কবি ও কবিতারা: শামীম আজাদ

কবি ও কবিতারা: শামীম আজাদ

আজকে এমন একজন মানুষের সম্পর্কে জানাবো যিনি দীর্ঘদিন বিদেশে অবস্থান করেও মন থেকে প্রবাসী হতে পারেননি। তিনি এমন একজন মানুষ যাকে দেখলে এবং কাছে থেকে জানলে মনে হবে ঠিক যেনো দশভূজা। নিজের সংসার ও ক্যারিয়ার সবকিছু আগলে রেখে দেশ ও দশের জন্য যিনি নিবেদিত প্রাণ। তিনি একাধারে কবি, দ্বিভাষিক, লেখক, সংগঠক, গল্পকথক ও যুক্তরাজ্যের অন্যতম বিখ্যাত বাঙ্গালি কবি। তিনি আর কেউ নন, আমাদের সবার প্রিয় শামীম আজাদ।
ব্রিটিশ বাংলাদেশী এই সাহিত্যিক ১৯৫২ সালে ১১ নভেম্বর তাঁর বাবার কর্মস্থল ময়মনসিংহে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পৈত্রিক নিবাস সিলেটে। তিনি জামালপুর স্কুল থেকে মাধ্যমিক শেষ করেন। ১৯৭৯ সালে কুমুদিনি সরকারি কলেজ থেকে উচ্চমাধ্যমিক পাশ করেন এবং ১৯৭২ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক ও ১৯৭৩ সালে স্নাতকোত্তর শেষ করেন। শিক্ষাজীবন থেকেই তিনি কবিতা ও শিল্প-সাহিত্যের নানা অঙ্গনে কাজ করেছেন।

শামীম আজাদের সান্নিধ্যে গেলে বুঝা যায় তিনি কতটা অমায়িক একজন মানুষ। বিচিত্রায় কাজ করার সুবাধে শামীম আপার কাছাকাছি যাওয়ার সুযোগ হয়েছিলো আমার। শামীম আপা এমন একজন মানুষ যিনি নিজের ভেতরের নারী সত্তাকে খুব স্পষ্টভাবে প্রকাশ করেন। একজন নারী হিসেবে অনেকেই নিজের কথা, নিজের অনুভূতির কথা বর্ণনা করতে সংকোচ বোধ করেন; কিন্তু এক্ষেত্রে শামীম আজাদের বর্ণনা খুবই সহজাত এবং সাবলীল।

শামীম আজাদ ঢাকা কলেজের শিক্ষক হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেছিলেন। তারপর জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন সাংবাদিক ও উপস্থাপক হিসেবে। উপস্থাপনার গুণটি তিনি তাঁর বাবার কাছ থেকে লাভ করেছেন। সর্বোপরি, বাংলাদেশের সংস্কৃতি ও ফ্যাশন শিল্পে তাঁর অনন্য অবদান রয়েছে। প্রিন্ট মিডিয়া ছাড়াও রেডিও ও টেলিভিশনেও কাজ করেছেন। তিনি একজন সমাজসেবী ও আমাদের নারী সমাজের জন্য এক বলিষ্ঠ কন্ঠস্বর। আমাদের মুক্তিযুদ্ধেও তাঁর গুরুত্বপূর্ণ অবদান আছে। লেখালেখি ছাড়াও নানা তৎপরতার মাধ্যমে সবার মাঝে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও ইতিহাস তুলে ধরেছেন তিনি। বাংলাদেশের স্বাধীনতার স্মারক বিজয়ফুল কর্মসূচির প্রতিষ্ঠাতা তিনি; যা পুরো বিশ্বে ডিসেম্বরে পালিত হয়। তিনি তার লেখনীতে চিরায়ত বাংলার শ্বাশ্বত রুপ আধুনিক প্রেক্ষাপটে তুলে ধরেন। বাংলাদেশের মতো তিনি তাঁর বহুমূখী কাজের ধারা প্রবাস জীবনেও অব্যাহত রেখেছেন।

প্রবাসে গিয়ে কিভাবে এতোটা সহজে মিশে গিয়েছেন তিনি এমন প্রশ্নের জবাবে বলেন, আমরা এমন এক দেশের মানুষ আমাদের বেশি কিছু নেই, খুব কম নিয়ে আমরা বিদেশে যাই। কিন্তু যতটুকু নিয়ে যাই তা খুব শক্তভাবে হাতের মুঠে আগলে ধরে রাখি। এই করতে করতে সময় চলে যায়। তারপর মুঠো খুলে দেখি যা ছিলো তা অচল হয়ে যায়, তা আর কাউকে দিতে পারিনা। তবে দরিদ্র মানুষের আরও বেশি করে দেওয়ার ক্ষমতা রাখা উচিত তাহলেই সে সবকিছু পাবে। কারন তার এমনিতেও বিশেষ কিছু নেই তাই ব্যবহার দিয়ে, নিষ্ঠা দিয়ে, শ্রম দিয়ে, অধ্যাবসায় দিয়ে সবার সাথে মিশে যেতে হবে। তিনি আরও বলেন, তিনি ইংরেজদের মতো না। আমাদের দেশের কোন কিছুই ইংরেজি ভাষায় নেই। তবে নিজেকে তুলে ধরতে, প্রতিযোগিতামূলক জায়গায় টিকে থাকতে তাঁর গল্পগুলোকে, ৭১ এর গল্পগুলোকে, গৌরবকে ভাষার মাধ্যমে প্রকাশ করতে হবে। তিনি মনে করে বাংলাদেশের প্রচুর বিষয়বস্তু ও কাঁচামালের খনি আছে যা অব্যবহৃত হয়ে আছে; উনি সেগুলোরই সঠিক ব্যাবহার করতে চাচ্ছেন। তিনি নিজেকে খুবই নগণ্য একজন মানুষ হিসেবে ভাবেন। তাঁর জায়গায় সেলিনা হোসেন বা রুবি হলে আরও ওপরে উঠে যেতে পারতো বলে মনে করেন তিনি। তিনি কেবল নিজের প্লেটটা সাজিয়ে মানুষের সামনে তুলে ধরার চেষ্টা করছেন।

