জনপ্রিয় লেখক ও ছড়াকার লুৎফর রহমান রিটনের জন্ম ১ এপ্রিল, ১৯৬১ সালে। পুরনো ঢাকার ওয়ারী এলাকায় তাঁর শৈশব অতিবাহিত হয়। শিক্ষাজীবনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে ১৯৮৯ খ্রিষ্টাব্দে আবুজর গিফারি কলেজ থেকে স্নাতক শেষ করেন। বাংলাদেশি ছড়াকার ও লেখক হিসেবে তিনি সত্তরের দশকে আত্মপ্রকাশ করেন। তাঁর শিশুতোষ ছড়া ও কবিতা বিংশ শতকের শেষভাগে জনপ্রিয়তা লাভ করেছে। তিনি ২০০১ খ্রিষ্টাব্দে জাপানে বাংলাদেশের কালচারাল এটাশে হিসেবে নিযুক্ত হয়েছিলেন। গুণী এই সাহিত্যিকের প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যা শতাধিক। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল: ধুত্তুরি, ঢাকা আমার ঢাকা, উপস্থিত সুধীবৃন্ধ, হিজিবিজি, তোমার জন্য, ছড়া ও ছবিতে মুক্তিযুদ্ধ, রাজাকারের ছড়া, নেপথ্য কাহিনী ইত্যাদি। নিজের সাহিত্যকর্মের জন্য ২০০৭ সালে তিনি বাংলা একাডেমী সাহিত্য পুরস্কার লাভ করেন। এছাড়াও তিনি সিকান্দার আবু জাফর সাহিত্য পুরস্কার, অগ্রণী ব্যাংক শিশু সাহিত্য পুরস্কার, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পুরস্কার, বাংলা একাডেমী সাহিত্য পুরস্কার সহ বহু পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন। বর্তমানে গত কয়েক বছর ধরে তিনি পরিবার নিয়ে কানাডায় বসবাস করছেন। নিজের ব্যক্তি ও সামাজিক জীবনসহ আমাদের সমাজ বাস্তবতার নানা আঙ্গিক নিয়ে লুৎফর রহমান রিটন কথা বলেছেন কবিতার সাথে অনুষ্ঠানে।
কেন এই প্রবাসজীবন বেছে নেয়া, এ প্রশ্নের জবাবে তিনি তাঁর ভাগ্যের পরিহাসের কথা জানান। ২০০১ সালে জাপানে যোগদানের পরপরই রাজনৈতিক রোষানলে পড়তে হয় তাঁকে, এমনকি তাঁর কূতনৈতিক পাসপোর্টও জব্দ করা হয়। এরপর নানা ভাবে তিনি কানাডায় গিয়ে পৌঁছান, যেখানে ৭ বছরের মতো তাকে রাজনৈতিক আশ্রয়ে থাকতে হয়েছে। যদিও এখন আবার সবই স্বাভাবিক, কিন্তু ঐ ৭ বছরে একটা শেকড় গজিয়ে গেছে বলে জানান তিনি। এখন এই লেখকের নিয়মিতই বাংলাদেশে আসা হয়, কিন্তু নিয়তির বিধানে এক অলঙ্ঘনীয় দূরত্ব তৈরি হয়েছে বলে জানান তিনি। এছাড়া মুক্তচিন্তাসম্পন্ন এই লেখক নিজের স্মৃতিকথা সম্পর্কিত লেখা নিয়েও খোলামেলা কথা বলেন। তাঁর এসব লেখায় তাঁর ব্যক্তিজীবন, পরিবেশ, অর্থনৈতিক অবস্থা তথা সামাজিক বাস্তবতা – সবই উঠে এসেছে। তিনি বলেন, নিজের আত্মজীবনীতে মি
