সতেরো বছরেরও বেশি সময় ধরে পশ্চিম বাংলার টেলিভিশন জগতের এক অতি প্রিয় মুখ রিনি বিশ্বাস। বিনোদনের জগতে তার পদচারণা যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতি পড়ার সময় থেকে শুরু। রিনি বিশ্বাসের জন্ম ও বড় হওয়া সব কলাকাতা কেন্দ্রীক হলেও তার শেকড় কিন্তু এই বাংলাদেশেরই গোপালগঞ্জে গেঁথে আছে। নিজের অভিনয়, উপস্থাপনা, আবৃত্তি দিয়ে তিনি জি বাংলা, কালারস বাংলাসহ পশ্চিমবঙ্গের […]

রিনি বিশ্বাস: দুই বাংলার প্রিয় মুখ

সতেরো বছরেরও বেশি সময় ধরে পশ্চিম বাংলার টেলিভিশন জগতের এক অতি প্রিয় মুখ রিনি বিশ্বাস। বিনোদনের জগতে তার পদচারণা যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতি পড়ার সময় থেকে শুরু। রিনি বিশ্বাসের জন্ম ও বড় হওয়া সব কলাকাতা কেন্দ্রীক হলেও তার শেকড় কিন্তু এই বাংলাদেশেরই গোপালগঞ্জে গেঁথে আছে। নিজের অভিনয়, উপস্থাপনা, আবৃত্তি দিয়ে তিনি জি বাংলা, কালারস বাংলাসহ পশ্চিমবঙ্গের বহু জনপ্রিয় চ্যানেলের নিয়মিত মুখ। তার এই খ্যাতি পশ্চিমবঙ্গের সীমানা পেরিয়ে বাংলা ভাষাভাষী সকলের কাছে পৌঁছে গেছে। টেলিভিশনের বাইরেও লেখালেখির সাথেও আত্মিক যোগাযোগ রয়েছে তার। সে সূত্র ধরেই তিনি অসংখ্য ব্লগ, পত্রিকা এবং ম্যাগাজিনে প্রতিনিয়ত লিখে চলেছেন। তার ব্লগের মাধ্যমেই তিনি পাঠকদের কাছে নিজের পরিবার এবং মাতৃত্বের এক অনন্য উদাহরণ তুলে ধরেন। একজন শিল্পী হিসেবেও তিনি নিজের ব্র্যান্ড ‘আভরিনি’র মাধ্যমে আত্মপ্রকাশ করেছেন।

বর্তমানে মিডিয়ায় উপর বিভিন্ন কোর্স এবং ক্লাস নিয়ে থাকলেও নিজের পড়াশোনার বিষয় অর্থনীতিতেও রিনির ঈর্ষণীয় দক্ষতা রয়েছে। একসময় তিনি অল ইন্ডিয়া রেডিও তথা আকাশবাণীতে “অর্থনীতির দুনিয়া” নামক একটি অনুষ্ঠানও উপস্থাপনা করেছেন। সেখানে প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদের সঙ্গে অর্থনীতির নানা জটিল বিষয় নিয়ে আলোচনা করেছেন এবং মানুষের বোধগম্য করে তা তুলে ধরেছেন। এছাড়াও দীর্ঘ উপস্থাপনা পেশায় মনোবিজ্ঞান, সাহিত্যের মতো আরও অনেক বিষয় নিয়ে তাকে আলোচনা করতে হয়েছে এবং সেখান থেকেই নিত্য নতুন নতুন বিষয় নিয়ে জ্ঞানার্জন করে গেছেন। তার বিভিন্ন ব্লগে সংসার, পরিবার এবং একই সাথে ক্যারিয়ার সামলানোর যে দ্বন্দ্ব, যে মানসিক টানাপোড়েন, তা অত্যন্ত পরিষ্কারভাবে উঠে এসেছে। তিনি জানান, তার সন্তান পাবলো জন্ম নেয়ার আঠারো মাস পরেই তার কর্মসূত্রে দেড় বছরের জন্য বুদাপেস্টে যাওয়ার প্রয়োজন পড়ে। কিন্তু সেখানে যাওয়ার মাত্র তিন মাসের মধ্যেই তিনি ফিরে আসেন। এমনকি যাওয়ার আগেও তার মন ছিল নানা দ্বিধাদ্বন্দ্বে জর্জরিত। তখনই তিনি প্রথম বুঝতে পারেন একজন মেয়ে হিসেবে সবকিছু সামলানো কতটা কষ্টকর। হয়ত চারপাশের সবাই প্রয়োজনীয় সমর্থন দিচ্ছে, তবুও নিজের ভেতর থেকে আসা একটি টানাপোড়েন সবসময় এমন সিদ্ধান্তগুলোকে দ্বিধায় জড়িয়ে রাখে। 