স্টোরিটেলিং এর ধারণা কিভাবে মাথায় আসলো তার বর্ণনা দিতে গিয়ে তিনি বলেন, তিনি ইংরেজি, বাংলা, বিজ্ঞান সব পড়ান। তবে তিনি যখন বাংলা গল্প বলতেন তখন বাচ্চাদের মুখভঙ্গি বদলে যেতো। তখন থেকে তিনি অনুভব করলেন তিনি ভালো গল্প বলেন।

কাজের অভিজ্ঞতার কথা বলতে গিয়ে বলেন, বিশ্বজুড়ে মেয়েরা অধিক প্রতিযোগিতা করে। বাইরের দেশের মেয়েরা নিজেদের একটু স্বাধীন মনে করে তাই নিজেদের মতো কাজ করতে পারে। ছেলেরা না বদলালে মেয়েরা কিভাবে পারবে? প্রতিরোধের মুখে নানাভাবে রপ্ত করতে করতে মেয়েরা প্রতিষ্ঠিত হয়। দেখা যায় পুরুষদের মৃত্যুর হার বেশি, বেশি রোগে আক্রান্ত থাকে, প্রেশার, স্ট্রোক এসব ছেলেদের বেশি হয় কারন তারা প্রকাশ করতে পারে না।তা রা একাকী বাঁচতে পারে না কিন্তু নারীরা একাকী বেঁচে থাকতে পারে, সে সংসারে মৃত্যু অবধি একটা ভূমিকা রেখে যায়। এটাকে তিনি বলেন প্রকৃতির শোধ। এতো কষ্ট সহ্য করার পর নারীদের এটা ভ্যাকসিনের মতো কাজ করে। কান্না করে মেয়েরা হালকা হয়ে আবার কাজে নেমে পড়ে। কিন্তু পুরুষরা প্রকাশ করে না, ফলে এগুলো তাদের অসুখ হয়ে যায়, বুকের মাঝে চাপা পড়ে থাকে। মেয়েরা টিকে থাকে বেশি, আনন্দ ভাগ করে বেশি, দুঃখ ভাগ করে বেশি; মেয়েরা জীবনকে উপভোগ করতে পারে বেশি। জীবনের বর্নাঢ্য জিনিসগুলো মেয়েরাই উপভোগ করতে পারে।

সাংস্কৃতিক পরিবর্তনকে তিনি একটু অন্যভাবে দেখেন। তিনি বলেন, শুধু স্থানীয় নয়, পুরো দেশময়, বিশ্বময় রাজনীতির অংশ আমরা। এতগুলো মুসলিম দেশ, অমুসলিম দেশ সবাই নিজের নিয়মে চলে। আমরা শুধুমাত্র অন্য দেশের মতো হতে চাই, অন্যকে অনুকরণ করতে চাই, অন্যদের মতো হতে চাই। এভাবে নিজের নিজস্বতা হারিয়ে ফেলি আমরা। আর এই বিষয়টি স্থানিক নয় বিষয়টি পুরোপুরি কালিক। কালের কারনে আমরা এই জায়গায় এসে পৌঁছেছি বলে মনে করেন তিনি। তিনি মনে করেন পুরোপুরি বৈশ্বিক রাজনীতির কারনে আমাদের দেশের মূল যে জায়গা ছিলো সেখান থেকে আমরা আজ বিচ্যুত হয়ে গিয়েছি। এর কারণ হিসেবে এককভাবে কাউকে দোষারোপ করা যায় না বলে জানান তিনি। এজন্য প্রথমত তিনি নিজের প্রজন্মকে দায়ী করেন। মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবোধ, মূল্যবোধ এগুলো কখনো কথা বা বক্তৃতার মাধ্যমে শেখানো যায় না বলে বিশ্বাস করেন তিনি। তাঁর মতে কালের বিবর্তনে ১৯৭৫ সালের পর হাওয়া উল্টোদিকে বইছে। তাই বর্তমানে একটা আহাজারি দেখতে পাওয়া যায় বাংলাদেশে। পত্রিকা থেকে শুরু করে সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম সব জায়গায় আমরা আমাদের ঐতিহ্যকে হারিয়ে ফেলেছি। তিনি আফসুস করে বলেন, বর্তমানে আমরা এমন একটি সংস্কৃতি ও সভ্যতাকে ধারণ করছি যা আমাদের বাঙ্গালি সংস্কৃতি ও ধর্মকে একটা বিরোধের জায়গায় এনে দাঁড় করিয়েছে, কিন্তু দুটোর মধ্যে তো প্রকৃতপক্ষে কোন ধরণের বিরোধ নেই। এর কারণ হিসেবে তিনি নিজের অভিজ্ঞতা থেকে বলেন, একটা পরিবারে যখন ভাষা শিক্ষা দেওয়া হয় তখন দুটো ভাষাকে খুব গুরুত্ব দেওয়া হয়। একটা ইংরেজি যার মাধ্যমে উপার্জন করতে পারবে আর একটা আরবি যার মাধ্যমে পরকালের জান্নাত পাবার লোভ রয়েছে। কিন্তু যে ভাষা জন্মের পর অনায়াসেই বলতে পারা যায় সে ভাষার মর্যাদা আমরা দেই না। অথচ সেই ভাষার মাধ্যমেই বিশ্বের নানান বিষয় বোঝার ব্যবস্থা ছিলো। এই ভাষার সাথেই রয়েছে আমাদের সংস্কৃতি। আমরা আমাদের নিজের ভাষাকে রেখে অন্য ভাষার প্রতি যেই প্রীতি প্রকাশ করছি তার ফলে তো আমাদের স্বকীয়তা হারাবেই। অন্য ভাষাকে কেন্দ্র করে আমাদের যেই লোভ সেই লোভ তো নিজের ভাষাকে কেন্দ্র করে দেখানো হচ্ছে না। আমরা নিজেদের অবহেলা করে বড় হতে শিখছি এবং সেজন্যই আজকের এই অবস্থা।