থ্যা কিছু লিখবেন না বলে শপথ করেছিলেন। একসময় এদেশের মধ্যবিত্তদের মাধ্যমেই সংস্কৃতি সঞ্চারিত হত প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে। এমনই এক মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান তিনি। লেখক হওয়ার জন্য যখন সংগ্রাম করে যাচ্ছিলেন তখন তিনি কেন এপথে এলেন যেখানে তাঁরই অনেক বন্ধুর হাতে কলমের বদলে সন্ত্রাসের অস্ত্র ছিল, এ ধরনের নানা গঠনমূলক গভীর চিন্তার প্রতিফলন ঘটেছে তাঁর এই লেখাগুলোতে। চিরাচরিত আত্মজীবনীর সুন্দর-সুখী পরিবারের চিত্র না এঁকে তিনি তাঁর পরিবারের বাস্তবতা, তাঁর স্ত্রীর মানসিকভাবে নির্যাতিত হওয়ার ঘটনা, সব তুলে ধরেছেন অকপটে। কারণ তাঁর মনে হয়েছে, এগুলো নিয়ে না লিখলে আমাদের মেয়েরা নির্যাতিত হ
তেই থাকবে। আর অভ্যন্তরের ঘটনা বলে এধরনের নির্যাতনকে আজীবন চাপা দিয়ে রাখার অভ্যাসটাও যাতে আমাদের বদলায়, পারিবারিক ও সামাজিক বাস্তবতা যেন ইতিহাসে সঠিকভাবে উঠে আসে এই আশাই তিনি ব্যক্ত করেন।
তাঁর কাছে আমরা তাঁর ছোটবেলা থেকেই শিল্প-সাহিত্যের সাথে যুক্ত থাকার গল্প শুনতে পাই। একদিন ঘুড়ি উড়াতে গিয়েই আকস্মাৎ তাঁর হাত ধরে ফেলেন রোকনুজ্জামান খান, যিনি দাদাভাই নামেই অধিক পরিচিত ছিলেন। তখন তিনি ইত্তেফাকের শিশু-কিশোরদের উপযোগী কচিকাঁচার আসর বিভাগের পরিচালক। রোকনুজ্জামান খানের হাত ধরেই ধীরে ধীরে লুৎফর রহমানের ছবি আঁকা, গান গাওয়ার অনেকটা আনুষ্ঠানিক শিক্ষা শুরু হয়। তিনিও সম্পৃক্ত হয়ে যান কচিকাঁচার মেলার সাথে। দাদাভাই প্রায়ই তাঁর হাতে আঁকা ছবি ছাপতেন দৈনিকের পাতায়। এভাবেই ১৯৭২ সালের একদিনে, ৯-১০ বছর বয়সী লুৎফর রহমানের ছড়া ছাপা হয় দৈনিকে, যেটা তাঁর ভেতরকার প্রতিভাকে ভীষণভাবে নাড়া দিয়ে যায়। সে জন্যেই নিজের জীবনের গতিপথ বদলে শিল্প-সাহিত্যের বর্ণাঢ্য জগতে প্রবেশ করানোর কারিগর হিসেবে তিনি দাদাভাইকে নিজের গুরুতুল্য মনে করেন। নিজের চিত্রশিল্পী হওয়ার চেষ্টা এবং ব্যর্থতা নিয়ে তিনি বলেন, প্রত্যেকটা মানুষকেই নিজের ক্ষেত্র চিনতে হবে। প্রকৃতি সবাইকে কিছু না কিছু গুণ তথা দায়িত্ব দিয়ে পাঠিয়েছে। সে জন্যেই হয়ত আজ তিনি নিজে ছড়াকার হয়ে উঠেছেন এবং তাঁর চিত্রকর বন্ধুরাই তাঁর