ডা: জাফরুল্লাহ চৌধুরী: জনসেবার অগ্রদূত

ডা: জাফরুল্লাহ চৌধুরী: জনসেবার অগ্রদূত

এদেশের গণমানুষের মানসপটে সুচিকিৎসা ও সুস্বাস্থ্যের মত শব্দগুলোর সাথে যে নামটি ওতপ্রোতভাবে জড়িত, তা হল ডা: জাফরুল্লাহ চৌধুরী। “গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র” এর প্রতিষ্ঠাতা ডা: জাফরুল্লাহ চৌধুরীর ১৯৪১ সালের ২৭ ডিসেম্বর। তাঁর শিক্ষাজীবন কর্মজীবনের মতোই উজ্জ্বল। তিনি এমবিবিএস করেছেন ঢাকা মেডিকেল কলেজ থেকে এবং ইংল্যান্ড থেকে করেছেন পিএইচডি। আবার দেশের ভয়াল সময়ে বীরদর্পে ঝাঁপিয়ে পড়তে দ্বিধা করেননি রণক্ষেত্রে। তাই তো ডাঃ জাফরুল্লাহ চৌধুরী এদেশের ইতিহাসের এবং বর্তমানের সাথে সর্বময় জড়িত একটি নাম। এই মহান ব্যক্তিত্বের সঙ্গে “কবিতার সাথে” আয়োজনের একান্ত আড্ডায় উঠে এল তাঁর বর্তমান জীবন, করোনা পরিস্থিতি এবং আমাদের দেশ ও সমাজ নিয়ে নানা গুরুত্বপূর্ণ তথ্য তথা উপদেশও।

করোনা প্রতিষেধক ও এর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া ইত্যাদি নিয়ে বলতে গিয়ে তিনি বললেন, এসব নিয়ে ভয় পাওয়ার কিছু নেই, এগুলো সাধারণ এলার্জি জনিত পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া। বরং তিনি গর্ব করে বলেন যে, যেখানে অনেক দেশের মানুষকে ভ্যাক্সিনের ব্যাপারে বুঝাতে হয়, আমাদের দেশের মানুষরা নিজে থেকেই বুঝতে এবং সে অনুযায়ী কাজ করতে পারে। নিজের মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলো স্মরণ করে তিনি বলেন, বিলেতে থাকার কারণে ৭ই মার্চের ভাষণ তখন শোনা হয়নি তাঁর। কিন্তু একদিন তিনি বিদেশে বসেই পান বঙ্গবন্ধুর অসম সাহসের সাক্ষাৎ। যখন সাংবাদিক প্রশ্ন করেন যে পাকিস্তানীদের হাতে খুন হওয়ার ভয় আছে কিনা, বঙ্গবন্ধু উত্তর দেন, ৭ কোটি বাঙ্গালি মেরে ফেলার মত বুলেট কি তাদের আছে? ডাঃ জাফরুল্লাহর ভাষ্যমতে, সেই কথা শোনার পরেই তাঁর নিজের সকল সন্দেহ, বিভ্রান্তি উবে যায়। তারপর যখন ২৫ মার্চের ভয়াবহতার খবর পান বিদেশে বসে, তখনই আঁকড়ে ধরে দেশপ্রেম ও দায়িত্ববোধ। বিলাত ও আমেরিকার সমমনা বাঙ্গালি ছাত্র-ছাত্রীদের নিয়ে এপ্রিলের মাঝামাঝি গঠন করেন বাংলাদেশ মেডিকেল এসোসিয়েশন। যুদ্ধ নিয়ে বলতে গিয়ে বলেন, আমরা মূলত যুদ্ধ করেছি তিন জায়গায়, একটা ভারতে, যেখানে আমরা আমাদের অনেক ব্যবস্থা গড়ে তুলেছিলাম, দ্বিতীয় যুদ্ধ ছিল দেশের অভ্যন্তরে এবং তৃতীয় ফ্রন্টটি ছিল ইউরোপে এবং আমেরিকায়, যেখানে বিচারপতি আবু সাইদ চৌধুরীর হাত ধরে চলেছে কূটনৈতিক এক যুদ্ধ। এই বীর মুক্তিযোদ্ধা মনে করেন, এই প্রবাসী বাঙ্গালীদের কল্যাণে এবং আবু সাইদ চৌধুরীর নেতৃত্বেই আমরা বঙ্গবন্ধুকে জীবিত ফেরত আনতে পেরেছিলাম।

তাঁর গল্পে গল্পে উঠে আসে কীভাবে মুক্তিযুদ্ধের সময় কাছ থেকে দেখা মানুষের দুঃখ-দুর্দশা, আশা, আকাঙ্ক্ষা সব কিছু ভেতর থেকে নাড়া দিয়েছিল তাকে। সেই অনুপ্রেরণা থেকেই ৪৮০ বেডের “বাংলাদেশ হাসপাতাল” প্রতিষ্ঠা করেছিলেন যা চিকিৎসা দিয়ে গেছে দুর্গতদের ও আহত মুক্তিযোদ্ধাদের। জেনারেল ওসমানীর কথা উল্লেখ করে তিনি জানান সে সময়ে তাঁর বীরগাঁথা গল্প তাকে ব্যাপক অনুপ্রেরণা ও উৎসাহ দিয়েছিল। অনেক বাধাবিপত্তি পেরিয়ে অবশেষে অসংখ্য বাঙ্গালি ইচ্ছুক নারীদেরকে তিনি রূপান্তর করেছিলেন একদল দক্ষ নার্সে। তখনই তাদের চিন্তাধারায় দেশের জন্য একটি উন্নত স্বাস্থ্যব্যবস্থা গড়ে তোলার স্বপ্ন বাসা বাঁধে যার মূল চাবিকাঠি হবে নারীরা।

ডাঃ জাফরুল্লাহ জানান “গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র” নামটা স্বয়ং বঙ্গবন্ধুর দেয়া এবং নামের পাশাপাশি তিনি এ হাসপাতালে ৩১ একর জমি দিয়েছিলেন এদেশের প্রান্তিক মানুষের সুচিকিৎসা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে। নিজের আদর্শের সাথে মিল না থাকায় ও নিজের কাজ বাধাগ্রস্ত হবে এই চিন্তায় তিনি মেজর জিয়ার মন্ত্রীসভায় মন্ত্রীত্বের প্রস্তাবও ফিরিয়ে দিয়েছিলেন এবং হাসপাতালের জন্য দেয়া ব্ল্যাঙ্ক চেক তিনি প্রত্যাখ্যান করেছেন।

সাম্প্রতিক ভাস্কর্যবিরোধী আন্দোলনের প্রেক্ষিতে তিনি বলেন, ভাস্কর্য তো এদেশে নতুন কিছু নয়। তাহলে হঠাৎ এখন কেন একদল কট্টরপন্থীর উদ্ভব হচ্ছে? তিনি মনে করেন এর পেছনে বড় একটি কারণ হল পশ্চিমা বিশ্বের বিরুদ্ধে আমাদের রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের আত্মসম্মানবোধের অবস্থান। তিনি বলেন, বিশ্বের সকল মুসলিম দেশেই ভাস্কর্য আছে। এই মহান চিকিৎসক বরং মনে করেন, এ ধরনের কর্মকান্ড থেকে বেরিয়ে এসে আমাদের উচিৎ আধুনিক জগতের সাথে চিন্তা করা, মানুষের ক্ষুধা নিবৃত করার চেষ্টা করা, বিভিন্ন মাদরাসায় যে কিছু সংখ্যক মানুষ বলৎকার কিংবা নির্যাতনের মত অপরাধে লিপ্ত সেগুলো সমাধান করা, শিক্ষাব্যবস্থা এমন করা যাতে এগুলো একদমই না ঘটে। এছাড়া পোশাক, পর্দা, সংস্কৃতির মত বিতর্কগুলোকেও সরিয়ে রেখে সুন্দর এবং সুস্থ্য সমাজ ব্যবস্থার দিকে ধাবিত হওয়ার জন্য আমাদের কাজ করা উচিৎ বলে তিনি মনে করেন। তাঁর মতে, মেয়েদের আগ্রগতি না হলে দেশের আগ্রগতি হবে না।

ডাঃ জাফরুল্লাহকে জিজ্ঞেস করা হয় তাঁর অনন্য কাজ – ১৯৮২ সালের ওষুধনীতি নিয়ে এবং এর বর্তমান প্রায়োগিক আবস্থা নিয়ে। তিনি জানান, এর সাথে আরও জড়িয়ে আছে সাদাত চৌধুরীর নাম। তৎকালীন সময়ে “বিচিত্রা”র অবদান তিনি উল্লেখ করেন শ্রদ্ধাভরে। তিনি জানান, ১৯৭৪ সালে দেশের “ওষুধ সাম্রাজ্যে”র বিরুদ্ধে তাঁরা সম্মিলিতভাবে সরকারকে বোঝান, যেটি ছিল তাদের ’৮২ এর জাতীয় ওষুধনীতির ভিত্তি। তারপর ৮২ এর এই উদ্যোগ পুরো পৃথিবীর সামনে এক নতুন বাস্তবতা তুলে ধরে, জানিয়ে দেয় কীভাবে ওষুধ মানুষের কাছে সহজলভ্য করে তোলা যায়। গ্রামের অশিক্ষিত মেয়েদেরকেও কীভাবে প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ দিয়ে তাঁরা অপারেশন করার মত দক্ষ করে তুলতে পেরেছেন, সেটিকে তিনি নিজের বড় একটি অর্জন হিসেবে দেখেন। এই যে চিকিৎসাক্ষেত্রের বড় একটি কুসংস্কারকে ভাঙা, এটাকে বিরাট একটি সাফল্য হিসেবে বিবেচনা করেন তিনি। দেশের গণতন্ত্র নিয়ে কথা বলতে গিয়ে তিনি স্মরণ করেন বঙ্গবন্ধুর কথা, যিনি আজীবন গণতন্ত্রের জন্য লড়াই করে শেষকালে এসে বাকশাল প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, ডাঃ জাফরুল্লাহ যেটার ঘোরবিরোধী ছিলেন।

কথায় কথায় উঠে আসে ডাঃ জাফরুল্লাহ চৌধুরীর ব্যক্তিজীবনের গল্প – শৈশব, পরিবার ইত্যাদি। তিনি জানান, তাঁর ডাক্তার হওয়ার পেছনে সবচেয়ে বড় অবদান তাঁর মায়ের। তাঁর মা তাকে বলতেন মানুষের দুর্দশা, চিকিৎসাহীন ভাবে মারা যাওয়া নিয়ে কিছু করতে। সে জন্যেই হয়ত তাঁর জীবনের বড় অংশ আবর্তিত হয়েছে তাঁর আপাত “অশিক্ষিত” মাকে ঘিরেই। সেই মা দেখে গিয়েছেন ছেলের স্বপ্নের বাস্তবায়ন – গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র। গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের রয়েছে নিজস্ব পুকুর, খামার, মাঠ, যেখানে সবাইকে দৈনিক অন্তত এক ঘন্টা কাজ করতে হয় বলে জানান তিনি। ডাঃ জাফরুল্লাহ এর কারণ হিসেবে উল্লেখ করেন, যাতে করে ডাক্তাররা কৃষকদের কষ্টের জীবন সম্পর্কে জানতে পারেন, যাতে করে তাঁরা জনগণের আরও কাছে যেতে পারেন।