নিজের মানবিকতা, আন্তরিকতা নিজের সন্তানের মাঝে ছড়িয়ে দিয়ে রিনি তাকে একজন ভালো এবং স্বয়ংসম্পূর্ণ মানুষ হিসেবে বড় করতে চান। সে জন্যেই তাকে এমন এক স্কুলে দিয়েছেন যেখানে ছোটবেলা থেকেই বাচ্চাদের কোনো অসুস্থ প্রতিযোগীতায় ঠেলে দেয়া হয় না। বরং যথাযথ মূল্যায়নের মাধ্যমে তাদের এগিয়ে যেতে প্রয়োজনীয় উৎসাহ প্রদান করা হয়। তিনি নিজেও তার সন্তান এবং সন্তানের সমবয়সীদের এমন উপদেশ দেন, তারা যাতে জীবনের সকল অর্জনেও পা মাটিতে রাখে। পৃথিবীতে একা কেউ বাঁচতে পারে না, তাই তারা যাতে সবাইকে নিয়ে সামনে এগিয়ে যাওয়ার মতো মানসিকতা রাখে। অন্যের কাছ থেকে শুধুমাত্র নেওয়ার মানসিকতা না রেখে অন্যের জন্য কিছু করার চেষ্টাও যাতে তারা করে যায়। নিজস্ব জগৎ, পরিবার-পরিজনের গন্ডির বাইরে রিনি অত্যন্ত চাপা স্বভাবের। সে জন্যেই তিনি নিজের উচ্চারিত প্রতিটি শব্দের ব্যাপারে বেশ সচেতন। উপস্থাপনা হোক কিংবা টক শো, তিনি জানান, কখনো কোথাও শুধু বলার খাতিরে কোনো কথা তিনি বলেন না। বরং নিজে যা অনুভব করেন, নিজের ভেতর থেকে যা বলার তাড়না বোধ করেন, সেটাই প্রাণ খুলে, নির্ভয়ে বলে যান। এছাড়া কথা বলার সময় নিজের উচ্চারণের ব্যাপারে তিনি বরাবরই বেশ সচেতন। বিশেষত কবিতা আবৃত্তির ক্ষেত্রে অত্যন্ত যত্ন নিয়ে এবং নিজের গুরুদের শিক্ষা মেনে কাজ করেন। এক্ষেত্রে তার দুজন শিক্ষক, শ্রীমতি রত্না মিত্র এবং প্রয়াত শ্রী প্রদীপ ঘোষের নাম স্মরণ করে তাদের অপরিসীম ভূমিকার কথা তিনি উল্লেখ করেন। এনারা সন্তানস্নেহে কবিতার এবং ভাষার প্রতি একটা ভালোবাসা তার মাঝে সৃষ্টি করেছেন। একই সাথে তার আজকের এই অবস্থানে আসার পেছনে রবীন্দ্রগীতি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ‘দক্ষিণী’র অনবদ্য অবদানের কথাও তিনি বলেন। তার দৃঢ় বিশ্বাস, তার পরিবার, এসকল ব্যক্তি এবং প্রতিষ্ঠানই তাকে আজকের এই মানুষ হিসেবে তৈরি করেছে।

রিনি বর্তমানের লেখকদের মধ্যে সাদাত হোসাইনের লেখা ব্যক্তিগতভাবে খুব পছন্দ করেন। তার কাছে মনে হয়, আমাদের ভাষায় যে কথাগুলো আমরা প্রকাশ করে উঠতে পারিনা, সাদাত হোসাইন তা খুব সুন্দর করে তার কলমে ফুটিয়ে তোলেন। এর পাশাপাশি পশ্চিমবঙ্গের শ্রীজাত বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখনীও তাকে প্রচন্ড স্পর্শ করে। রিনি মনে করেন, চারপাশের নানা মন খারাপ করা পরিস্থিতিতেও তাদের লেখা অনেকটা আশার এবং স্বস্তির সঞ্চার করে। বর্তমানে বাড়তে থাকা সাম্প্রদায়িক সহিংসতার দিকে আঙুল তুলে বলেন, এখন মানুষের মাঝে সহিষ্ণুতার অনেক অভাব। যেকোনো সময় যেকোনো উড়ো খবরে কোনো চিন্তা বা বিচার ছাড়াই মানুষ হত্যা করতে উদ্দত হচ্ছে। অথচ এদের জীবননাশের যত চিন্তা, জীবনকে সুন্দর করার, মানুষকে বেঁচে থাকতে সাহায্য করার ব্যাপারে এত ভাবনা নেই। বরঞ্চ আমরা যেন এখন প্রতিবাদ না করা শিখে গেছি। আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম যদি এসব নিয়ে চিন্তা না করে, তাহলে আমাদের ধ্বংস অবশ্যম্ভাবী। আমরা যদি ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে সংবেদনশীল করে তুলতে পারি, তাদেরকে জাত, ধর্ম, বর্ণের ঊর্ধ্বে মানুষ পরিচয়কে তুলে ধরতে পারি, তাহলে হয়ত তাঁরা এগুলো নিয়ে ভাববে।


