধিনায়কত্ব করেছেন। ২০১৪ সালে বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড তাকে ম্যাচ ফিক্সিংয়ে দোষী সাব্যস্ত হওয়ার পর আট বছরের জন্য নিষিদ্ধ করে। নিষেধাজ্ঞাটি পরবর্তীতে ৫ বছরে নামিয়ে আনা হয়। নিষেধাজ্ঞা শেষে আশরাফুল ঘরোয়া ক্রিকেটে ফিরেছেন। ঢাকা প্রিমিয়ার লীগ এবং বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লীগের মতো টুর্নামেন্টগুলোতে নিয়মিত ব্যাট হাতে নিজের উপস্থিতি জানান দিচ্ছেন।
মোহাম্মদ আশরাফুলের জন্ম হয়েছিল বাহেরচর, তাঁর নানাবাড়িতে। তাঁর গ্রামের বাড়ি বাঞ্ছারামপুর এবং তাঁর দাদুর বাড়ি মানিকপুর, যেখানে তাঁর বাবা পর পর দুইবার ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছিলেন। মাত্র ৬ মাস বয়সে ঢাকায় খালার বাসায় চলে আসার পর এই শহরেই তাঁর বেড়ে ওঠা। খালাতো ভাই আফজাল আহমেদ পনিরের ক্রিকেট খেলা দেখতে দেখতেই ক্রিকেটের প্রতি আশরাফুলের ভালোবাসা জন্ম নেয়। খালাতো ভাইয়ের উৎসাহেই ১৯৯৬ এ এক অনূর্ধ্ব-১২ ক্রিকেট ক্যাম্পে তিন মাসের মতো প্রশিক্ষণ নেন। এই ক্যাম্পেই কোচ ওয়াহেদুল গণির নজরে আসেন তিনি এবং ওয়াহেদুল গণি ক্যাম্পের ৮০০ জনের মতো শিক্ষার্থীর মধ্য থেকে আশরাফুলসহ ৫০-৬০ জন শিক্ষার্থীকে নিয়ে “অঙ্কুর ক্রিকেটার্স” গঠন করেন। মূলত এখান থেকেই আশরাফুলের প্রাতিষ্ঠানিকভাবে ক্রিকেটার হওয়ার যাত্রা শুরু হয়। তার কিছুদিন পরেই তিনি ১৯৯৯ এ শিলিগুড়িতে অনুষ্ঠিত অনূর্ধ্ব-১৩ বিশ্বকাপে টুর্নামেন্টের সেরা খেলোয়ার নির্বাচিত হন। এরপর ২০০০ সালে মাত্র ১৪-১৫ বছর বয়সেই নিজের ব্যাটিংশৈলি দিয়ে অনূর্ধ্ব-১৯ দলের নির্বাচক রকিবুল হাসানের নজরে আসেন। অনূর্ধ্ব-১৯ দলের ক্যাম্পে বাংলাদেশ দলের তৎকালীন কোচ এডি বার্লো তাঁর খেলা দেখে সরাসরি মূল দলে তাকে অন্তর্ভুক্ত করেন। সেখান থেকে খুব স্বল্প সময়ের পরিক্রমায় আশরাফুল বাংলাদেশ জাতীয় দলে নিজের জায়গা তৈরি করে নেন। আশরাফুল বলেন, খুব অল্প সময়ে এতদূর আসতে পারা তাঁর জন্য অনেক বড় সৌভাগ্যের ব্যাপার। সাধারণত খেলোয়াড়দের জাতীয় দল পর্যন্ত আসতে দীর্ঘ পথ অতিক্রম করতে হয়।
আশরাফুল বলেন, এই পথ পরিক্রমায় তাঁর শিক্ষক ওয়াহেদুল গণির অবদান অসামান্য। ছোট থেকেই ওয়াহেদুল তাকে বয়সে বড় খেলোয়ারদের সাথে খেলাতেন, নিয়মিত ব্যাটিং অনুশীলনের সুযোগ দিতেন। তার ফলেই অসম সাহস এবং ভয়হীনতা জন্ম নিয়েছিল আশরাফুলের মাঝে। বাংলাদেশ টেস্ট স্ট্যাটাস পাওয়ার পর ২০০১ সালে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে প্রথম এওয়ে ট্যুর করে। সেখানেই সিরিজের তৃতীয় ম্যাচে