বইয়ের প্রচ্ছদ এঁকে দিচ্ছেন। এই ছড়াকার হয়ে ওঠার পেছনে রয়েছে ৪৮-৫০ বছরের নিরলস পরিশ্রম, নিজের মধ্যে শিল্প গ্রহন করার মত সক্ষমতা। অসংখ্য বই পড়ে তিনি বুঝেছেন যে, দুটি বিষয়ে কখনো ফাঁকি দিতে নেই, এক হলো সংসারের ক্ষেত্রে, আর দুই হল শিল্প-সাহিত্যের ক্ষেত্রে। যারা এগুলোতে ফাঁকি দেয় তারা মূলত নিজেদেরকেই ফাঁকি দেয় বলে মন্তব্য তাঁর।
শিল্প সৃষ্টিতে তাঁর বড় অনুপ্রেরণার জায়গা হল সত্যজিত রায় ও তাঁর “হীরক রাজার দেশে”। ছড়া দিয়ে ও ছন্দের মধ্য দিয়ে এত সুন্দর উপস্থাপন তাকে চমৎকৃত করে। সেই অনুপ্রেরণা থেকেই তিনি সামরিক শাসক এরশাদের আমলে “হবুচন্দ্র রাজার দেশে” নামের একটি নাটকও নির্মাণ করেছিলেন। নিজেকে সত্যজিত রায়ের মহাভক্ত হিসেবে
পরিচয় দিতে তাই লুৎফর রহমানের বিন্দুমাত্র বাধে না। স্বয়ং সত্যজিত রায় অবাক হয়েছিলেন যখন তিনি ১৯৮৩ সালের এক সরাসরি সাক্ষাৎ এ জানতে পারেন যে ‘হীরক রাজার দেশে’র সকল দৃশ্য এই গুণি ব্যক্তির মুখস্তপ্রায়। এর কারণ হিসেবে তিনি বলেন, ছড়া নিয়েই তাঁর জীবন কেটেছে, তাই ছড়া বিষয়ক যেকোনো কিছু তাঁর অত্যন্ত আপন। অনেক পরিচয় থাকা সত্ত্বেও ছড়াকার পরিচয়েই তিনি সবচেয়ে সাচ্ছ্যন্দবোধ করেন। ছড়াকে এত ভালোবাসেন দেখেই যখন সবচেয়ে প্রিয় কোন লেখা সম্পর্কে জানতে চাওয়া হয় তখন অম্লমধুর দ্বন্দে পড়ে যান। সন্তানতুল্য লেখাগুলোর মধ্য থেকে কোনো একটাকে বেছে নেয়ার কঠিন পরীক্ষাটি তিনি দেশাত্মবোধক একটি ছড়া বেছে নেয়ার মাধ্যমে কেটে উঠেন। দীর্ঘ প্রবাসজীবনে দেশের প্রতি যে আকুতি সৃষ্টি হয় সেটাই তাঁর এই ছড়ার মাধ্যমে প্রকাশ পায়।
সুদূর প্রবাসে থাকলেও রিটন প্রতি বছর বইমেলার সময় নিয়মিত দেশে আসেন। বই মেলায় তাঁর একটি নিয়মিত কাজ হলো তরুণ লেখকদের জন্য নতুন নতুন লেখা সংগ্রহ করে সেগুলো পড়া এবং ভালো লেখকদের সাথে নিজে থেকে যোগাযোগ করে তাদেরকে উৎসাহ জানানো। তিনি মনে করেন, এখনকার তরুণদের মধ্যে সবচেয়ে ভালো ছড়া লেখেন রোমেন রায়হান। এছাড়াও সারওয়ারুল ইসলাম ও আহমেদ সাব্বিরের মতো তরুণদের লেখার প্রশংসাও ঝরে পড়ে তাঁর কন্ঠে। তিনি মনে করেন, এই লেখকরা যদি সাধনা করে যান তাহলে তাদের কাছে পাঠকরা খুব ভালো ছড়া উপহার পাবেন। কিন্তু ছড়া বা লেখালেখির পেছনে সাধনা করতে গেলে কর্মক্ষেত্রে একটু