ডাঃ জাফরুল্লাহ চৌধুরীর আরেকটি বিশাল কৃতিত্ব হল, কিডনি ডায়ালাইসিস এর মত ব্যয়বহুল একটি প্রক্রিয়াকে তিনি নিয়ে গিয়েছেন গ্রামের দরিদ্র জনগোষ্ঠীর হাতের মুঠোয়। এই ব্যবস্থা কেনো আরও প্রতিষ্ঠান নিতে পারছে না, এমন প্রশ্নের জবাবে বলেন, এ ব্যাপারে সরকারের কিছু দায়িত্ব রয়েছে যেগুলো সরকার পালন করছে না। যেমন, ’৮২ সালের ওষুধনীতিতে তাঁরা বলেছিলেন, ওষুধের মূল্যের ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠানের লাভ অবশ্যই দেখতে হবে, কিন্তু সেটি যাতে আকাশ্চুম্বী না হয়। এছাড়া অনেক দেশে কিডনি রোগীরা কিছু সুবিধা পেয়ে থাকেন, যেমন তাদের পরিবহন খরচ কিছুটা কম লাগে। কারণ এই চিকিৎসা প্রতি সপ্তাহে নিতে হয়। আমাদের দেশে রোগীরা চিকিৎসার সমপরিমাণ খরচ যাতায়াতে করতে করতে নিঃস্ব হয়ে যান বলে মন্তব্য করেন ডাঃ জাফরুল্লাহ চৌধুরী। তিনি বলেন, সরকারের উচিৎ এই খাতে আরও সুবিধা এবং ভর্তুকি প্রদান করা। ক্ষোভ প্রকাশ করেন যে, আমাদের মধ্যে দেশের জন্য দরদ নেই, আর যারা দেশ চালান, তাঁরা চিকিৎসা করান বাইরে গিয়ে। তিনি জানান, গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রে এক দিনে ২৮৫ জনের মত মানুষেরও ডায়ালাইসিস হয়, যার ৪০% ই ডায়ালাইসিস করান ৭০০-৮০০ টাকায়। এর প্রযুক্তিগত সুযোগ সুবিধাও সর্বোচ্চ মানের, যে কারণে তিনি নিজেও এখানে চিকিৎসা নেন। এমনকি আমেরিকা থেকে একজন বিশেষজ্ঞ ডাক্তার ৩-৪ মাস পর পর এসে সব কিছুর তদারকি করে যান বলে আমরা জানতে পারি ডাঃ জাফরুল্লাহ চৌধুরীর কাছে। তারপরও একটি বিরাট দুর্ভাগ্যের ব্যাপার হল, এখানে সরকারের তেমন কোনো সহযোগিতা নেই।

সবশেষে তিনি জানান, এই স্বাধীন বাংলাদেশের মানুষের মুখের হাসিটাই তিনি দেখতে চান। মানুষের সেবা করে যেতে চান। এত সহজে আমরা চাইলেই উন্নতি করতে পারি, কিন্তু দুর্নীতি, সরকারের ভুল চিন্তাভাবনা ইত্যাদির কারণে বরং বৈষম্য বাড়ছে, এই ব্যাপারটাই কষ্টদায়ক বলে উল্লেখ করেন ডাঃ জাফরুল্লাহ চৌধুরী। আক্ষেপ করে বলেন, পরিবর্তন এত সহজ, সেটা তিনি অনেক চেষ্টা করেও বোঝাতে পারছেন না মানুষকে। দেশের ধনীরা এবং দেশের বাইরে যারা আছেন, তারা এগিয়ে আসলেই আর কারও সাহায্য ছাড়াই গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র সফল হবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন তিনি। এই বয়সে এসেও নিজের আগে গণমানুষের চিন্তা করা এই মানুষটা যাতে আরও সফলতার সাথে এগিয়ে যান, এই প্রত্যাশা হৃদয়ের অন্ত্যস্থল থেকে। কারণ তাঁর সফলতার মাঝেই রয়েছে এদেশের সাধারণ মানুষের হাসি।

প্রকৃতিবন্ধু: মুকিত মজুমদার বাবু

প্রকৃতিবন্ধু: মুকিত মজুমদার বাবু

জীবনানন্দ দাশ যেমন বনলতা সেনের কাছে দু-দন্ড শান্তি পেয়েছিলেন ঠিক তেমনিভাবে এক ক্লান্ত প্রাণকে দু-দন্ড শান্তি দিতে পারে প্রকৃতি। প্রকৃতি কাউকে কখনো ফিরিয়ে দেয় না, ক্লান্ত প্রাণ থেকে শুরু করে উষ্ণ হৃদয় সকল মানুষের প্রতি প্রকৃতির আচরণ সমান। প্রকৃতি খুব যত্ন করে আগলে রাখে আমাদের। কিন্তু আমরা অনেক সময় প্রকৃতির এই অবদান স্বীকার করি না। অনেক সময় প্রকৃতির প্রতি হয়ে উঠি নির্মম। তবে অনেকেই আছেন প্রকৃতির খুব কাছের যারা চায় প্রকৃতি তার নিজের মতো করে আমাদের সারাজীবন আগলে রাখুক। আজ এমনি একজন মানুষকে উপস্থাপন করবো যিনি একজন সফল উদ্যোক্তা হয়েও তাঁর ব্যবসায়িক পরিচয় ছাপিয়ে দেশে-বিদেশে প্রকৃতিবন্ধু নামেই বিশেষভাবে পরিচিত। তিনি হলেন প্রকৃতির কাছের মানুষ মুকিত মজুমদার বাবু।

মুকিত মজুমদার বাবু একাধারে ইমপ্রেস গ্রুপ ও চ্যানেল আই এর সহ-সভাপতি। ইনসেপ্টার মতো বহুজাতিক ওষুধ প্রস্তুতকারী সংস্থার সত্ত্বাধিকারী। কিন্তু সবকিছু ছাপিয়ে যে পরিচয়টির জন্য তিনি আলোচিত ও সকলের কাছে সবচেয়ে বেশি নন্দিত সেটি হলো ‘প্রকৃতি ও জীবন’ ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি। এ পর্যন্ত তিনি প্রকৃতি ও জীবনের উপর নির্মান করেছেন প্রায় ৩৪৫ এরও অধিক প্রামাণ্যচিত্র।

প্রকৃতি অন্ত:প্রাণ মানুষটি ১৯৫৫ সালে ঢাকার সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। স্কুলে পড়া অবস্থায় ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন তিনি। ১৯৭৮ সালে উচ্চশিক্ষার জন্য বিদেশে পাড়ি জমা এবং যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্রে উচ্চশিক্ষা শেষে দেশের টানে মাতৃভূমি বাংলাদেশে ফিরে আসেন ১৯৮৪ সালে। মুকিত মজুমদার বাবুর সাথে কথা বলছিলাম করোনা মহামারির সময়টাতে। করোনার সময়ে অনেক ধরণের ভ্যাকসিন আবিষ্কার করা হয়েছে। যেহেতু তিনি ইনসেপ্টার সত্ত্বাধিকারী সেহেতু তাঁর কাছে আমার প্রশ্ন ছিলো এই ভ্যাকসিন আবিষ্কারের বিষয়ে ইনসেপ্টার ভুমিকা কী ছিলো? তিনি বলেন, ইন্টারন্যাশনাল স্ট্যান্ডার্ড এ বাংলাদেশে একটি ওষুধ কোম্পানি আছে আর সেটি হলো ইনসেপ্টা। তিনি জানান, প্রতিষ্ঠানটি বিগত ১০ বছর ধরে টায়ফয়েড, কলেরা ও র্যাবিস বা জলাতঙ্কসহ বিভিন্ন ধরনের রোগের ভ্যাকসিন তৈরি করে আসছে। কিন্তু কোভিড-১৯ যেহেতু রোগের নতুন একটি মাত্রা ছিলো, তাই এর ভ্যাকসিনের ব্যাপারে নানাবিধ বিধি-নিষেধ ছিল এবং এজন্য তারা চাইলেও তৈরি করতে পারতেন না। বিল এন্ড মেলিন্ডা গেটস ফাউন্ডেশন তাদের কাছ থেকে কলেরার ভ্যাকসিন নিয়েছেন বলে দাবী করেন তিনি। করোনার সময় রাশিয়াও তাদেরকে ভ্যাকসিনের জন্য বলেছিলো, কিন্তু কিছু বিধি নিষেধের জন্য তাদের পক্ষে এ নিয়ে কাজ করা সম্ভব হয়নি। তিনি ব্যাখ্যা দিয়ে জানান, প্রথমত, ওষুধ প্রশাসনের অনুমতি প্রয়োজন, দ্বিতীয়ত, তাদেরকে ওষুধ তৈরির ফর্মুলা দিতে হবে। তাঁর মতে ভ্যাকসিন তৈরির জন্য ফর্মুলা পাওয়াও অতো সহজসাধ্য কোন বিষয় নয়। ভ্যাকসিন আবিস্কার ও প্রক্রিয়াজাতকারি প্রতিষ্ঠান ফাইজার পণ্য বাজারজাত করার শুরুর দিকেই তাদেরকে ফর্মুলা দিবে না বলে জানান তিনি। এছাড়াও, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলেছিলো প্রায় সাড়ে ৪ কোটি ফ্রী এম্পুল আছে কিন্তু সেগুলো কবে পাবে সেসবেরও তখন নিশ্চয়তা ছিলো না।

এতো জনবহুল একটা দেশে সকল মানুষকে ভ্যাকসিনের আওতায় আনা সম্ভব কি না, যদি সম্ভব হয় তবে কতদিন লাগতে পারে এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, “জনসংখ্যা ১৭/১৮ যাই হোকনা কেন, এটি খুব দূরুহ ব্যাপার নয়। তবে এটি সময়সাপেক্ষ বিষয়। দিন কিংবা মাসের মাঝে সবাইকে ভ্যাকসিনের আওতায় আনা সম্ভব হতোনা বলে জানিয়েছেন তিনি এবং এটিকে একটি দীর্ঘমেয়াদী প্রকল্পের মতো কাজ করতে পারে বলে তাঁর অভিমত। উদাহারন হিসেবে তিনি ছোটবেলায় দেয়া চিকেন পক্সের ভ্যাকসিনের কথা উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, তখন ধারাবাহিক ভাবে ভ্যাকসিন বা টিকা প্রদান করতে হতো এবং আমরা এখনও দেখি ছোট বাচ্চাদের পোলিওর টিকা খাওয়ানো হয়। আর করোনার ভ্যাকসিন সংরক্ষণ করাও সহজ বিষয় নয় বলে জানান তিনি। ফাইজারকে মাইনাস ১৭ ডিগ্রী সেলসিয়াস তাপমাত্রার রাখতে হয় যা আমাদের পক্ষে সম্ভব নয়। তবে গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলো যদি নতুন কোন ফর্মুলা নিয়ে আসে যেটা হয়তো মাইনাস ১৫ কিংবা ১০ ডিগ্রী সেলসিয়াস তাপমাত্রায় রাখা যাবে, তাহলে বাংলাদেশের জন্য সংরক্ষণ করা সহজ হবে বলে তিনি মনে করেন। তাছাড়া শুধু ভ্যাকসিন আবিষ্কার করলেই হবে না, এখানে অনেকগুলো বিষয় থাকে যেমন-কারা আগে পাবে, কিভাবে পুরো দেশে বিরতণ করবে ইত্যাদি। তাই এটি আসলেই সময়সাপেক্ষ ব্যাপার।