মাত্র ১৬ বছর বয়সে মোহাম্মদ আশরাফুলের ওডিআই অভিষেক হয়। দানবীয় গতিতে বল করা জিম্বাবুয়ের বলারদের সামনে কিছুতেই ভয় পাবেন না, এমন সংকল্প নিয়েই মাঠে নেমেছিলেন। তিনি জানান, মাত্র ৪ দিনের ব্যবধানে তাঁর জাতীয় দলে অন্তর্ভুক্তি অত্যন্ত সহজ হয়ে গিয়েছিল। প্রথমেই অস্ট্রেলিয়ান একাডেমি বাংলাদেশে আসে, যাদের বিরুদ্ধে আশারফুল অপরাজিত ১১০ রান করেন। তার একদিন পরেই শুরু হওয়া প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে তিনি ঢাকা মেট্রোর হয়ে ১৫৭ রান করেন এবং পরেরদিন ৭ উইকেট নেন। তাঁর মতে, চারদিনের মধ্যে এমন তিনটি বড় পারফরম্যান্সই তাকে জাতীয় দলে জায়গা করে দিয়েছে। একই বছরের সেপ্টেম্বরে মোহাম্মদ আশরাফুলের শ্রীলংকার বিপক্ষে টেস্ট অভিষেকও সম্পন্ন হয়।
স্নায়ুবিক চাপ সামাল দিতে আশরাফুলের সবচেয়ে বড় অস্ত্র হলো খেলার প্রতি ভালোবাসা এবং খেলাকে বোঝার দক্ষতা। সর্বকনিষ্ঠ টেস্ট শতকের রেকর্ডধারী এই ব্যাটসম্যান জানান, তিনি ছোটবেলা থেকেই খেলার সাথে জড়িয়ে থাকার কারণে সবসময় সাহসের সাথে মাঠে নামেন, যাতে হারলেও তাতে চেষ্টার ছাপ থাকে। এছাড়া খেলাধুলাকে ভীষণভাবে অনুসরণ করার কারণে সহজেই খেলার পরিস্থিতি তথা বোলারের মানসিকতা তিনি সহজেই বুঝে উঠতে পারেন। নিজের প্রথম টেস্টেই তাই অধিনায়ক নাইমুর রহমান দুর্জয় তাকে আগে ব্যাটিংয়ে পাঠান কারণ তিনি সহজেই মুত্তিয়া মুরালিধরনের বোলিং বুঝে উঠে তা মোকাবিলা করতে পারছিলেন। আশরাফুল বলেন, একাডেমিতে খেলা শেখার সময়টা থেকেই এই চিন্তাভাবনাগুলো তাঁর মধ্যে গড়ে উঠেছে। সে জন্যেই তিনি নিজে অপেক্ষাকৃত ছোটখাটো গড়নের হলেও বিশালদেহী খেলোয়াড়দের মোকাবিলা করে সবসময় দলের জয়ে অবদান রাখতে পেরেছেন।
বাংলাদেশ ক্রিকেটের বর্তমান অবস্থা নিয়ে আশরাফুল তাঁর আশার কথা জনান। তিনি বলেন, বর্তমানে আমাদের যে দলটি রয়েছে তার অবস্থান অনেক বেশি শক্ত। বিশেষ করে আমাদের অনেক তরুণ খেলোয়াড় রয়েছে যারা ভবিষ্যতে দলকে আরও এগিয়ে নিয়ে যাবে। তিনি ২০২০ সালে বাংলাদেশ অনূর্ধ্ব-১৯ দলের বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন হওয়ার কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে বলেন, এই বিজয়ী দলের খেলোয়াড়রা চিন্তা-ভাবনা এবং আত্মবিশ্বাসে অনেক বেশি এগিয়ে রয়েছে। আগামী ৪-৫ বছরের মধ্যে যখন এই খেলোয়াররাই মূল দলে এসে দলের হাল ধরবে তখন তাদের কাছ থেকে আমরা অনেক ভালো কিছু ফলাফল পাবো। তিনি আরও জানান, নিজে এখন যেখানেই খেলেন সেখানে নিজের অভিজ্ঞতা, ভালো-খারাপের দিকগুলো তরুণ খেলোয়াড়দের