ধর্মের মতো করে আমাদের দেশপ্রেমের শিক্ষাও দেওয়া উচিত বলে মনে করেন তিনি এবং এর জন্য আমাদের ঘর ও বিদ্যালয়কে সবচেয়ে উপযুক্ত জায়গা হিসেবে বিবেচনা করেন তিনি। তাঁর মতে এই দুটি জায়গা আমাদের সামাজিকীকরণের সূত্রপাত। খাবার টেবিলে পিতামাতা যদি কেবল দেশ নিয়ে হতাশার গল্প না করে দেশের ভালোভাবে তুলে ধরতে পারেন, দেশ প্রেমের গল্প করেন, তাহলে এমন অসুস্থ সংস্কৃতি থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব। তিনি বাংলা ভাষার বিশেষজ্ঞ হিসেবে নানা জায়গায় কাজ করেছেন। এক্ষেত্রে তিনি নিজ অঞ্চল সিলেটের উদাহরণ দেন। তিনি বলেন ভাষার ক্ষেত্রে সিলেটের মানুষ অনেক সংঘবদ্ধ। তারা নিজের ভাষাকে খুব সুন্দরভাবে উপস্থাপন করেন একে অপরের সাথে। আমরা যা করি তাই আমাদের কর্মফল। আমরা তেমনই পাবো ঠিক যেমনটা করবো। তাই সংস্কৃতির এমন পরিবর্তন না চাইলে নিজের দেশকে, দেশের ভাষাকে, নিজের সংস্কৃতিকে ভালোবাসতে জানতে হবে এবং উপলব্ধি করতে হবে হবে অভিমত প্রকাশ করেছেন তিনি।

শামীম আজাদের পরবর্তী পরিকল্পনা কী এমন প্রশ্ন করলে তিনি বলেন, আপাতত তিনি নিজের আত্মকেন্দ্রিক উপন্যাস শেষ করবেন। ‘আমার কৃষক ও বিশ্ববিদ্যালয়ের স্মৃতি’ নামক দুটি লেখা তিনি প্রথমে শেষ করতে চান। এছাড়াও তাঁর ৬ টি অপ্রকাশিত পান্ডুলিপি রয়েছে সেগুলো তিনি শেষ করতে চান। এর পাশাপাশি তিনি দুঃখ প্রকাশ করে জানান, বর্তমান সময়ে প্রকাশকরা খুবই মানহীন বই প্রকাশ করছেন যা তাঁকে ব্যাথিত করে। তিনি কেবল দেশেই নন দেশের গন্ডি পেরিয়ে বিদেশের মাটিতেও সমাদৃত হয়েছেন। অ্যাথেন্সের এগোরা পারটিক রেসিডেন্সি হিসেবে তিনি নিয়োগ লাভ করেন। বিশ্ব সাহিত্য কেন্দ্র লন্ডন ও ব্রিটিশ বাংলাদেশি পয়েট্রি কালেকটিভের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ার তিনি। এছাড়াও, পূর্ব লন্ডনের শিল্পি সংস্কৃতি চর্চার বৃহৎ প্রতিষ্ঠান রিচমিক্সের ট্রাস্ট এবং লন্ডনের এক্সাইল রাইটার্স এর নির্বাহী কমিটির সদস্য তিনি। ২০ শতাব্দীর ব্রিটিশ এশীয় এই লেখক ২০২০ সালে আর্ট ইন দ্যা কমিউনিটি পুরষ্কারে ভুষিত হন।