সোঁদামাটির গন্ধ আর প্রকৃতির কাছে বড় হওয়া মহৎ ব্যক্তি প্রকৃতির কাছাকাছি থাকতে, প্রকৃতি নিয়ে কাজ করতে, প্রকৃতির সুরক্ষায় অন্যদের উৎসাহিত করতে সদা তৎপর। তাইতো গত এক দশকেরও অধিক সময় ধরে ‘প্রকৃতি ও জীবন’ অনুষ্ঠানের সাথে তার পথচলা। কেন প্রকৃতি ও জীবনের কথা মাথায় আসলো এবং এই বিশাল একটা সময় ধরে পরিচালনা করা অনুষ্ঠানটির অভিজ্ঞতা কেমন এই প্রশ্নের জবাবে তিনি জানান, এই চিন্তাটি হঠাৎ করেই তাঁর মাথায় আসে। তিনি চ্যানেল আইতে ‘পারফরম্যান্স এওয়্যার্ড’ নামে একটি অনুষ্ঠান পরিচালনা করতেন। এই অনুষ্ঠান শুরুর আগে ডকুমেন্টারি করা হতো। সেই ডকুমেন্টারিতে এক এক সময় এক এক বিষয় উঠে আসতো। ২০০৮ সালে আরব আমিরাততের জীববৈচিত্র নিয়ে একটি ডকুমেন্টারি করেন তিনি। ডকুমেন্টারিটি করার সময় তিনি লক্ষ্য করেন, ওরা একটি দেশকে সবুজ করার জন্য গাছ লাগাচ্ছে, ঘাস লাগাচ্ছে, বিভিন্ন জায়গা থেকে পশুপাখি নিয়ে আসছে। তখন তাঁর কেমন একটা অনুভব হলো যে একটা দেশে কিচ্ছু নেই, তপ্ত মরুভূমিকে শীতল করার জন্য মিলিয়ন মিলিয়ন ডলার খরচ করছে তারা অথচ যেখানে আমাদের দেশ এতো ছোট একটি দেশ কিন্তু জীববৈচিত্রে ভরপুর কিন্তু সেখানে আমাদের অযত্নে, অবহেলায় আমরা সব শেষ করে ফেলছি। সেখান থেকেই মূলত তাঁর ভাবনা শুরু। ২০০৮ সালে শেষের দিকে দেশে ফিরে তিনি আনিস সাহেবের সাথে তার পরিকল্পনা নিয়ে আলোচনা করেন এবং আনিস সাহেবকে দিয়ে বাংলাদেশের বিভিন্ন জায়গার ভিডিও চিত্র ধারণ করান। তার ভিডিও টিম ৬ মাস দেশের আনাচে কানাচে ঘুরে ঘুরে ১৫২ টা মিনি ভিডিও ধারণ করেন এবং ভিডিওগুলো দেখার পর মনে হলো আমাদের দেশে অনেক কিছু আছে। ২০০৯ সালে প্রকৃতি ও জীবনের যাত্রা শুরু এবং ২০১০ সালে প্রথম পর্ব টেলিভিশনে সম্প্রচারিত হয়। ‘ভোঁদড়ের ভোরে’ পর্বটি সম্প্রচারের মধ্য দিয়ে যাত্রা শুরু করে তাঁর স্বপ্নের প্রকৃতি ও জীবন। শুরুর দিক দিয়ে খুব ভালো সাড়া পাওয়া যায়নি এবং দর্শকরা তখন তেমন আগ্রহী ছিলেন না। কিন্তু ধীরে ধীরে এটি একটি নিয়মের আওতায় চলে এসেছে। ২৫ জন কর্মী কাজ করে এই টিমে। শুধু টেলিভিশনে সম্প্রচার হয় এমন নয়, এই অনুষ্ঠান নিয়ে গবেষনা হয়, ফিল্ড ওয়ার্ক হয় এবং নানা ধরনের পাবলিকেশন হয় এবং জনাব মুকিতের তত্ত্বাবধানে ‘প্রকৃতি বার্তা’ নামে ত্রৈমাসিক একটি পত্রিকাও প্রকাশিত হয়। পত্রিকাটি প্রকৃতি নিয়ে নানা ধরণের বার্তা প্রেরণ করছে এবং আমাদের সমাজের কাছে প্রকৃতির বিভিন্ন চিত্র তুলে ধরছে। শুধু তাই নয়, এই টিম বিভিন্ন প্রত্যন্ত অঞ্চলে যায়, যেখানে ইন্টারনেটের সুবিধা নেই, যেখানে পৌঁয়াছনি কোন আধুনিকতার ছোঁয়া, যেখানে নেই কোন টেলিভিশন। সেখানের স্কুলে স্কুলে গিয়ে তারা তাদের অনুষ্ঠান দেখায়, ডকুমেন্টারি দেখায়, তাদের সাথে প্রকৃতির কথা বলে, প্রকৃতিকে ভালোবাসতে শেখায়।

মুকিত মজুমদার বাবু নিয়মিত লেখালেখি করেন। তিনি বিভিন্ন জাতীয় দৈনিকের মাধ্যমে নিজের ভাবনাগুলোকে অন্যের কাছে পৌঁছে দিতে চাচ্ছেন। পত্রিকা সম্পাদনা ছাড়াও প্রতিবছর বইমেলায় প্রকাশিত হচ্ছে তাঁর প্রকৃতি বিষয়ক গ্রন্থ। তাঁর উল্লেখ্যযোগ্য গ্রন্থের মাঝে রয়েছে, ‘আমার রূপসী বাংলা,আমার দেশ আমার প্রকৃতি,আমার অনেক ঋণ আছে’ ইত্যাদি। তাছড়া,তৃণমূল পর্যায়ে সচেতনতা সৃষ্টি করতে আয়োজন করছেন ব্যতিক্রমী ‘প্রকৃতিমেলা’।এর পাশাপাশি প্রকৃতি ও জীবন ফাউন্ডেশন থেকে নির্মাণ করছেন বিভিন্ন টক শো,ডকুমেন্টারি ও টেলিফিল্ম। প্রকৃতি সংরক্ষণে বিশেষ অবদানের জন্য দেওয়া হচ্ছে প্রকৃতি সংরক্ষণ পদক।

আমাদের দেশে প্রায় ১৫০০ নদী ছিলো এখন কমে প্রায় ৭০০ হয়েছে। একসময় নদীগুলোও ছিলো প্রাকৃতিক পরিবেশের অভয়ারণ্য।কিন্তু বর্তমানে এসব দেখা যায় না। এর কারন কী এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, এটার একটা নির্দিষ্ট কোন কারন নেই। জলবায়ুর উষ্ণায়ন সবচেয়ে বড় কারন হিসেবে তিনি মানবসৃষ্ট কারনকেই দায়ী করেন। তিনি বলেন, আমরা বনভূমি উজার করে দিচ্ছি।আমরা নিজেদের স্বার্থে নদী ভরাট করছি।আমরা উন্নয়নের জন্য ঘর বাড়ি নির্মাণ করছি কিন্তু আমাদের পরিবেশের উন্নয়ন দেখছি না আমরা। তিনি বলেন, আমরা যদি পরিবেশকে ভালো না রাখি তাহলে কে রাখবে? আমাদের দেশ অর্থনৈতিকভাবে উন্নত হচ্ছে। শিল্প কারখানা ও শিল্পায়নে ক্রমাগত উন্নত হচ্ছে কিন্তু উন্নতির ধারাবাহিকতায় শহরগুলোতে চাপ সৃষ্টি হয়েছে যার প্রভাব আমরা দেখতে পাই। এক্ষেত্রে প্রকৃত ও জীবনের ভূমিকা তুলে ধরে তিনি বলেন, ছোটবেলায় আমাদের ধর্মের শিক্ষা দেওয়া হয়, যেখানে সেখানে ময়লা না ফেলতে শিক্ষা দেওয়া হয়, ঝগড়া না করতে শিক্ষা দেওয়া হয় কিন্তু গাছের ঢাল ভাঙ্গা যাবে না এই শিক্ষা দেওয়া হয় না, ব্যাঙ এর গায়ে ঢিল ছুঁড়া যাবে না এই শিক্ষা দেওয়া হয় না। কারন আমরা নিজেরাও আমাদের জীবনে প্রকৃতির অবদান জানিনা। যদি প্রকৃতির অবদানগুলো ছোটবেলা থেকেই বাচ্চাদের শেখানো যায় তাহলেই আমাদের প্রকৃতি রক্ষা করা সম্ভব। তিনি আরও বলেন, তাঁর এই প্রকৃতি ও জীবন অনুষ্ঠানটি মানুষকে প্রকৃতির অবদান সম্পর্কে জানানোর জন্যই।

আমাদের দেশে সুন্দর সুন্দর দ্বীপ রয়েছে এবং এ দ্বীপগুলোতে প্রাকৃতিক পরিবেশের সুন্দর ভারসাম্য রয়েছে। রয়েছে সুন্দর প্রবাল দ্বীপ যেখানে সামুদ্রিক প্রানীর বসবাসের জন্য রয়েছে উপযুক্ত ব্যাবস্থা কিন্তু এই দ্বীপ্পগুলো আবার আমাদের অর্থনীতির বিশাল ভান্ডার। যেমন-সেইন্টমার্টিন, নিঝুম দ্বীপ, সোনাদিয়া ইত্যাদি। একদিকে অর্থনীতি অন্যদিকে প্রাকৃতিক পরিবেশ এই দুইটা মিলে প্রাকৃতিক ভারসাম্যে কোন প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করছে কি না এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, প্রকৃতপক্ষে সকল সমস্যার মূল সমস্যা হলো জনসংখ্যা। জনসংখ্যার বিষয়টিকে একটা সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনায় না আনতে পারলে, জনগনকে কোন নিয়মের মধ্যে না ফেলতে পারলে সকল ধরনের প্রকৃতির উপরই প্রভাব পড়বে। তবে সমস্যা থাকলে সমাধান অবশ্যই আছে বলে তিনি মনে করেন। জনগনের সচেতনতা আর রাষ্ট্রীয় উদ্যোগই পারে এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে।

প্রকৃতিপ্রেমী এই ব্যক্তিত্ব, পরিবেশ বিষয়ক বহুমাত্রিক কাজের স্বীকৃতি হিসেবে ‘ফেবানা এ্যাওয়ার্ড-২০১৬, জাতীয় পরিবেশ পদক-২০২৫, ঢাকা আহছানিয়া মিশন চাঁদ সুলতানা পুরষ্কার -২০১৫, বিজনেস এক্সিলেন্সি এ্যাওয়ার্ড সিঙ্গাপুর ২০১৪, বঙ্গবন্ধু এ্যাওয়ার্ড ফর ওয়াইল্ড লাইফন কনজারভেশন -২০১৩, এইচএসবিসি দ্যা ডেইলি স্টার ক্লাইমেট এ্যাওয়ার্ড -২০১২ সহ আরও বিভিন্ন পুরুষ্কার ও সম্মাননা অর্জন করেছেন। স্বপ্ন পূরণের দিকে একটু একটু করে এগিয়ে যাচ্ছেন তিনি। দেশের প্রতিটা মানুষের কাছে পৌঁছে দিতে চান প্রকৃতি ও জীবনকে রক্ষা করার আর্জি।

একজন সামাজিক বিশ্লেষক ও আদর্শ শিক্ষক: রাশেদা রওনক খান

একজন সামাজিক বিশ্লেষক ও আদর্শ শিক্ষক: রাশেদা রওনক খান

কিছু কিছু মানুষের পরিচয় কখনোই একটি শব্দে কিংবা কয়েকটি বিশেষণে প্রকাশ করা যায় না, তেমনি একজন মানুষ হলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞানের সহযোগী অধ্যাপক, ডঃ রাশেদা রওনক খান। শিক্ষক, সমাজ বিশ্লেষক, গবেষক ও কলাম লেখক হওয়ার পাশাপাশি তিনি জনপ্রিয় একজন টেলিভিশন উপস্থাপকও, সুতরাং তাঁর পরিচয়ের সীমা যাচাই করতে যাওয়া রীতিমতো দুঃসাহস। “কবিতার সাথে” অনুষ্ঠানের মাধ্যমে কথা হল অমিত প্রতিভার অধিকারী এই শিক্ষকের সঙ্গে, যেখানে উঠে এসেছে তাঁর সংসার, সমাজ ও পেশাগত জীবনসহ আরও অনেক বিষয়ের অজানা সব তথ্য। করোনার অচলাবস্থা নিয়ে বলতে গিয়ে নিজের ব্যক্তিগত স্বাস্থ্য ছাপিয়ে তাঁর কথায় উঠে এসেছে সামাজিক অসুস্থতা ও অচলাবস্থার কথা, যেভাবে চিন্তা করা হয়তো তাঁর মতো একজন সমাজ বিশ্লেষকের পক্ষেই সম্ভব।