সামনে তুলে ধরার চেষ্টা করেন। তিনি বলেন, একজন খেলোয়াড়কে প্রায় সময়ই অনেক কঠিন পরস্থিতির সম্মূখীন হতে হয়। সেসময় সবাই নিজের সর্বোচ্চ দিয়ে দলকে সেই পরস্থিতি থেকে বের করে আনতে চেষ্টা করেন। সবসময় সফল না হলেও এই চেষ্টাটাই একজন খেলোয়াড়ের প্রধান পরিচায়ক। এছাড়া দেশের খেলার উন্নতিতে ঘরোয়া পর্যায়ের খেলাগুলোতে আরও গুরুত্ব দেয়ার কথাও আশরাফুল বলেন। তাঁর মতে, আমাদের বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লীগ বা বিপিএল যখন ২০১১-১২ সালে শুরু হয়েছিল তখন তা বিদেশী অনেক লীগের সমপর্যায়ের ক্রিকেট উপহার দিয়েছিল। কিন্তু তারপর থেকেই এর মান নীম্নমূখী। এছাড়া প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটেও প্রয়োজনীয় গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে না। আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতেই যেখানে আইপিএল এবং প্রথম শ্রেণি থেকে প্রতি বছর বিরাট সংখ্যক সম্ভাবনাময় খেলোয়ার জন্ম নিচ্ছে সেখানে আমাদেরও এই খেলাগুলোতে আরও মনোযোগ দেয়া উচিৎ। তিনি বলেন, আমাদের আরও খেলার চ্যানেল দরকার যেখানে প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটও প্রদর্শন করা হবে। এতে করে খেলোয়াড়দের স্পৃহা আরও বৃদ্ধি পাবে এবং এই লীগগুলো সার্বিকভাবে আরও কার্যকর হবে। একসময় ভারত-পাকিস্তান খেলা নিয়ে সমগ্র উপমহাদেশে এক চাঞ্চল্য সৃষ্টি হতো। বর্তমানে নিজেদের খেলা দিয়ে বাংলাদেশও তেমনই প্রতিদ্বন্দ্বিতা সৃষ্টি করছে বলে আশরাফুল মন্তব্য করেন।
নিজের শুরুর দিককার সময়ের চ্যালেঞ্জিং বোলারদের সম্পর্কে বলতে গিয়ে আশরাফুল বলেন, সেসময় প্রত্যেক দলের খেলোয়াড়দের নাম, তাদের বিশেষত্ব আশরাফুলদের মুখস্ত থাকতো। কীভাবে কার মোকাবিলা করা যায় এমন চিন্তা সার্বক্ষনিক সঙ্গী ছিল। সেসময় আশরাফুলের কাছে ছয় ফিট ছয় এর ইংলিশ বোলার এন্ড্রু ফ্লিনটফকে ভীষণ চ্যালেঞ্জিং মনে হত। টেস্ট সবচেয়ে পছন্দের ফরম্যাট হলেও আশরাফুল টি-টুয়েন্টিতেও নিজের প্রতিভার দেখিয়ে যাচ্ছেন। টি-টুয়েন্টি বিশ্বকাপে তাঁর পাকিস্তানের বিপক্ষে ৬৭ রানের সর্বোচ্চ ইনিংস রয়েছে, বিপিএলেও অপরাজিত ১০৩ রান করেছেন এক ম্যাচে। এছাড়া ঢাকা লীগ টি-টুয়েন্টিতে সোনারগাঁ ক্রিকেটার্স এর হয়ে মোহামেডানের বিপক্ষে তাঁর ৪১ বলে ১০৪ করার কৃতিত্বও রয়েছে। এমনকি তাঁর অনূর্ধ্ব-১২ তে ২০০ করার রেকর্ডও রয়েছে। তিনি বলেন, ছোটবেলা থেকেই চেষ্টা করতেন যাতে বড় একটি রান করতে পারেন। তিনি ভাগ্যবান যে সেই অভ্যাস এখনো বর্তমান এবং সে জন্যেই সবসময় লম্বা ইনিংস খেলার চেষ্টা করেন।