মৃত্যু পরবর্তী জীবনে কিভাবে স্মরণীয় হতে চান এই প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, কিচ্ছু চাওয়ার নেই। মৃত্যুর পর তিনি থাকবেন না, কি হচ্ছে দেখবেন না। তাই তার এসব নিয়ে কোন ভাবনা নেই। তবে তার জীবদ্দশায় মানুষ তাকে প্রয়োজনীয় ভাবুক এটাই তিনি চান। তিনি বলেন, আমি যতদূরে যাই বাংলাদেশ ততদূরে যায় অর্থাৎ তাঁর যত অর্জন সব বাংলাদেশ নির্ভর। তার সকল কবিতা বাংলাদেশের।

রুপালি পর্দার জাদুকর: অমিতাভ রেজা চৌধুরী

রুপালি পর্দার জাদুকর: অমিতাভ রেজা চৌধুরী

আজকে একজন জাদুকরের সাথে গল্প করেছিলাম। হ্যাঁ, তিনি জাদুকর বটে তবে একটু অন্যরকম জাদুকর। যার জাদুর ছোঁয়ায় বাংলাদেশের চলচ্চিত্র ও বিজ্ঞাপন জগতে যোগ হয়েছে অনন্য মাত্রা। যিনি একধারে একজন বিজ্ঞাপন নির্মাতা, চলচ্চিত্র পরিচালক, টিভি নাটক পরিচালক ও ওয়েব সিরিজ নির্মাতা। বিজ্ঞাপন জগতের নির্মাতাদের নাম নিলে প্রথম সারিতে যিনি অবস্থান করেন তিনি আর কেউ নন, তিনি হলেন স্বনামধন্য চলচ্চিত্র পরিচালক অমিতাভ রেজা চৌধুরী। ১৯৭৬ সালে এই গুণী নির্মাতার জন্ম হয় তাঁর নানা বাড়ি ব্রাহ্মণবাড়িয়াতে। তাঁর পৈতৃক বাড়ি মূলত কিশোরগঞ্জ এবং তিনি বেড়ে উঠেছেন রাজধানী শহরেই। ঢাকার বিএএফ শাহীন স্কুল ও কলেজ থেকে পড়াশোনা শেষ করে উচ্চশিক্ষার উদ্দেশ্যে তিনি পাড়ি জমান ভারতে। সেখানে তিনি ভারতের বিখ্যাত পুনে ইনস্টিটিউটে অর্থনীতি বিভাগে ভর্তি হয়েছিলেন। কিন্তু, চলচিত্রের প্রতি প্রবল আকর্ষণ থাকায় তিনি নিজের ক্লাস ছেড়ে ফিল্মের শিক্ষার্থীদের সাথে আড্ডা দিতেন, তাদের ক্লাসে গিয়ে বসে থাকতেন। অবশেষে পড়াশোনা শেষ না করেই দেশে ফিরে আসেন তিনি। দেশে ফিরে এসে নিজের স্বপ্ন বাস্তবায়নে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। বর্তমানে পর্দায় কাজের পাশাপাশি তিনি ফিল্ম প্রোডাকশন বিষয়ের ওপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে খন্ডকালীন শিক্ষক হিসেবে শিক্ষকতা করছেন।

কিভাবে সিনেমা জগতে প্রবেশ সেই প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে চমৎকার কিছু অজানা তথ্য জানান তিনি। ছোটবেলা থেকেই সাহিত্য ও সিনেমার প্রতি প্রবল জোক ছিলো অমিতাভ রেজার। সত্যজিৎ রায় ছিলেন তাঁর আদর্শ। প্রচুর বই পড়ার কারনে জীবনের একটা পর্যায়ে কার্ল মার্কসের ভক্তই হয়ে যান তিনি। রাজনীতির জোক মাথায় চেপে বসে। সমাজ পরিবর্তনের নেশায় মগ্ন হয়ে যান তিনি। আর এই নেশাকে আরও পরিপক্ব করে তুলেন তার চাচা কমরেড আইযুব রেজা চৌধুরীর সান্নিধ্য। অমিতাভ রেজা চৌধুরীও চেয়েছিলেন রাষ্ট্র ও সমাজের পরিবর্তন। কিন্তু শারীরিকভাবে অসুস্থ্য হওয়ার পর থেকে এই পরিবর্তনের জন্য প্রত্যক্ষভাবে আর লড়াই করতে পারেননি তিনি। পড়াশোনার পর রাজনীতি চর্চাও আর সম্ভব হয়নি তাঁর। তাই তিনি সমাজ পরিবর্তনের হাতিয়ার হিসেবে সিনেমাকেই বেছে নেন। বই, রাজনীতি আর সিনেমাপ্রীতিই তার সিনেমা জগতে আসার মূল কারণ।

নির্মাতা হিসেবে অমিতাভ রেজা চৌধুরী ১৫০০ এরও অধিক টেলিভিশন বিজ্ঞাপন নির্মাণ করেছেন। শুরুর দিকে তিনি চলচ্চিত্র নির্মাণ করেননি। টিভিসি ও নাটকের মধ্য দিয়ে ধীরে ধীরে অভিষেক ঘটে তাঁর। একুশে টেলিভিশন তার এই অভিষেকের সবচেয়ে বড় জায়গা ছিলো। ২০০১ সালে ‘ঘর’ নাটক নির্মানের মধ্য দিয়ে তিনি নাট্য নির্মাণ শুরু করেন। বর্তমানে তাঁর ‘Half Stop Down’ নামক একটি প্রোডাকশন হাউজ রয়েছে। এই প্রোডাকশন হাউজ মূলত টিভিসি নির্মানের জন্য হলেও তার বিখ্যাত ‘আয়নাবাজি’ চলচ্চিত্রটি এই হাউজ থেকেই নির্মিত হয়েছে।