রাশেদা রওনক খান ব্রাহ্মণবাড়ীয়ার সম্ভ্রান্ত একটি মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর মা সরকারি কলেজের অধ্যক্ষ এবং তিন ভাই- বোনের মধ্যে সবার ছোট। বড় বোন জাবির ২৩ ব্যাচের ছাত্রী এবং বর্তামানে সিলেটের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। ভাই ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল থেকে এমবিবিএস পাশ করে কুমিল্লা মেডিকেল কলেজে সহকারী অধ্যাপক হিসাবে কর্মরত আছেন। এবং রাশেদা রওনক ২০০৬ সালে জাবিতে শিক্ষক হিসাবে যোগদান করেন। বেশ কয়েক বছর জাবিতে পড়িয়ে পরবর্তিতে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগদান করেন। বর্তমানে ঢাবির নৃবিজ্ঞান বিভাগে সহকারী অধ্যাপক হিসেবে কর্মরত আছেন।

“রত্নগর্ভা” এবং “বেগম রোকেয়া” সম্মাননা পাওয়া মা প্রফেসর জোহরা আনিস সম্পর্কে বলতে গিয়ে রাশেদা রওনক খান বলেন, শুধু তাঁর নিজেরই নয়, পৃথিবীর যেকোনো মানুষের সাফল্যের পেছনে সর্বোচ্চ পরিশ্রমকারী ব্যক্তি হলেন মা। তিনি জানান যে, ছোটবেলার শাসনকারী সেই কড়া মা এখন তাঁর সবচেয়ে কাছের বন্ধু। নিজের ব্যক্তিজীবনে প্রফেসর জোহরা আনিস শিক্ষকতার পাশাপাশি শতাধিক সংগঠনের সাথে জড়িত ছিলেন। এত কিছুর পরও নিজের সন্তানদেরকে তিনি যে প্রয়োজনীয় সময় দিয়েছেন এবং যত্নের সাথে লালন করেছেন, সে জন্যে রাশেদার কন্ঠে তাঁর মায়ের জন্য বারবার কৃতজ্ঞতা ফুটে উঠেছে। রাশেদা বলেছেন তাঁর মায়ের যত্নে ও অনুপ্রেরণায় কীভাবে অসংখ্য শিক্ষার্থী সুন্দর ও সাফল্যমন্ডিত শিক্ষাজীবন পেয়েছে।

দেশের বর্তমান শিক্ষার অবস্থা নিয়ে বলতে গিয়ে এ শিক্ষক বলেন, যদিও আমরা নীতিগত দিক থেকে প্রয়োজনীয় বেশকিছু পদক্ষেপ নিয়েছি, কিন্তু সেগুলোর বাস্তবিক প্রয়োগে এখনও অসংখ্য বাঁধা রয়েছে। বিশেষ করে, নিম্নবিত্ত জনগোষ্ঠীর বাচ্চাদের স্কুলমূখী করার ক্ষেত্রে নানা ধরণের চ্যালেঞ্জ আছে। যেমন, অর্থনীতির যে যে ক্ষেত্রে বাংলাদেশ উন্নতি করেছে, তার অনেকগুলোতেই শ্রমের মূল্য কমিয়ে আনতে কর্মী হিসেবে নারী ও শিশুদের নেয়া হয়। নিম্ন আয়ের পরিবারে পরিবারের আয়ের জন্য শিশুদেরকে বাসাবাড়িতে কিংবা দোকানে কাজ করতে হয়। এসব জায়গা থেকে বের করে এনে শিশুদেরকে স্কুলমূখী করতে হবে। এতে করে আমাদের ভবিষ্যত শ্রমবাজার আরও বেশি দক্ষ হবে। উদাহারন হিসেবে তিনি বলেন, আমাদের প্রবাসী শ্রমিকরা এখন বিভিন্ন ভারী কাজের সাথে যুক্ত আছেন এবং অনেক ক্ষেত্রেই তারা নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন। এ ধরণের সমস্যাগুলো থেকে পরিত্রাণের জন্য অন্তত কর্মমূখী শিক্ষায় এসব নিম্নমধ্যবিত্ত শিশুদের অন্তর্ভূক্ত করতে আমাদেরকে ও এ সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়কে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হবে। এতে করে এদের ভবিষ্যত কর্মক্ষেত্র আরও উন্নত ও উৎপাদনশীল হবে।

বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররাজনীতিকে খুব কাছে থেকে দেখা ডঃ রাশেদা রওনক খান এ বিষয়ে বেশ খোলামেলা কথা বলেন। তিনি বলেন, বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে ছাত্র রাজনীতি শুরু হয় হয়তো মতাদর্শ বা ক্ষমতার লোভ থেকে, কারো কারো ক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে সিট পাওয়ার মত সাধারন ব্যাপারের জন্যেও হতে পারে। কিন্তু, ধীরে ধীরে রাজনীতি কিংবা নেতাদের সাথে সাধারণ শিক্ষার্থীদের বড় একটি দূরত্বের সৃষ্টি হয়। ছাত্রনেতাদের সাথে সাধারণ শিক্ষার্থীদের এ দুরত্বের ওপর গুরুত্বারোপ করে তিনি বলেন, ছাত্ররাজনীতি হতে হবে শিক্ষার্থীদের কল্যানে, ছাত্রনেতাদের থাকতে হবে শিক্ষার্থীদের আরও কাছাকাছি, আলাদা কোনো সত্ত্বা হিসেবে নয়। সামাজিক সমস্যায় জর্জরিত এদেশের একটি বড় সমস্যা হল ধর্ষণের মত অপরাধের উত্তরোত্তর সংখ্যাবৃদ্ধি। এ ব্যাপারে তিনি বলেন, পুনর্বাসনের মতো ব্যাপারে সরকারের পাশাপাশি এনজিও ও অন্যান্য উদ্যোগেরও এগিয়ে আসতে হবে। এছাড়াও, পতিতালয় হ্রাস বা তুলে দেয়া কখনো ধর্ষণের সমাধান হতে পারেনা বলেও জানান তিনি। তিনি দাবী করেন, ধর্ষকরা আমাদের চারপাশেই আছে, ভাল মানুষের মতই তারা আমাদের আশেপাশে ঘুরে বেড়ায় । তাই, বিশেষত শিশুদের আরও সতর্ক করতে হবে এবং তাদেরকে প্রয়োজনীয় শিক্ষা দিতে হবে যাতে করে তারা নিজেদের এ ধরনের ঘটনা থেকে বাঁচাতে পারে। ধর্ষন রোধে তিনি সম্মিলিত সামাজিক উদ্যোগের ওপর জোর দেন। পর পর এমন অনেকগুলো ধর্ষণের ঘটনায় মানসিকভাবে দগ্ধ এক শিক্ষকের আক্রোশও যেন ফুটে ওঠে তাঁর কথায়, যে আক্রোশ আমাদের অনেকেরই প্রতিচ্ছবি। তিনি স্পষ্ট সুরে সর্বোচ্চ শাস্তি দাবী করেন ধর্ষণকারী নরপশুদের এবং তাদেরকে তেমনই কঠিন কোনো যন্ত্রণার মধ্যে নিপতিত করা উচিৎ বলে মনে করেন তিনি।

আড্ডা দিতে দিতে তিনি আলোকপাত করেন আমাদের বর্তমান পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থার উপরে। যেখানে কর্পোরেট নিয়ন্ত্রিত আর্থসামাজিক ব্যবস্থায় অর্থই মূলকথা, সেখানে মানবতার সুযোগ খুব কম বলেই মনে করেন তিনি। তিনি বলেন, এই পুঁজিবাদী প্রতিযোগিতাই ধ্বংস করে দিচ্ছে আমাদের সমাজের পারস্পরিক সৌহার্দ, সহাবস্থান এবং সাহায্যের মনোভাব। তাঁর মতে এর প্রভাব সাধারণ অনেক ঘটনার মধ্য দিয়েও আমরা প্রতিফলিত হতে দেখি, যেমন ঈদ বা অন্য কোনো উৎসব আসলেই যেভাবে সব কিছুর দাম বাড়িয়ে দেয়া হয় সাধারন মানুষের চিন্তা না করে, এটাও এই মানবতাহীন, প্রতিযোগিতামূলক, আর্থকেন্দ্রীক ব্যবস্থারই ফসল।

বর্তমানে নিজস্ব সংস্কৃতি থেকে সরে যাওয়ার যে প্রবণতা বাঙালিদের মধ্যে প্রতীয়মান সে ব্যাপারে ডঃ রাশেদা আক্ষেপ করে বলেন, বর্তমানে আমরা একটা হাইব্রিড সংস্কৃতির মধ্যে বাস করছি যেখানে বিভিন্ন দেশের সংস্কৃতির সাথে পরিচয়ের ফলে আমরা আমাদের নিজস্ব অবস্থান থেকে সরে যাচ্ছি। যদিও পরিবর্তনই সংস্কৃতির ধর্ম, তবুও আমাদের নিজস্ব সংস্কৃতির শেকড় আঁকড়ে ধরেই তা করা উচিৎ বলে মন্তব্য করেন তিনি।

“ফার্স্ট ভোটার” এর মতো বেশ কিছু ভিন্নধর্মী টকশোর উপস্থাপক রাশেদা রওনক খান তাঁর বিষয়বস্তু নির্বাচন নিয়ে বলেন, নিজস্ব মতাদর্শ, চিন্তাধারা এবং ইচ্ছার সাথে মিললে তবেই তিনি টক শো এর কাজ করেন। তাই নিয়মিত উপস্থিতি কখনোই তাঁর প্রাধান্য নয়, বরং তিনি চেষ্টা করেন নিজের অবস্থান থেকে রাজনৈতিক সচেতনতা তৈরির কাজ করে যাওয়ার। এ ব্যাপারে তিনি বিশেষ কৃতজ্ঞতা ব্যক্ত করেন দুই বরেণ্য ব্যক্তিত্ব ফরিদুর রেজা সাগর ও শাইখ সিরাজের প্রতি, যাদের অনুপ্রেরণায় ও সহযোগীতায় তিনি স্বাধীনভাবে কাজ করতে পেরেছেন। নিজের বাকস্বাধীনতার প্রতি সম্মান রেখেই, কোনো ব্যক্তি বা আদর্শিক মনোভাবে যাতে আঘাত না লাগে সেভাবে অনুষ্ঠানগুলো পরিচালনা করেছেন বলে জানান তিনি।