পিছিয়ে পড়তে হয়। ভালো লেখক যারা, তাদের প্রধান কাজই ছিল লেখা, আর চাকরি ছিল তাদের জীবনধারনের উপায় মাত্র। ঠিক একইভাবে, ভালো ছড়াকার হতে গেলে ২৪ ঘন্টার ছড়াকার হতে হবে বলে তিনি মন্তব্য করেন। এছাড়া একজন ছড়াকারকে সকল বিষয়ের জ্ঞান রাখতে হবে, সমসাময়িক পৃথিবীতে কি চলছে সেই ধারণা থাকতে হবে। তা নাহলে লেখকের লেখার জগত সীমাবদ্ধ হয়ে যাবে। যুগের সাথে তাল মিলিয়ে বিষয় এবং উপস্থাপন পরিবর্তিত না হলে লেখায় নতুন দিগন্ত আসবে না। পড়াশোনার মাধ্যমেই একজন শিল্পীর নিজস্ব ভঙ্গি সৃষ্টি হয়। তাই লেখক হওয়ার জন্য ও শিল্পী হওয়ার জন্য পড়াশোনার বিকল্প নেই।
কথা বলতে বলতে এদেশের সিনেমা নিয়ে রিটন তাঁর আশাবাদ ব্যক্ত করেন। তিনি জানান, আমাদের তরুণ প্রজন্মের যারা সিনেমার হাল ধরেছে, তাদের কাজ তাঁকে মুগ্ধ করে। সিনেমাকে রন্ধনশিল্পের সাথে তুলনা করে তিনি বলেন, একটি সিনেমায় গল্প থেকে শুরু করে অভিনয়, ক্যামেরা ও পারিপার্শ্বিক সব কিছুর একটা সুষম সমন্বয় দরকার। হালের সিনেমা “হাওয়া”র প্রশংসাও তাঁর কণ্ঠে ভেসে আসে। তিনি বলেন, মানুষ যেখানেই থাকুক না কেন, সবসময় শেকড়ে ফিরে যেতে চায়। আর এই সিনেমাটি এর সুর ও আবহ সবকিছু দিয়ে সেটাই তৈরি করতে চেয়েছে। এটাকে আমাদের চলচিত্রশিল্পের একটি বড় মাইলফলক হিসেবে দেখেন তিনি এবং মনে করেন মোস্তফা সরওয়ার ফারুকী ও মেজবাউর রহমান সুমনদের মত পরিচালকদের হাত ধরে দেশের চলচ্চিত্র জগতে বিরাট পরিবর্তন আসছে।
নিজের লেখার মাধ্যমে ও ছড়ার মাধ্যমে শিশুদের হৃদয়ে জায়গা করে নেয়া এই বিনয়ী ছড়াকার মনে করেন, এত কিছু অর্জনের পরেও তিনি পরবর্তী প্রজন্মের জন্য তেমন কিছুই করতে পারেন নি। এমন কথা তাঁর শুদ্ধচিন্তা এবং সরল মনেরই পরিচায়ক। তিনি বলেন, মানুষ অনেক কিছু ভুলে গেলেও তাঁর শৈশবকে কখনও ভোলে না, শৈশবে পড়া বই কখনও ভোলে না। তাই তাঁর ছড়া পড়ে যদি একটি শিশু অল্প কিছু মূহুর্তও হাসে, সেই হাসির নেপথ্যে থাকা ব্যক্তি হিসেবে সেটাই তাঁর সান্ত্বনা হবে। এই ভালোবাসার বেশি কিছু তিনি চাননি এবং এই ভালোবাসাটুকু নিয়েই তিনি পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করতে চান। এমন বিশুদ্ধ মানসিকতার মানুষরা আরও দীর্ঘদিন আমাদের মাঝে থাকুক এবং আমাদের শিশুদের মুখে হাসি ফোটাক, এই কামনাই রইল।