বিজ্ঞাপন নির্মাতা হিসেবে অমিতাভ রেজা চৌধুরী যেমন সফল ব্যক্তিত্ব তেমনি চলচ্চিত্রকার হিসেবেও কুড়িয়েছেন বিশেষ খ্যাতি। আয়নাবাজির মাধ্যমে চলচ্চিত্র জগতে আত্মপ্রকাশ করেন তিনি। ২০১৬ সালে আয়নাবাজিতে করেছেন বাজিমাত। অতীতের সকল রেকর্ড ভেঙ্গে নতুন ইতিহাস গড়েছেন। জনপ্রিয়তার তুঙ্গে উঠে বেশ প্রশংসা কুড়ানোর পরপরই ২০২১ সালে সফলভাবে মুন্সিগিরি এবং ২০২৩ সালে সবচেয়ে বেশি সাড়াজাগানো চলচ্চিত্র ‘রিক্সা গার্ল’ নির্মান করেন। তার এই নবনির্মিত সিনেমাটি শুধু দেশ নয় দেশের গন্ডি পেরিয়ে আমেরিকার ২১ টি রাজ্যেও দর্শকপ্রিয়তা পেয়েছে। অমিতাভ রেজা এই চলচ্চিত্রটি নিয়ে বলেন, সিনেমাটি ইংরেজি ভাষায় নির্মাণ করার প্রধান কারণ হলো আমেরিকানরা সাবটাইটেলে সিনেমা দেখেন না, তাই তাদের কাছে যেন নিজের ভাষার চলচ্চিত্র মনে হয় তাই রিক্সা গার্ল চলচ্চিত্রে তিনি ইংরেজি ভাষা ব্যবহার করেছেন। বর্তমানে দেশীয় ভাষায় রুপান্তরের কাজ চলছে বলেও জানিয়েছেন তিনি।

বর্তমানে বাংলা চলচিত্রের হালচাল জানতে চাইলে শুরুতে তিনি কিছু সীমাবদ্ধতার কথা বললেও পরবর্তীতে বেশ আশার আলো দেখান। অমিতাভ রেজা বলেন, এদেশের শিল্পীরা অনেক মেধাবী, চলচ্চিত্রকাররা অসম্ভব মেধাবী এবং এখানে কাজ করার জন্য অনেক পরিশ্রমী কর্মী আছে। তাঁর মতে কাজের প্রতি নিবেদিত এমন মানুষগুলোর জন্যই এখনও দেশের চলচ্চিত্র শিল্প মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে। তবে শ্যুটিং স্পটগুলোর অত্যন্ত বেহাল দশা বলে জানিয়েছেন তিনি। সেখানে শিল্পীদের জন্য যথাযথ ওয়াশরুম ব্যবস্থা থাকেনা এবং এর ফলে অনেক শিল্পীর ইউরিন ইনিফেকশনের মত ভয়াবহ সমস্যা হয়েছে বলে অভিযোগ করেছেন তিনি। তিনি আরও জানান শিল্পী, নির্মাতা ও কলাকুশলীরা একটা সিনেমা বা নাটক তৈরি করতে গিয়ে গরমে-ঘামে ভিজে পরিশ্রম করে কাজ করেন। কিন্তু, তবুও চিত্রনাট্যকাররা সঠিকভাবে টাকা পাননা এবং সরকারের দিক থেকেও কোনো ঠিকঠাক অনুদান নেই। পর্যাপ্ত সুযোগ সুবিধা পেলে বাংলা সিনেমা শিল্প দেশ ও জাতির জন্য আরও অনেক কিছু করতে পারতো বলে মনে করেন তিনি। তিনি তরুন পরিচালকদের সম্ভাবনার কথা বলেন এবং তাদের মেধা ও পরিশ্রমের প্রশংসা করেন। বিশেষ করে বর্তমান সময়ে তরুন নির্মাতাদের শার্টিকাপ ও জাগো বাহের মত ওয়েব সিরিজগুলো তাঁর ভাল লেগেছে বলে জানিয়েছেন তিনি। তিনি বলেন, “নতুনদের থেকেই এখন যা পারছি শিখছি, তাদের থেকে অনেক কিছু শেখার আছে”।