মানব পাচারের মত ভয়ংকর সামাজিক সমস্যা নিয়ে কথা বলতে গিয়ে তিনি বলেন, প্রথমেই আমাদের দরকার সচেতনতা। বিশেষত গ্রাম পর্যায়ে আমাদের উচিৎ যত বেশি সম্ভব মানব পাচারের ভয়াবহতা নিয়ে মানুষকে অবহিত করা। তিনি মনে করেন, এই পাচারকারীদের অবশ্যই সরকারের কোনো না কোনো মহলে যোগাযোগ রয়েছে। তাই সরকারকে এদের চিহ্নিত করে যথাযথ আইনের আওতায় আনতে হবে বলে জানান তিনি। আমাদের দেশের মানুষেরা হয়তো একটি ভালো জীবনের আশায় বিদেশে যেতে চায়, পরিবারের হাল ধরতে চায়, কিন্তু অনেক স্বপ্নই বিনষ্ট হয় পাচারকারীদের পাল্লায় পড়ে। ডঃ রাশেদা গবেষণা করেছেন নগরায়ণের রাজনীতি এবং এই রাজনীতির কারণে নাগরিক সুবিধা থেকে দরিদ্রদের বঞ্চিত হওয়া নিয়ে। তিনি জানান, নিজের গবেষণার জন্য ২ বছর ঢাকার বিভিন্ন বস্তিতে গিয়ে মানুষের জীবনযাপন অনুধাবন করেছেন তিনি। যেখানে শহরের কিছু মানুষ খুব ভাল আছেন, সেখানেই আবার কিছু মানুষ আছেন নিদারুন কষ্টে। অথচ এই মানুষগুলো কিন্তু কর্মঠ মানুষ, তাদের এই পরিশ্রমকে সঠিকভাবে কাজে লাগিয়ে তাদের জীবনযাত্রার মানোন্নয়ন করতে হবে বলে মন্তব্য করেন তিনি। তিনি আরও বলেন, যে গার্মেন্টস শিল্প নিয়ে আমাদের এত সুনাম, এত অর্জন, সেই গার্মেন্টস শিল্পের নারীদেরকে কি আমরা যথাযথ মূল্যায়ন করতে পেরেছি? তাদের ব্যক্তিজীবনের সামাজিক, শারীরিক বা অর্থনৈতিক সুরক্ষা নিশ্চিত করতে পেরেছি? এই ভেদাভেদের পরিবর্তে বরং সবাইকে নিয়ে কাজ করলেই আমাদের দেশ ও সমাজ এগিয়ে যাবে।

নিজের সম্পর্কে ডঃ রাশেদা বলেন, নিজের বর্তমান জীবন নিয়ে তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি অত্যন্ত ইতিবাচক এবং নিজের অবস্থানে অত্যন্ত সন্তুষ্ট তিনি। তিনি মনে করেন রাষ্ট্র, সমাজ এবং পরিবারের প্রতি তিনি দায়বদ্ধ। তিনি তথা বাংলাদেশের যেসকল শিক্ষার্থীরা নামমাত্র খরচে উচ্চশিক্ষা নিয়েছেন এবং নিচ্ছেন, তাদের এই শিক্ষার পেছনে অবদান রয়েছে মানুষের পরিশ্রমের। তাই কোনোদিন সুযোগ পেলে সেই মানুষদের জন্য ব্যক্তিগত অবস্থান থেকে যতটুকু সম্ভব করে যেতে চান তিনি, তাঁর গবেষণার বিষয়বস্তুতেও সেটি প্রতিফলিত হয়। এই কারণেই হলি আর্টিজানের হামলার পরপরই তিনি টানা বিভিন্ন টকশোতে গিয়েছেন মানুষকে সচেতন করার উদ্দেশ্যে। আবারও প্রয়োজন পড়লে তিনি মানুষের জন্য একইভাবে কাজ করবেন বলে জানিয়েছেন। সমাজের সকল স্তরে বিচরণ করা এই গুণী ব্যক্তিত্বের বিচরণ কিন্তু রবিঠাকুর, নজরুল এবং জীবনানন্দের কবিতার জগতেও। সামাজিক নানা সমস্যা নিয়ে প্রতিবাদী এই কন্ঠ থেকে তাই বিদায়ী মূহুর্তে শান্তভাবে ঝরে পড়ে “বনলতা সেন” ও। সুন্দর এই মানুষটির জীবন যাতে সুন্দরতর হয়, সফল হয়, এই কামনায় রইল তাঁর জন্য।

শিশুশিল্পী থেকে প্রজন্মের সেনসেশন: তমালিকা কর্মকার

শিশুশিল্পী থেকে প্রজন্মের সেনসেশন: তমালিকা কর্মকার

মানুষের নিজের উপলব্ধিকে অন্যের কাছে তুলে ধরার জন্য সাহিত্য যেমন ভূমিকা রাখে ঠিক তেমনি সমাজের চিত্রকে সবার মাঝে তুলে ধরে নাটক ও সিনেমা। নাটক ও সিনেমা মানুষকে অন্য এক জগতে নিয়ে যায়। নিজেকে নিয়ে ভাবতে শেখায়। নিজের দেশ, সংস্কৃতিকে তুলে ধরার জন্য এর চেয়ে সহজ পন্থা বোধহয় কমই আছে। আর এই রূপালি জগতের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ হলেন আমাদের অভিনয় শিল্পীরা। শিল্পী তার নিজের সকল দক্ষতা কাজে লাগিয়ে নিজেকে সাধারণ মানুষের খুব কাছাকাছি নিয়ে যান। অভিনয়ের বিভিন্ন চরিত্রকে নিজের মাঝে ফুটিয়ে তুলে নিজেকে ছাড়িয়ে তাঁর চরিত্রের মানুষটি হয়ে যুগ যুগ বেঁচে থাকেন কোটি কোটি দর্শকের হৃদয়ে। আজ এমন একজন অভিনয় শিল্পীর কথা বলব, যার বড় হওয়া ও বেড়ে ওঠা হয়েছিল সাংস্কৃতিক পরিমন্ডলে থেকেই। যার পদচারণায় আরও বিকশিত হয়েছে বাংলাদেশের সোনালী ও রূপালি পর্দার জগৎ। যিনি রাঢ়াঙ নাটকের শ্যামলী, ময়ূর সিংহাসন এর কৃষ্ণা এবং বিদ্যাসাগর নাটকের রাধা চরিত্রগুলোর মধ্য দিয়ে দর্শক মনে বিশেষভাবে জায়গা করে নিয়েছেন; বলছি জনপ্রিয় অভিনয় শিল্পী তমালিকা কর্মকারের কথা।

তমালিকা কর্মকার একজন বাংলাদেশী মডেল ও নাট্য অভিনেত্রী। একই সাথে তিনি একজন কোরিওগ্রাফার এবং প্রশিক্ষকও। মঞ্চ নাটক, টেলিভিশন, ও চলচ্চিত্রে সমানভাবে পদচারণা রয়েছে তাঁর। জনপ্রিয় এই অভিনেত্রী ১৯৭০ সালের ২রা জুলাই খুলনায় জন্মগ্রহণ করেন এবং জন্মের কিছুদিন পরেই তিনি স্বপরিবারে ঢাকায় চলে আসেন। তার মা ছিলেন বিটিভির নিয়মিত নজরুল সংগীত শিল্পী। এছাড়াও তিনি শ্যামাসংগীতও গাইতেন। মাত্র তিন বছর বয়স থেকে অভিনয় শুরু করেন তিনি। ১৯৭৮ থেকে ১৯৮০ সাল পর্যন্ত বিটিভিতে আয়োজিত ফুলকুঁড়ি অনুষ্ঠানে গল্প বলা পর্বে অংশগ্রহণ করতেন তিনি।

কিভাবে বেড়ে উঠা এবং অভিনয় জগতে প্রবেশ এই প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ঠিক মনে নেই তার। যখন থেকে তিনি অভিনয় শুরু করেছেন তখন তিনি বুঝতেনই না অভিনয় কী? ছোটবেলা থেকেই সাংস্কৃতিক অঙ্গনে বড় হওয়ার ফলে তাঁর কাছে অভিনয়, গান, নাচ এসব সহজাত মনে হতো। পড়াশোনা যেমন স্বাভাবিক কাজ, করতেই হবে, ঠিক তেমনি অভিনয়কেও তিনি স্বাভাবিক হিসেবেই ধরতেন। গহর জামিলের কাছে তার নাচ শেখা, ছায়ানটে গান এবং আর্ট কলেজে ছবি আঁকা শেখা। সাংস্কৃতিক অঙ্গনের এই দিকগুলোকে তিনি অন্যান্য কাজের মতই ভাবতেন, তার কাছে বিশেষ কিছু মনে হয়নি।

অভিনয়ে আগ্রহী হলেন কিভাবে এই প্রশ্নের জবাবে তিনি জানান, তাঁর মা একজন সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব ছিলেন এবং ছোটবেলা থেকেই তিনি খুব কাছে থেকে তাঁর মাকে দেখেছেন। তাঁর মা নাট্যকলার সদস্য ছিলেন এবং মঞ্চ নাটকে গান করতেন। সবাই যখন গান শেষে হাততালি দিতো সেটি তমালিকাকে খুব মুগ্ধ করতো। ছোট বেলা থেকেই তিনি তাঁর মায়ের সাথে সিনেমা হলে গিয়ে হিন্দি ও বাংলা সিনেমা দেখতেন ও মঞ্চ নাটক দেখতেন। ছোটবেলায় মঞ্চ নাটক কী তা বুঝতে না পারলেও এভাবে মায়ের সাথে নিয়মিত আসা যাওয়ার মধ্য দিয়ে তিনি ধীরে ধীরে অভিনয় কী তা অনুধাবন করা শুরু করলেন। পর্দার চেয়ে মঞ্চের অভিনয় বেশি প্রানবন্ত ও জীবন্ত যা তমালিকাকে আকৃষ্ট করেছে অভিনেত্রী হয়ে উঠতে। তিনি মনে করেন, ইন্টারনেটের রিভিউ দেখে বা ছবির সমালোচনা দেখে কোনো অভিনয় সম্পর্কে সঠিক ধারণা পাওয়া যায় না, এজন্য সামনে থেকে দেখে তা উপলব্দি করতে হয়।

বাংলাদেশের বর্তমান সময়ের মিডিয়া জগৎ নিয়ে তমালিকা কর্মকারের কিছু আক্ষেপ আছে। বাংলাদেশে এখন মানসম্মত নাটক সিনেমা কম হয় বলে তিনি মনে করেন। নতুনদের সাথে পুরাতনদের গুণগত কোনো পরির্তন রয়েছে কি না এই প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, পূর্বের শিল্পীরা বর্তমান প্রজন্মের শিল্পীদের থেকে মানসিকভাবে অনেক আধুনিক ছিলেন। তিনি মনে করেন এখন বাংলা নাটক ও সিনেমাতে প্রযুক্তিগত উন্নতি হয়েছে তবে তা সামগ্রিক উন্নতি নয়। তাঁর মতে বর্তমানে এ জগতে চাকচিক্য বেঁড়েছে, সিনেমাটোগ্রাফির ধরন পরিবর্তন হয়েছে, আধুনিকতা এসেছে তবে মানসিকতায় ঘুণ রয়েছে। এখন আর প্রাণছোঁয়া নাটক হচ্ছে না এবং নাটকে সাংস্কৃতিক উপাদান কমে যাচ্ছে। বাংলা নাটক সিনেমায় এখন ধীরে ধীরে বাঙ্গালিত্ব হারিয়ে যাচ্ছে বলে দুঃখ প্রকাশ করেছেন তিনি। পর্দার আয়োজনে নিজের সত্ত্বা ও নিজের সংস্কৃতির উপস্থিতি থাকা প্রয়োজন। তিনি বলেন, আমাদের অনেক ভালো ভালো শিল্পী আছে কিন্তু তাদের উপযুক্ত সম্মান দেওয়া হচ্ছে না, সঠিকভাবে ব্যবহার করা হচ্ছে না। আমরা অনেকটা ধার করা সংস্কৃতির উপর নির্ভরশীল হয়ে যাচ্ছি। অন্য দেশের সিনেমা থেকে নকল করা প্রসঙ্গে বেশ খোলাখুলিভাবেই তিনি বলেন, নকল করার জন্যও কিছু কোয়ালিটি থাকে। ভারতীয়রাও নকল করে কিন্তু নকলের মাঝেও একটা শিল্প আছে যেটা আমরা পারছি না। হলিউড-বলিউডে অনেক বয়স্করা অভিনয় করেন এবং তাদের কাছে বয়স একটা সংখ্যা, দক্ষতাই আসল। কিন্তু আমাদের দেশে এমনটা হচ্ছে না বরং বাংলা চলচ্চিত্রের গৌরব অবুলপ্ত হয়ে যাচ্ছে ধীরে ধীরে।