দীর্ঘ কর্মজীবনের সুবাদে রিনির অসংখ্য কিংবদন্তীতুল্য মানুষের সঙ্গে মঞ্চ ভাগ করে নেয়ার সৌভাগ্য হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছেন আশা ভোসলে, লতা মঙ্গেশকর, সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়, নির্মলা মিশ্র, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, গুলজার, নাসিরুদ্দীন শাহ প্রমুখ প্রবাদপ্রতিম ব্যক্তিত্ববর্গ। তিনি বলেন, আজও এই নামগুলো স্মরণ করলে তিনি রোমাঞ্চিত বোধ করেন, ভাবেন, আসলেও কি এই মানুষদের সঙ্গে একই মঞ্চে তিনি দাঁড়িয়েছিলেন নাকি এ শুধু তার কোনো এক অলীক কল্পনা। রিনি স্মৃতিচারণ করেন একটি আলোচনা সভার কথা, যেখানে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় নিজের পৈতৃক নিবাস, বাংলাদেশের গোপালগঞ্জের কথা বলতে গিয়ে তার সাথে একাত্মতা প্রকাশ করেন। এছাড়া একটি অনুষ্ঠানে সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় নিজে এগিয়ে এসে তার কাজের প্রশংসা করেন। এমনই স্নেহ তিনি নির্মলা মিশ্র, গুলজার প্রমুখের কাছেও পেয়েছেন। এই ঘটনাগুলো স্মরণ করে এখনো স্মৃতিকাতর হয়ে যান, তীব্র আবেগ তাকে ঘিরে ধরে। মা-বাবার স্বপ্ন ছিল তিনি একজন শিক্ষক হবেন, তিনি নিজেও সে পথেই এগোচ্ছিলেন। কিন্তু এখন মনে করেন, এই পেশায় না আসলে হয়ত এমন অনেক মূহুর্ত ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যেত। এমনকি এই পেশার কল্যাণেই বহু পথ পাড়ি দিয়ে তিনি তার মায়ের আদিনিবাস, ব্রাহ্মণবাড়িয়া পৌঁছাতে পেরেছিলেন, নিজের শেকড়ে বসে অনুভব করেছিলেন এদেশের মানুষের একান্ত আতিথেয়তা।

রিনি নিজের কর্মজীবনের পাশাপাশি পরিবারের ক্ষেত্রেও ভীষণ সচেতন একজন মানুষ। তার সব কাজ, সব মানুষের ঊর্ধ্বে সর্বপ্রথম ভালোবাসার জায়গা দখল করে আছে তার ছেলে পাবলো। একজন মমতাময়ী মা হিসেবে পাবলোকে ঘিরেই তার কাজ, স্বপ্ন এবং জীবনের আবর্তন হয়। এর পরেই নিজের বাবা-মা এবং স্বামী পিনাকীর প্রতি তার তীব্র ভালোবাসা এবং ভরসা। তিনি বলেন, এই তিন মানুষের অনুপ্রেরণা এবং সমর্থনই তাকে এগিয়ে যাওয়ার প্রেরণা যুগিয়ে যায়। সন্তানের যেকোনো ব্যাপারে নিজের বাইরে শুধু এই তিনজনকে ভরসা করেই তিনি নিশ্চিন্তে নিজের কাজ করে যেতে পারেন। সন্তানের প্রতি তার তীব্র ভালোবাসার ভাষায় বর্ণনা করা সম্ভব নয়। তাইতো নিজের মৃত্যুর পর নিজের সন্তানের মধ্য দিয়েই তিনি এই পৃথিবীতে বেঁচে থাকতে চান। তিনি চান তিনি না থাকলেও তার ভাবনাগুলো, চিন্তাধারাগুলো যাতা তার সন্তান, পাবলোর মধ্য দিয়ে বেঁচে থাকে এবং সেও যাতে এই ভাবনাগুলো তার পরবর্তী প্রজন্মে সঞ্চালিত করে। এর মধ্য দিয়েই তিনি তাদের মনে নিজের জায়গা করে নিতে চান। আমাদের আপামর বাঙালী সংস্কৃতির স্বার্থে, মানবিকতার স্বার্থে রিনি বিশ্বাসের মতো মানুষের আরও অনেকদিন আমাদের মাঝে কাজ করে যাক এমনই প্রত্যাশা আমাদের সবার।

লিখেছেন – রোমান উদ্দিন