সিনেমা নিয়ে অমিতাভ রেজা চৌধুরীর হতাশার জায়গা হলো সিনেমার সেন্সরবোর্ড। তিনি এটিকে চলচ্চিত্র বিকাশের পথে বাঁধা হিসেবে মনে করেন এবং অন্য কিছুতে সেন্সরবোর্ড না থাকলেও চলচ্চিত্রে সেন্সর আছে বলা জানান তিনি। কোন বই যদি খুব বেশি উগ্রতা না ছড়ায় বা রাষ্ট্রবিরোধী না হয়, সেগুলোর জন্যও কোন সেন্সরবোর্ড নেই অথচ সিনেমার জন্য সেন্সরবোর্ডের নেমে আসে বলে অভিযোগ করেছেন তিনি। তিনি আরও বলেন, সিনেমা রাষ্ট্রের জন্য, রাষ্ট্রের চিন্তার জন্য। একমাত্র সিনেমাই পারে সমাজকে তৈরি করতে, জনগনকে এক করতে এবং জনগনের মাঝে অনুভূতি সৃষ্টি করতে। সিনেমা হলো রাষ্ট্রের এক ধরণের ক্ষমতা আর এই ক্ষমতাকে রাষ্ট্র পরিচালকরা ভয় পান। ব্রিটিশরাও রাষ্ট্রের এই ক্ষমতাকে ভয় পেতো, তাই তারা ১৯১৮ সালে সিনেমায় সেন্সরবোর্ড আরোপ করেছিলো। আর রাষ্ট্র পরিচালকরাও এখন চলচ্চিত্রের এই ক্ষমতাকে ভয় পান, তাই তারা এখনও সেন্সরবোর্ড রেখেছে। রাষ্ট্রের উচিত সিনেমাকে উন্নত করা এবং এর উন্নয়নের জন্য কাজ করা। তিনি হতাশার সাথে জানান যে, রাষ্ট্র চলচ্চিত্র শিল্প নিয়ে ভাবে না এবং এটিকে যথাযথ মূল্যায়ন করে না। যার ফলে চলচ্চিত্র শিল্প যেভাবে চলার কথা ছিল সেভাবে নিজেদের মতো সঠিকভাবে কাজ করতে পারছেনা; যা অত্যন্ত হতাশাজনক।

সিনেমা হলগুলো বর্তমান দুর্দশা কাটিয়ে সামনের দিনগুলোতে আবার ঘুরে দারাতে পারবে কিনা এ বিষয়ে আলোচনা করতে গিয়ে তিনি জানান, বর্তমানে দর্শকদের মাঝে চলচ্চিত্র উপভোগ করার ধরণে পরিবর্তন এসেছে। বর্তমানে মানুষ সিনেমা হলের চেয়ে মোবাইল বা ব্যাক্তিগত ডিভাইসে সিনেমা বেশি দেখছেন। শুধু বাংলাদেশে নয়, ভারত ছাড়া মোটামুটি পৃথিবীর সব দেশেই এই প্রবণতা দেখা যাচ্ছে যে মানুষ সিনেমা হলে কম যাচ্ছে। ফলে, সময়ের পরিবর্তনে সিনেমা হলের ভবিষ্যৎ উন্নয়ন হওয়ার সম্ভাবনা কম বলে মনে করেন তিনি। বর্তমান বাস্তবতাকে বিবেচনায় রেখেই সামনের দিকে বিকল্প মাধ্যমগুলোকে ব্যবহার করে চলচ্চিত্র নির্মানের দিকে অগ্রসর হতে হবে বলে অভিমত প্রকাশ করেন তিনি।
প্রিয় অভিনেতার কারা এমন প্রশ্নের জবাবে অমিতাভ রেজা চৌধুরী জানান তাঁর সবচেয়ে প্রিয় অভিনেতা হলেন হুমায়ূন ফরিদি। এছাড়াও চঞ্চল চৌধুরী তাঁর অত্যন্ত পছন্দের একজন অভিনেতা। চঞ্চল চৌধুরীকে তিনি মাটির মানুষ হিসেবে অভিহিত করেন এবং একজন শক্তিমান অভিনেতা হিসেবে আখ্যা দেন। মোশাররফ করিম, মেহজাবিন, তিশা, নিশো, জয়া আহসান, ফজলুর রহমান বাবু, পংকজ, অশোক, মমোসহ অসংখ্য অভিনেতা আছেন বাংলাদেশে যাদেরকে তিনি গুণী ও প্রতিভাবান অভিনেতা হিসেবে মনে করেন।

অমিতাভ রেজা চৌধুরী নিজের স্বপ্নকে বাস্তবায়ন করতে গিয়ে বিভিন্ন পুরষ্কারে ভূষিত হয়েছেন। তিনি আয়নাবাজি চলচ্চিত্রের জন্য শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র পরিচালক বিভাগে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরষ্কার ও মেরিল-প্রথম আলো পুরষ্কার অর্জন করেছেন। এছাড়াও তিনি ‘একটি ফোন করা যাবে প্লিজ’ ও ‘সারফেস’ – এ দুটি নাটকের জন্য ২ বার সেরা নাট্য নির্দেশক বিভাগে মেরিল-প্রথম আলো সমালোচক পুরস্কার অর্জন করেন। এছাড়াও, প্রামাণ্য চিত্রের জন্য তিনি ক্রোয়েশিয়ার জাগরেভ ট্যূর ফিল্ম উৎসবে পুরষ্কার লাভ করেন। সম্প্রতি, আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে তাঁর নব-নির্মিত ‘রিক্সা গার্ল’ সেরা ছবির পুরষ্কার অর্জন করেছে। খ্যাতিমান এই নির্মাতার ছবিটি প্রেসকট আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে ‘সেরা ফিচার ফিল্ম’ বিভাগে বিজয়ী হয়েছে।
মৃত্যুর পর পৃথিবীর মানুষের মাঝে কী হিসেবে থাকতে চান এমন প্রশ্নের জবাবে অমিতাভ জবাব দেন তিনি দেশের মেহনতি জনতা, সাধারণ জনগন, ও খেঁটে খাওয়া মানুষের পাশে দাঁড়ানোর মত কাজ করেই তাদের মাঝে বেঁচে থাকতে চান। দেশ ও দেশের মানুষের প্রতি অকৃত্রিম প্রেম ও কিছু করতে চাওয়ার আকুলতা প্রকাশ পেয়েছে তাঁর কথায়। আলোচনার শেষ দিকে এসে তিনি সবাইকে অনুরোধ করেন যাকাত বা টাকা দিয়ে মানুষকে সাহায্য না করে এমন কিছু করা যাতে তাদের আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন ঘটে।