বর্তমানে তাঁকে আর পর্দায় দেখা যাচ্ছে না কেন এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি সরাসরি জবাব দেন যে তাকে নেওয়া হচ্ছে না। কিছুটা অভিমানের সুরেই এক সময়ের পর্দা কাঁপানো এই গুণী অভিনেত্রী জানান যে তাদের প্রজন্ম এখন আর নেই এবং এখন আর তাদের জন্য গল্প লেখা হয় না। বর্তমানের নাটকগুলোতে এখন পরিবারভিত্তিক তেমন কিছু থাকে না। এখনকার নাটকে ভালো গল্প নেই বলেও দাবী করেন তিনি। তিনি আরও দাবী করেন যে বর্তমানে মিডিয়া জগতে কোন সম্মান কমে আসছে, তাদের নিয়ে ভাবাও হচ্ছে না এমনকি ভালো পরিচালকেরও অভাব এখন। তবে, হয়তো ভালো ভালো নাটক এখনো হয় কিন্তু তিনি জানেন না।

জনপ্রিয় নির্মাতা চয়নিকা চৌধুরী তমালিকা কর্মকারের বোন ও বিশিষ্ট নাট্য নির্মাতা অরুন চৌধুরি তার বোনের স্বামী। চয়নিকার কাজ কেমন লাগে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বলেন, তাঁর বোন হিসেবে ও অরুন চৌধুরি মানুষ হিসেবে অনেক অমায়িক ও ভালো। অরুন চৌধুরি অনেক ভালো লিখেন ও গল্প বলেন কিন্তু ডিরেক্টর হিসেবে কেমন তা বলতে পারবেন না। কেননা, তারা তাঁর জন্য কিছু করেননি। অরুন চৌধুরীর নাটকে তিনি অভিনয় করেছেন কিন্তু গুরুত্বপূর্ন কোন চরিত্র তিনি তাঁকে দেননি এবং ভালো কাজ করার সুযোগও দেননি। তাই তিনি তাঁর বোন পরিচালক হিসেবে কেমন তা বলতে পারছেন না।

তমালিকা কর্মকার কিভাবে আজকের জনপ্রিয় তমালিকা কর্মকার হয়েছেন অর্থাৎ তার অভিনেত্রী হবার পেছনে কার অবদান রয়েছে এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, তার অভিনেত্রী হবার পেছনে কারও অবদান নেই। তবে তিনি ভালো পরিচালক, দর্শক ও সমালোচকদের প্রশংসা করেছেন। তমালিকা বলেন, তাঁর আজকের এই অবস্থানের জন্য যদি কারোর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে হয় তবে তিনি হলেন তাঁর মা। আবেগভরা কন্ঠে তিনি বলেন, মা যদি তাকে এভাবে গড়ে না তুলতেন তবে তাঁর পক্ষে সম্ভব হতো না আজকের এই অবস্থানে পৌঁছানোর। তবে তিনি বিশেষভাবে একজনের প্রতি কৃতজ্ঞ, তিনি হলেন মামুনুর রশিদ। মামুনুর রশিদের কাছে মঞ্চের জন্য তিনি কৃতজ্ঞ। ১৯৯২ সালে আরণ্যক নাট্যদল প্রযোজিত মানুনুর রশিদের লেখা ও আজিজুল হাকিম নির্দেশিত নাটক ‘পাথর’ এর মাধ্যমে তিনি মঞ্চনাটক শুরু করেন। এরপর আরণ্যক দলের অন্যতম নাটক ইবলিশ, জয়জয়ন্তী, খেলা খেলা, ওরা কদম আলী, প্রাকৃতজনের কথা, রঢ়াঙ, বিদ্যাসাগর, ময়ূর সিংহাসন নাটকে অভিনয়ের মধ্য দিয়ে থিয়েটার অনঙ্গনে জনপ্রিয়তা লাভ করেন।

তমালিকা চৌধুরির এত ভালো কাজের মধ্যে পছন্দের চরিত্র কোনটি এমন প্রশ্নের জবাবে তমালিকা জানান, মঞ্চ তাঁর কাছে অনেক কিছু এবং মঞ্চ তাকে অনেক কিছু দিয়েছে। পাথর নাটকের গ্রামের মেয়ের সাজ, বিদ্যাসাগরের চরিত্র এসব তার কাছে পছন্দের। তমালিকা নিজে যেমন অন্যদের কাছে জনপ্রিয়, অন্যদের ভালোলাগার কিংবা পিছন্দের শিল্পী ঠিক তেমনি তারও পছন্দের শিল্পী রয়েছেন। তমালিকার পছন্দের মানুষ হলেন আফজাল হোসেন।

তমালিকাকে প্রশ্ন করেছিলাম এমন কোনো চরিত্র নিয়ে আক্ষেপ আছে কি না যেটায় তিনি অভিনয় করতে পারেন নি। উত্তরে তিনি “চাঁদনী” ছবিটির কথা উল্লেখ করেন। সেখানে তাঁর অভিনয় করার কথা থাকলেও পরে তিনি করতে পারেন নি। তবে, চাঁদনীতে অভিনয় করার আক্ষেপ থাকলেও তাঁর রয়েছে বৈচিত্রপূর্ণ অভিনয়ের অভিজ্ঞতা। প্রাগৈতিহাসিক পুতুল নাচের ইতিকথা, সূর্যসেনের প্রীতিলতা, চতুর্থমনা ও অনিমেষ আইচের বহু নাটকে অভিনয় করেছেন এই গুণী শিল্পী।
নতুন প্রজন্মের জন্য কোনও উপদেশ আছে কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে তমালিকা জানান উপদেশ কেউ পছন্দ করেন না, তাই তিনি উপদেশ দিতে চাননা। কথার প্রসঙ্গে তিনি জানান অভিনয় তাঁর কাছে প্রার্থনার মতো এবং তাঁর ব্যক্তিগত জীবনে অনেক ভুল ত্রূটি থাকলেও কাজের ক্ষেত্রে তিনি কখনও ভুল করেননি। তাই নতুন প্রজন্মকে উপদেশ না দিতে চাইলেও নিজেদের কাজের প্রতি মনোযোগী হতে আহ্বান জানিয়েছেন তিনি।

বর্তমান সময়ের শিল্পীদেরকে মূল্যায়নের প্রসঙ্গে তিনি জানান এখন আর তেমন একটা বাংলা নাটক দেখেন না, তাই নতুন শিল্পীদেরকেও তেমন চিনেন না তিনি। তবে কেউ কোনও নাটক দেখার কথা বললে সেসব তিনি দেখেন। তিনি বিশেষভাবে কয়েকজনের নাম বলেন যাদের অভিনয় তার কাছে ভালো লাগে। তারা হলেন অপূর্ব, মোশারফ করিম, তিশা, চঞ্চল চৌধুরী, বাবু, সিয়াম, মেহজাবিন, কল্যান, শ্যামল প্রমুখ।

অভিনয় ক্যারিয়ারে তমালিকা কর্মকার মঞ্চ নাটকের সাথে বেশি সম্পৃক্ত থাকলেও বেশ কয়েকটি জনপ্রিয় সিনেমাতেও অভিনয় করেছেন তিনি। যেমন – এই ঘর এই সংসার, কিত্তনখোলা, ঘেটুপুত্র কমলা। নাট্যকার গোলাম মোস্তফার হাত ধরে অভিনয় জীবনের সূচনা হয় এবং এরপরে হুমায়ুন আহমেদের কোথাও কেউ নেই নাটকের মধ্য দিয়ে তিনি আলোচিত হোন। আর চলচ্চিত্রে অভিনয়ের যাত্রা শুরু করেন ‘অন্যজীবন’ এর মধ্য দিয়ে।

অনবদ্য অভিনয় জীবনে বহু পুরস্কার ও সম্মাননা অর্জন করেছেন তমালিকা কর্মকার। তিনি কীত্তনখোলা ছবির জন্য শ্রেষ্ঠ পার্শ্বচরিত্র অভিনেত্রী ক্যাটাগরিতে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরষ্কার লাভ করেন। ২০১৪ সালের ২১ জুন যুক্তরাষ্ট্রের কালচারাল সোসাইটি অফ নর্থ আমেরিকা সম্মাননা, ২০১৬ সালে তিনি মেগা সার্ট ম্যাগাজিন থেকে ‘মেগা স্টার্ট মিউজিক এন্ড এন্টারটেনমেন্ট এওয়ার্ড, ২০০৮ সালে কেরালা থিয়েটার ফেস্টিভাল স্মারক, ১৯৮২ সালে তিনি বাংলাদেশ টেলিভিশনের নতুন কুঁড়িতে গল্প বলা ক্যাটাগরিতে সেরা শিশু শিল্পী পুরস্কারসহ অসংখ্য পুরস্কার ও সম্মাননা অর্জন করেছেন। দর্শকনন্দিত ও জনপ্রিয় এই রুচিশীল অভিনেত্রী তাঁর পুরো ক্যারিয়ারজুড়ে অভিনয়কে প্রার্থনার মত পবিত্র অনুষঙ্গ হিসেবে লালন করে গিয়েছেন। বর্তমানে দেশের বাইরে থাকা এই গুনী শিল্পী সবসময়ই প্রত্যাশা করেন দেশের চলচ্চিত্র ও নাটক আরও সমৃদ্ধ হবে এবং দর্শকের হৃদয় জয় করে যাবে।

একজন সত্যান্বেষী: খালেদ মহিউদ্দীন

একজন সত্যান্বেষী: খালেদ মহিউদ্দীন

সত্যের সন্ধান তো অনেকেই করতে চায়. কিন্তু প্রকৃত সত্যান্বেষী সবাই হয়ে উঠতে পারে না। এর জন্য অনেক ত্যাগ ও সাধনার প্রয়োজন হয়। তবে যারা পারে তারাই হয় স্মরণীয় ও বরণীয়। অনেকেই এই সত্য সন্ধানকে পেশা ও নেশা উভয়ভাবেই গ্রহণ করে মানুষের মন জয় করে নিয়েছেন। আজকে এমন একজন মানুষকে উপস্থাপণ করবো যিনি এই সত্যের সন্ধানকে শুধু পেশা হিসেবে নয়, রীতিমতো নেশা হিসেবে নিয়ে আপন গতিতে এগিয়ে যাচ্ছেন। তিনি হলেন স্বনামধন্য ও জনপ্রিয় সাংবাদিক খালেদ মুহিউদ্দীন। খালেদ মুহিউদ্দীন একজন বাংলাদেশী সাংবাদিক ও লেখক যিনি বর্তমানে জার্মানভিত্তিক আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম ডয়েচে ভেলে বাংলা বিভাগের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। তিনি বাংলাদেশ সরকারি কর্ম কমিশনের বিসিএস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন এবং বিশ্ব ব্যাংকের পরামর্শক ছিলেন।