নিজের ক্যারিয়ারের পেছনে পরিবারের অসীম অবদানের কথাও আশরাফুল ভালোবাসার সাথে স্বীকার করেন। তাঁর অনূর্ধ্ব-১৩ খেলার সময় থেকেই পরিবার তাঁর পেছনে থেকে স্বপ্নপূরণের প্রেরণা দিয়ে গেছে। নিজের লক্ষ্য থেকে যাতে চ্যুত না হন তাই কখনো তাকে কোনো চাপ তাকে দেয়া হয়নি বলে তিনি জানান। বলেন, এক অসাধারণ পরিবার পাশে পেয়েছেন বলেই পথচলা অনেকটা সহজ হয়ে গিয়েছে। নিজেদের যৌথ পরিবারে নিজেকে আশরাফুল একপ্রকার মেহমানই দাবি করেন। কারণ নিজের খেলার বাইরে আর কিছুতেই তাকে মনোযোগ দিতে হয় না, আগে তাঁর বাবা সব সামলাতেন আর এখন বড় ভাই একা হাতে সব দায়িত্ব পালন করে যান। এভাবে নিরবচ্ছিন্নভাবে খেলায় মন দেয়ার সুযোগ করে দেয়ার জন্য পরিবারের প্রতি তাঁর অশেষ কৃতজ্ঞতা। বিদেশে খেলতে গেলে সবসময়ই চেষ্টা করেন স্ত্রী-সন্তানদের নিজের সাথে নিয়ে যেতে। খেলার সাথেই আশরাফুলের জীবনের অনেক মজার অভিজ্ঞতা, অনেক স্মৃতি জড়িত। এর পাশাপাশি গানের সাথেও কিন্তু তাঁর দারুন সখ্যতা। অস্ট্রেলিয়ান কোচ জেমি সিডন্স এর অধীনে খেলার সময় যখন অস্ট্রেলিয়া দল সফরে আসে তখন অধিনায়ক আশরাফুলের ঘাড়েই দলের জন্য একটি থিম সং নির্বাচনের দায়িত্ব পড়ে। সেই সময় আশরাফুলের হাত ধরেই বাংলাদেশ দল জিতলে ‘আমরা করব জয়’ গানটি গাওয়ার চল শুরু হয় যেই প্রথাটি এখনো চলমান।
আশরাফুল বলেন, আমাদের ক্রিকেটের উন্নতির জন্য সবচেয়ে বেশি যা দরকার তা হলো সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি। বর্তমানে আমাদের যত পরিশ্রমী এবং দক্ষ খেলোয়াড়রা রয়েছে তারা নিজ চেষ্টায় ভালো করে যাচ্ছে। কিন্তু আমাদের উচিৎ তাদের অনুশীলনের সুযোগ-সুবিধা আরও বৃদ্ধি করা। ইনডোর অনুশীলনের ব্যবস্থা বৃদ্ধি করতে হবে যাতে করে বিরূপ আবহাওয়াতেও অনুশীলন চলতে পারে। এছাড়া তিনি মনে করেন, আমাদের আরও বেশি বেশি খেলার আয়োজন করতে হবে। এতে করে খেলোয়াড়দের ভালো খেলার বা নিজেদের ভুল শুধরে নেয়ার একটা নিয়মিত অভ্যাস তৈরি হবে। আশরাফুল স্বপ্ন দেখেন একদিন বাংলাদেশ টেস্ট, ওয়ানডে এবং টি-টুয়েন্টিতে একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তার করবে। সে জন্যেই খেলোয়াড়দের খেলার নিয়মিত একটি পরিবেশ সৃষ্টির জন্য সম্মিলিত উদ্যোগ দরকার। আশরাফুল চান সবসময় তাকে যেন সবাই একজন ভালো মানুষ হিসেবে মনে রাখে। সে জন্য নিজের কাজকর্মে, চলাফেরায় সবসময় ভদ্রতা এবং মানবিকতা বজায় রাখেন। বাংলাদেশের ক্রিকেটের এই উজ্জ্বল তারকা ভবিষ্যতেও দেশের জন্য আরও অনেক গৌরব বয়ে আনবেন, এমনই প্রত্যাশা রইল।