স্বপ্নের জাদুকর অমিতাভ রেজা চৌধুরী তার চাওয়াগুলো স্বপ্নের মতো করেই বাস্তবায়ন করতে যাচ্ছেন। সবসময় তিনি বড় কিছু করার চিন্তা করেছেন। দেশের জন্য ও দেশের নিপীড়িত মানুষের জন্য সমাজকে পরিবর্তন করতে চেয়েছেন। সুন্দর সমাজ গড়ার জন্য তিনি হাতিয়ার হিসেবে সিনেমাকেই বেছে নিয়েছেন তাই শারীরিক সকল প্রতিবন্ধকতাকে ছাড়িয়ে গুটি গুটি পায়ে তাঁর স্বপ্নের দিকে এগিয়ে যাচ্ছেন।

আইন জগতের উজ্জ্বল নক্ষত্র: ড. শাহদীন মালিক

আইন জগতের উজ্জ্বল নক্ষত্র: ড. শাহদীন মালিক

স্বাধীনতা পরবর্তী বাংলাদেশে যে কয়জন মানুষ তাদের মেধা ও মনন দিয়ে দেশের আইন প্রাঙ্গনকে সমৃদ্ধ করেছেন এবং দেশের বিভিন্ন জনগুরুত্বপূর্ণ ও জাতীয় স্বার্থের বিষয়ে বলিষ্ঠ কণ্ঠে কথা বলে সুশীল সমাজের একজন আদর্শ ব্যক্তি হিসেবে মানুষের আস্থা অর্জন করেছেন, তাদের মধ্যে একজন হলেন ড. শাহদীন মালিক। “কবিতার সাথে” অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে আমার সুযোগ হয়েছিল এই গুণী ব্যক্তির সাথে তাঁর জীবনের বিভিন্ন প্রসঙ্গ নিয়ে এবং দেশ নিয়ে তাঁর বিভিন্ন ভাবনা নিয়ে আলোচনা করার।

দেশে পড়াশোনার গণ্ডি পেরিয়ে উচ্চতর ডিগ্রীর জন্য তিনি পাড়ি জমিয়েছিলেন সোভিয়েত ইউনিয়ন, যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যে। দেশে ফিরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা দিয়ে শুরু হয় তাঁর চাকরি জীবন। এরপর তিনি একে একে বিচরন করেছেন আইন বিষয়ক বিভিন্ন শাখা প্রশাখায়। পেশাগত জীবনের শুরুর কথা বলতে গিয়ে ড. শাহদীন মালিক বেশ মজা করেই বলেন যে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করার সময় বিএনপি এবং আওয়ামিলীগ উভয় আমলেই তাঁকে বিপরীত দলের একনিষ্ঠ কর্মী মনে করতো এবং এজন্যই তাঁকে ঢাবির শিক্ষকতা ছেড়ে আসতে হয়েছিল। তবে এটিকে তিনি আশীর্বাদ হিসেবে নিয়েছেন, কারন এরপরেই তিনি আইনের আরও বড় জগতটাকে চিনতে পেরেছেন। তখন শিক্ষকতা ছেড়ে তিনি বার কাউন্সিলে কাজ করেছেন কিছুদিন, তারপর ড. কামালের পরামর্শে বিএলএএসটি (BLAST) – এ যোগ দিয়ে কর্মরত ছিলেন ৬-৭ বছর। তিনি বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ও বহুজাতিক সংস্থায় আইনি পরামর্শক হিসেবেও কাজ করেছেন বহু বছর এবং দীর্ঘদিন পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কুল অব ল’ তে। ২০০৩-০৪ সালের দিকে এসেছে প্রায় পঞ্চাশ বছর বয়সে এসে তিনি ওকালতি পেশা শুরু করেছেন এবং ধীরে ধীরে এ পেশার একজন আলোকিত মানুষ হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। সংবিধান বিশেষজ্ঞ ও সুপ্রিম বর্তমানে কোর্টের আইনজীবী ড. মালিক দেশের স্বনামধন্য প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) একজন বোর্ড অব ট্রাস্টি।

আমেরিকার ৫৯ তম নির্বাচন পরবর্তী সামসাময়িক সময়ে হওয়া ড. মালিকের সাথে আমার আলোচনার প্রথমেই উঠে আসে নির্বাচন পরবর্তী বাইডেন সরকারের চ্যালেঞ্জ সম্পর্কে। তিনি বলেন, এরপূর্বে সিনিয়র জর্জ বুশ রাজনীতিতে বহুদিনের অভিজ্ঞতা নিয়ে প্রেসিডেন্ট হিসেবে এসে তৎকালীন সময়ের দুরবস্থা কাটিয়ে মানুষকে একত্রিত করতে পেরেছিলেন। তাই তিনি আশাবাদী যে, দীর্ঘদিন রাজনীতির সাথে থেকে এবং সর্বশেষ ওবামা প্রশাসনের সাথে ভাইস-প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করা অভিজ্ঞ জো বাইডেনও ট্রাম্পের তৈরি করা বিভাজিত আমেরিকাকে একত্রিত করতে পারবেন।