দর্শকপ্রিয় টকশো উপস্থাপক সাংবাদিক খালেদ মুহিউদ্দীন ১৯৭৪ সালের ১৬ই সেপ্টেম্বর ঢাকায় জন্মগ্রহণ করেন। তার পৈতৃক নিবাস কুমিল্লায়। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ থেকে স্নাতক সম্পন্ন করেছেন এবং যুক্তরাজ্যের ওয়েস্ট মিনিস্টার বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এম.এ ডিগ্রী লাভ করেছেন।
সাংবাদিকতা দিয়েই খালেদ মুহিউদ্দীনের পেশা জীবন শুরু হলেও তিনি বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিসে কিছুদিন দায়িত্ব পালন করেন। কিন্তু তার সাংবাদিকতার নেশা তাকে সেখানে বেশিদিন টিকতে দেয়নি। তাই লোভনীয় এই চাকরি ছেড়ে দিয়ে তিনি আবার যোগ দেন সাংবাদিকতায়। এছাড়াও তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের খন্ডকালীন শিক্ষক হিসেবে কিছুদিন শিক্ষকতা করেছেন।

জনপ্রিয় এই সাংবাদিক বিভিন্ন প্রিন্ট মিডিয়া ও ইলেক্ট্রনিক মিডিয়াতে সাংবাদিক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। তিনি দৈনিক প্রথম আলোর নগর পাতা সম্পাদক ও পত্রিকাটির সিনিয়র রিপোর্টার হিসেবে আইন, আদালত ও খনিজ সম্পদ বিষয়ে প্রতিবেদন লিখতেন। কিছুকাল তিনি অনলাইন সংবাদপত্র ও বেসরকারি সংবাদ সংস্থা বিডিনিউজ ২৪.কম এ বার্তা সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেছেন। সাপ্তাহিক কাগজ ও মিডিয়া ওয়াচের সম্পাদকের দায়িত্বও পালন করেছেন তিনি। বেশকিছু দিন তিনি ‘দৈনিক আমাদের অর্থনীতি’র সম্পাদক ও ইন্ডিপেনডেন্ট টিভিতে নির্বাহী সম্পাদকের দায়িত্বও পালন করেছেন। ইন্ডিপেন্ডেন্ট চ্যানেলের সবচেয়ে জনপ্রিয় টকশো ‘আজকের বাংলাদেশ’ এর উপস্থাপক হিসেবে তিনি জনগণের প্রশংসা কুড়িয়েছেন। দীর্ঘ ২০ বছরেরও বেশি সময় ধরে সাংবাদিকতা পেশার সাথে যুক্ত আছেন তিনি।

সাংবাদিকিতার অভিজ্ঞতা কেমন এই প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে তিনি বলেন, বাংলাদেশে সাংবাদিকতার পথ কখনোই মসৃণ নয় এবং এখানে আপনাকে অনেক উত্থান পতনের মধ্য দিয়ে যেতে হবে। তত্ত্বাবোধায়ক সরকারের আমলে একবার তিনি সাংবাদিকতা থেকেও অবসর নিয়েছিলেন। একটি বিশেষ সংবাদ মুছে ফেলার জন্য তাকে উপর মহল থেকে অনেক চাপ প্রয়োগ করা হয়েছিলো কিন্তু তিনি সেই সংবাদ রেখে দিয়েছিলেন। তার মনে হয়েছিলো সাংবাদিকতার সাথে থাকতে গেলে তাকেও ওদের সাথে তাল মিলিয়ে চলতে হবে এবং সেজন্যই তিনি স্বেচ্ছায় অবসরে গিয়েছিলেন। পরে অবশ্য ২০০৮ সালে নির্বাচন হবার পর আবার তিনি সাংবাদিকতা পেশায় ফিরে আসেন।

মুহিউদ্দীনকে প্রশ্ন করেছিলাম, দেশ ছেড়ে থাকতে খারাপ লাগা কাজ করে কি না? জবাবে তিনি বলেছেন, যতই দেশের বাইরে থাকুক না কেন, দেশ দেশই। দেশের জন্য অবশ্যই খারাপ লাগা কাজ করে। তবে তিনি এটিও জানান যে দেশে থেকে থেকে তিনি ক্লান্ত হয়ে যাচ্ছিলেন। এই ক্লান্তি যাতে আর না বাড়ে সেইজন্যই তাঁর দেশ ছেড়ে চলে আসা। তবে তিনি এটাও বলেছিলেন, বাক স্বাধীনতার ক্ষেত্রে তার উপর কখনও কেউ হস্তক্ষেপ করতে পারেনি বা করেনি। যেকোনও টকশোতে তিনি নিজের মতো করে প্রশ্ন করেছেন।

গণতান্ত্রিক দেশ হিসেবে বাংলাদেশকে মূল্যায়ন করতে বলা হলে তিনি বলেন, “গনতন্ত্রের উপযুক্ত সংজ্ঞায়ন করার উপায় হলো সেই দেশের নির্বাচন। নির্বাচনের হিসেব ধরলে বাংলাদেশ গণতন্ত্রের পরীক্ষায় পাশ করে না”। এইযে আমরা এতো উন্নয়নের কথা শুনি, দেশে আসলেই উন্নয়ন হচ্ছে কি না এই বিষয়ে তিনি বলেন, বাংলাদেশের উন্নয়ন হয়েছে এতে কোন সন্দেহ নেই। বিগত বছরগুলোর সাথে তুলনা করলেই বুঝা যায় বাংলাদেশ বর্তমানে কতোটা এগিয়ে আছে। দেশের পোষাক শিল্প, টেলিফোন, বাজার ব্যাবস্থা সবকিছুর দিকে দৃষ্টিপাত করলে দেখা যায় বাংলাদেশের আসলেই অনেক উন্নতি হয়েছে। তবে এই কৃতিত্ব কার এই বিষয়ে তিনি কোন মন্তব্য করেননি। তবে তাঁর আক্ষেপের জায়গাও আছে বলে জানান তিনি। তাঁর আক্ষেপের জায়গাগুলো হলো, অর্থ লোভীদের অর্থ পাচার করা। দেশের টাকা চুরি করে নিজেদের স্বার্থ উদ্ধার করাটা অনেক বড় অন্যায়ের জায়গা বলে মনে করেন তিনি। তাছাড়া শ্রম শোষণ সমাজে অনেক বৈষম্য সৃষ্টি করছে বলে জানান তিনি এবং লুটপাটের জন্য তাদের বিচার হওয়া উচিত বলে মনে করেন তিনি। তবে তিনি এটিও মনে করেন, যেহেতু আমাদের দেশের সবচেয়ে বড় আয়ের উৎস হলো রেমিট্যান্স আর বাইরের দেশেও শ্রমিকের অনেক চাহিদা, সেক্ষেত্রে আমাদের সরকারের উচিত উপযুক্ত প্রশিক্ষণের মাধ্যমে বাংলাদেশের নাগরিকদের বিদেশের শ্রমবাজারে প্রবেশ করানো।
খালেদ মুহিউদ্দীন পেশায় কেবল সাংবাদিক নন তিনি একজন লেখকও বটে। এ পর্যন্ত তাঁর ৯ টি লেখা প্রকাশিত হয়েছে। তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো, কন্ট্রোল সি কন্ট্রোল ভি, এক মিলেনিয়াম আগের গল্প, কয়েকজন আমি, আমিনুল্লাহর একদিন। তাছাড়া অধ্যাপক আসাদুজ্জামানের সাথে যৌথভাবে ‘যোগাযোগের ধারণা’ ও ‘যোগাযোগের তত্ত্ব’ শিরোনামে দুটি বই রয়েছে তার, যা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠ্য বই হিসেবে পড়ানো হয়।

তার চোখে বর্তমানে সেরা সাংবাদিক কে এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি জানান “তথ্য প্রযুক্তির ফলে সাংবাদিকতার গুণগত, মাণগত ও অবস্থানগত পরিবর্তন হয়েছে। তবে নিজের দেশে ওইরকম ভালোলাগার মতো কাউকে এখনো পর্যন্ত চোখে পড়েনি তার। তবে তিনি ইংরেজি পত্রিকার কয়েকজন সাংবাদিকের নাম বলেন। বিশেষ করে স্টিভ সেভার্ড, জেরেমি প্যাক্সম্যান, এন্ডারসন কুপার, স্টিভেন কলভিয়ার এবং টিভি হোস্ট এলেন ডিজেনারাসের নাম বলেন।

দেশের গন্ডি পেরিয়ে বিদেশের মাটিতে প্রশংসা কুড়ানো এই সাংবাদিক মন খারাপের সময় বহুমূখী কাজ করতে ভালোবাসেন। একইসাথে একাধিক কাজে তার মন ভালো হয় বলে জানিয়েছেন তিনি। তবে তিনি স্বপ্ন নিয়ে কখনও খুব বেশি ভাবেননি বরং নিজেকে স্রোতে ভাসিয়ে দিয়েছেন। গতানুগতিক জীবনযাপনেই অভ্যস্ত তিনি। মৃত্যুর পরেও তিনি বিশেষ কিছু চান না বলে জানিয়েছেন এবং তিনি মনে করেন মানুষ তাঁর কথা মনে রাখার মত তেমন কিছুই তিনি করেন নি। তিনি মনে করেন মৃত্যুর পর স্মরণীয় হবার কোন সুযোগই তাঁর নেই। বিনয়ী ও চমৎকার উপস্থাপনার এ মানুষটি মৃত্যুর পর কী হবে তা নিয়ে না ভেবে বরং বর্তমানেই সজহভাবেই বেঁচে থাকতে চান বলে জানিয়েছেন।

রাগে – অনুরাগে: পন্ডিত গীতেশ মিশরা

রাগে – অনুরাগে: পন্ডিত গীতেশ মিশরা

সুর হলো এমন এক জাদু, যে জাদু সকল শ্রেণী পেশার মানুষকে বস করে ফেলতে পারে। সুরের মাধ্যমে মানুষ নিজেকে অন্য এক জগতে আবিষ্কার করতে পারে। আর যারা এই সুরের সাধনা করেণ তাঁরা একেকজন জাদুকর। আজ এমনই এক জাদুকরের কথা বলবো যার জাদুর ছোঁয়ায় ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের জগতে যোগ হয়েছে এক অনন্য মাত্রা। তিনি বিশ্বরেকর্ড অর্জনকারী এবং স্বনামধন্য ও জনপ্রিয় শাস্ত্রীয় সংগীত সাধনাকারী উস্তাদ ও পন্ডিত গীতেশ মিশরা। প্রয়াত পন্ডিত মহেশ মিশরার যোগ্য উত্তরসূরি পন্ডিত গীতেশ মিশরা ছোটবেলা থেকেই বেড়ে উঠেছেন বাদ্যযন্ত্রের সাথে। তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বি.কম ও এম.কম পাশ করেন। এছাড়াও, তিনি অল ইন্ডিয়া রেডিও ও দূরদর্শনের নিয়মিত সংগীত শিল্পি ছিলেন। ফোর্ট ফাউন্ডেশন এ আইটিসির গবেষক ছিলেন তিনি। পন্ডিত কুমার প্রসাদের তত্ত্বাবধানে তিনি আইটিসিতে কাজ করতেন। এছাড়াও পন্ডিত গীতেশ মিশরা বিভিন্ন স্কুল কলেজেও শিক্ষকতা করেছেন। বর্তমানে ‘The ARDEE School, Gurgaon এ কর্মরত আছেন এবং তাঁর নিজস্ব মিউজিক্যাল একাডেমি রয়েছে।

গুণী এই সংগীত বিশেষজ্ঞের হাতেখড়ি ঠিক কখন হয়েছে তিনি নিজেও বলতে পারেন না। জন্মের পর থেকেই গান বাজনার সাথে বড় হয়েছেন তিনি। গান-বাজনা তার পারিবারিক সূত্রে পাওয়া। তবে যদি নিতান্তই প্রাতিষ্ঠানিক হাতেখড়ির হিসেব বলতে হয় তবে ৬ বছর বয়সে তাঁর আনুষ্ঠানিক গান চর্চা শুরু হয়েছে বলা যেতে পারে। ৬ বছর বয়সে তিনি তাঁর বাবার সাথে শ্রীমতী গীর্জা দেবীর জন্মদিনের অনুষ্ঠানে যান এবং সেখানে গান গেয়ে সকলের মন জয় করে নেন। এরপর থেকেই তাঁর বাবা ভাবলেন ছেলেকে হয়তো গান শেখানো যায় আর সেখান থেকেই মূলত আনুষ্ঠানিক ভাবে গানের জগতে প্রবেশ হয় উস্তাদ গীতেশ মিশরার।

পন্ডিত গীতেশ মিশরার অনুপ্রেরণা কারা এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি জানান তাঁর মা-বাবা’ই তার সংগীত জীবনের প্রথম গুরু ও অনুপ্রেরণা। তবে বাবা পন্ডিত হবার সুবাধে অনেক গুণী সংগীতজ্ঞের সান্নিধ্য লাভ করেছিলেন পন্ডিত গীতেশ মিশরা। তাঁর শৈশব ও কৈশোর কাটে নামীদামী সংগীতজ্ঞদের সাথে। তাঁরাও পন্ডিত গীতেশ মিশরার অনুপ্রেরণার আরেকটি জায়গা। তাঁর প্রধাণ গুরু তাঁর বাবা হলেও তাঁর জীবনে পন্ডিত কুমার প্রসাদ, পন্ডিত রামাশাস্ত্র, পন্ডিত জাগদীশ, পন্ডিত গৌতম, ওস্তাদ শাফী আহমেদের অবদান অনস্বীকার্য বলে মনে করেন তিনি।

পন্ডিত গীতেশ মিশরা বেনারাস ঘারানায় একজন শাস্ত্রীয় সংগীত বিশেষজ্ঞ। তবে তিনি একাধারে খেয়াল, তারানা, ঠুমরি, টপ্পা, দাদরা এবং ভজন ঘারানায় বিশেষজ্ঞ। তিনি গানের জগতে এক আমূল পরিবর্তন এনেছেন। তিনি বিশ্বাস করেন প্রতিটা মানুষের গান শোনা ও সেই গান বোঝার অধিকার রয়েছে। তাই তিনি প্রতিটা ঘারানাকে সম্মান করেন এবং সকল অলংকার নিয়ে বিশ্লেষণ করেন। আধুনিক বাদ্যযন্ত্র নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে গিয়ে তিনি তৈরি করেছেন নিজস্ব পরিচয়। তিনি বলেন আগে শ্রোতাদের পরিমাণ ছিল সীমিত, এখন জনসংখ্যা, সংস্কৃতি ও সভ্যতার বিকাশের সাথে সাথে শ্রোতার সংখ্যাও বৃদ্ধি পেয়েছে। তবে, সব শ্রোতার গানের পছন্দ এক নয়। স্থান, কাল, পাত্র ভেদে গানের পছন্দেরও পরিবর্তন হয়। যেমন ক্লাসিক্যাল সবাই বুঝবে না। এজন্য লেভেল অব আন্ডারস্ট্যান্ডিং প্রয়োজন। কিন্তু তাই বলে যারা বুঝবে না তাদের বঞ্চিত করার অধিকার আমাদের নেই। এই দৃষ্টিকোন থেকে তিনি সকল প্রকার ঘারানা, অলংকার ও সুরকে ভালোবাসেন। তিনি আরও বলেন সুরই সব এবং সুরই স্থায়ী; কেবল ধরণে তার পরিবর্তন হয়। যেমন ঠাকুরেরই বান্দেশ এক ধরণে গাইলে হয় ধ্রুপদ, অন্য ধরণে গাইলে খেয়াল, একটু পরিবর্তন করলে ধুনরী, গজল, সুফী, কাওয়ালী। কোনটাকেই আমরা বাদ দিতে পারি না। গান একটা ভাষা, এই ভাষাকে যদি আমরা শ্রোতাদের মাঝে পৌঁছে দিতে পারি তবে সেটিই আমাদের সার্থকতা বলে মনে করেন তিনি।

পন্ডিত গীতেশ মিশরার মিউজিক্যাল একাডেমী ‘গুরুদাহো ডেইলি এনসিআর’। সেখানে তিনি ছাত্রদের সংগীতের শিক্ষা দেন। তিনি ছাত্রদের সুবিধার্থে সংগীতের অ-আ-ক-খ নিয়ে “গানের ধারাপাত” নামে একটি বই লিখেছেন। সেখানে ২০০ টিরও বেশি অলংকার রয়েছে বলে নিশ্চিতে করেছেন তিনি।

পন্ডিত গীতেশ মিশরা খুব চমৎকারভাবে আমাদের ভারতীয় শাস্ত্রীয় সংগীতের ইতিহাস তুলে ধরেন। শাস্ত্রীয় সংগীত সুবিশাল এক গানের জগৎ। এই সংগীতের ঐতিহ্য প্রায় ৫ হাজার বছরের; সেই ইরান ও মুঘোল শাসন আমল থেকে শুরু। ভারতীয় শাস্ত্রীয় সংগীতে তানসেনের অবদান স্বীকার করেন তিনি। সেই সাথে তানসেনের গুরু স্বামী হরিদাশ জ্বী এবং তাঁরও গুরুদের অবদানের কথা স্মরণ করেন। তখনকার সংগীত মূলত ঠাকুকের সাথে মিশে যাওয়ার সংগীত। তানসেন গান গাইলে নাকি আগুন জ্বলে উঠতো, বৃষ্টি হয়ে যেতো এতোটা ভক্তি নিয়ে গাইতেন তিনি। ভারতমুনীও খ্রীষ্টপূর্ব ৪০০ অব্দে ভারতনাট্যতে লিখে গিয়েছিলেন এই গল্প। গানের আদ্যোপান্ত বর্ননা করতে গিয়ে উস্তাদ গীতেশ মিশরা মনে করিয়ে দেন যে, গানের ইতিহাস অনেক লম্বা। শুরুর দিকে বেদের মন্ত্রের উচ্চারণ হতো, সামবেদ পুরোটাই গান ছিলো। তখন সবাই গেয়ে গেয়ে পড়তো। মুনী, ঋষিরা এসব বেদ গাইতেন আর সাধারণ মানু্ষ গাইতো ফোক গান। সেই সময়ে বীণা আর বাঁশি ছিলো উল্লেখযোগ্য বাদ্যযন্ত্র। শিবকেও গানের স্রষ্টা বলা হতো তার হাতের ডাম্বুর জন্য। তারপর ধ্রুপদ গান শুরু করলেন তানসেন। ধ্রুপদ এমন এক ধরণের গাইকী যার বিশেষত্ব হলো বিভিন্ন তালের মাধ্যমে গাওয়া হতো। ধ্রুপদের মাঝে অনেকক্ষণ আলাপ হতো। কোন ধরণের বাদ্যযন্ত্র বাজবে না, শুধু আলাপ হবে। ধ্রুপদে ফাঁখাওয়াজ নামে একটি বাধ্যযন্ত বাজতো। কিন্তু ধ্রুপদ অনেক কঠিন একটি সাধনা বলে জানিয়েছেন তিনি। সবাই বুঝতো না এই গায়কী। তখনকার রাজদরবারে চলতো এই গায়কী। তাই পরবর্তীতে ধ্রুপদের একটি হালকা সংস্করণ হিসেবে আসলো খেয়াল। খেয়ালের মাঝে অনেক রূপ রয়েছে। মুসলিমরা এটাকে কাওয়ালীতে রুপদান করেছিলেন তখন। তবে খেয়াল গায়কীর সময় অনেক গায়ক থাকতো এবং তাদের মাঝে প্রতিযোগীতা হতো যেখানে একজন আরেকজনকে হারানোর জন্য অংশগ্রহণ করতো। ফলে গানের যথার্থতা আর থাকতো না, অনেক শব্দ হতো সেখানে যার ফলে গানটা আর উপভোগ করা যেতো না। তখন ধীরে ধীরে খেয়াল গায়কীর পরিবর্তে একটু সাধারণ হিসেবে আসলো ঢুনরী গাইকী। তারপর ঢুনরী থেকে টপ্পা ও আরও নানা ধরণের গাইকী আসলো। তিনি বলেন বর্তমানে শিওলিয়ান নামে একটা গাইকীর প্রচলন রয়েছে। সময়ের সাথে সাথে মানুষের রুচির পরিবর্তন হয়, সেই সাথে পরিবর্তন ঘটে সংস্কৃতির। যেহেতু গান সংস্কৃতিরই একটি অংশ তাই গানেরও ধরণের পরিবর্তন হয়। এই পরিবর্তনকে তিনি খুব স্বাভাবিক ভাবেই দেখছেন।

এইযে এতক্ষণ আমরা বিভিন্ন ঘারানার নাম শুনলাম এখন অনেকেই ভাবতে পারে ঘারানাটা আসলে কী? ঘারানার উদ্ভব কোথা থেকে এই প্রশ্নটিরও সহজ সুন্দর ও সাবলীল ভাষায় তিনি বলেন “ ঘারানার বিষয়টি মূলত স্থানিক। বর্তমানে আমরা চাইলে যেকোন দেশের, যেকোন ভাষার গান শুনতে পারি। কিন্তু আগে এমন ছিলো না। এখন ভিডিও ও অডিও রেকর্ড আছে আমরা কিছু শিখতে চাইলেই পারি। নিয়মিত চর্চা করতে পারি দেখে দেখে কিন্তু আগে এমন কোন সুবিধা না থাকায় মানুষ সবসময় উস্তাদদের কাছে যেতে পারতো না। যেমন ধরা যাক, কেউ যদি দূর দেশ থেকে এক প্রকার গান শিখে আসে পরবর্তীতে সে যখন চর্চা করতে চায় তখন তার স্মৃতি থেকে করতে হয়। কেননা সে চাইলেও আর যেতে পারে না। তখন স্মৃতিতে যা থাকে তাই সে ডেলিভারি করে। এজন্য গানের ডেলিভারির ধরণ পাল্টে যায়। তৃতীয় কোন ব্যক্তি যদি এই গান শুনে তাহলে দুজনের গান তার কাছে দুইরকম লাগবে। তবে কেউ কিন্তু ভুল করছেন না, কেননা এখানে ব্যকরনগত কোনো ভুল নেই। এইযে এখানে একই গানের ডেলিভারির ধরণ আলাদা এটাই হলো ঘারানা”।

পন্ডিত গীতেশ মিশরা নিজে বেনারাস ঘারানার হলেও তিনি সকল ঘারানা আয়ত্ব করার চেষ্টা করেন এবং সংগীতে নতুন এক ধারার সৃষ্টি করেন। তাঁর কাছে গানের দর্শন হলো ক্রিয়েটিভ এক্সপ্রেশন। বিশেষজ্ঞরাই গবেষণা করে এসব নতুন নতুন সুর সৃষ্টি করবে। পন্ডিত গীতেশ মিশরা গানের জগতে এই অবদানের জন্য সুর সিংগার সামসেদ অর্গানাইজেশন থেকে ‘সুরমনি’ উপাধি লাভ করেছেন। তাছাড়া গানের প্রতি তার প্রজ্ঞার জন্য মানুষ তাকে ‘পন্ডিত’ আখ্যা দেন। তিনি চান তাঁর মৃত্যুর পর মানু্ষ তাকে সাধক হিসেবে মনে রাখুক। গানের প্রতি তার যে প্রজ্ঞা মানুষ তাকে গায়ক বা সংগীত বিশেষজ্ঞ হিসেবে মনে না রাখলেও মানুষ তাঁর সাধনার স্বীকৃতি দিক। তিনি এমন একজন বিয়নী মানুষ যিনি খ্যাতির পেছনে ছুটেন না। তিনি সাধক হয়েই মানুষের মাঝে বেঁচে থাকতে চান।