দেশের বাক-স্বাধীনতা নিশ্চিত করাকে কঠিন বলে মনে করেন তিনি। কিছুটা হাস্যরসাত্মকভাবে অতীত ইতিহাসকে উল্লেখ করে তিনি বলেন, বাঙালির ইতিহাসে কখনও সুন্নী মুসলিমরা রাজ্য শাসন করেন নাই বা জমিদার ছিলেন না। নবাব সিরাজ উদ-দৌলা সহ সকল মুসলিম শাসকরা ছিলেন শিয়া গোত্রের মুসলিম। ফলে, বর্তমান সময়ে এসে সুন্নী মুসলিমরা ক্ষমতার স্বাদ পেলেই অতীতের ক্ষমতা না পাওয়ার ক্ষত থেকে নিজেদেরকে এখন জমিদার ভাবতে শুরু করেন এবং সেভাবেই প্রজাদের মুখ বন্ধ রাখার বিভিন্ন জমিদারী আচরন করেন। জাতীয় নির্বাচনের ইস্যুতে তিনি মনে করেন স্বাধীনতা পরবর্তী বাংলাদেশের রাজনৈতিক পটভূমি বিবেচনায় দলীয় সরকারের অধীনে সুষ্ঠ নির্বাচন সম্ভাবনা কম। পাশাপাশি, জাতীয় জনগুরুত্বপূর্ন বিষয়ে দেশের অভিজ্ঞ ও পারদর্শী ব্যক্তিদের পরামর্শ নেয়া হয়না বলে দাবি করেন তিনি। তিনি জানান, কোভিড-১৯ মহামারিতে দেশে প্রথম সেক্রেটারিয়েটের বাইরের মানুষদের পরামর্শ নেয়ার জন্য কমিটি করা হয়েছে এবং এমন ব্যবস্থা অন্যান্য সকল বিষয়ে থাকা দরকার। উগান্ডা ও রুয়ান্ডার মত দেশের উদাহারন টেনে তিনি জানান, স্বল্পোন্নত এ দেশগুলো যদি নিজেদের দেশের বিভিন্ন ইতিবাচক পরিবর্তন আনতে পারে, বাংলাদেশ কেন পারবে না?

দেশের দুর্নীতি রোধে দুর্নীতি দমন কমিশনে আইন বিষয়ক জ্ঞান নেই এমন লোকবল নেয়ার সমালোচনা করেন তিনি। তিনি জানান, আইনজীবীরা বহু বছরের অভিজ্ঞতা নিয়ে দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্ত ব্যাক্তির পক্ষে উকিল হয়ে কোর্টে দাড়ান। অন্যদিকে, দুদকের কর্মকর্তাদের আইনের বিষয়ে পারদর্শিতা না থাকায় মামলা সাজানোতে বিভিন্ন ঘাটতি থাকে এবং সহজেই অভিজ্ঞ আইনজীবীদের সামনে দুর্নীতির মামলায় সুবিধা করতে পারেন না। তিনি পরামর্শ দেন যে দুদকে যেন আইন বিষয়ে পারদর্শী এমন ব্যক্তিদেরকেও নিয়োগ দেয়া হয়। পাশাপাশি, দুর্নীতি রোধে রাজনৈতিক সদিচ্ছার প্রয়োজন বলে মনে করেন তিনি। মানি লন্ডারিংয়ের বিষয়ে জিজ্ঞেস করা হলে শাহদীন মালিক জানান, যে টাকা বাইরে পাচার হয়ে গেছে তা ফিরিয়ে আনা সম্ভব না। তাঁর মতে, আগামী কয়েক বছরে বর্তমান আইনের বড় রকমের পরিবর্তন না হলে এক হাজার টাকা পাচার হলে সর্বোচ্চ পনের টাকা ফিরিয়ে আনা সম্ভব হবে। আমাদের দেশে যেমন বাইরের কোনো দেশের অতিথি আসলে আমরা তাদেরকে আমাদের দেশে বিনিয়োগ করার জন্য অনুরোধ করি, তেমনি বাইরের দেশেও আমাদের দেশের কেউ গেলে অনুরোধ করা হয় বলে জানান তিনি। ফলে, দেশের ব্যবসায়ীরা বাইরে বিনিয়োগ করবেই এবং এটাই বর্তমান সময়ের বাস্তবতা বলে মনে করেন তিনি। তাই, বর্তমান প্রেক্ষাপটকে বিবেচনায় নিয়েই এ বিষয়ে ব্যবস্থা নেয়ার কথা জানান তিনি।

আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা’র (আইএলও) পরামর্শক হিসেবে দায়িত্ব পালন করা শাহদীন মালিক শিশুশ্রম বন্ধের বিষয়ে জানান, বর্তমানে আন্তর্জাতিক মহলের চাপে গার্মেন্টস খাতে শিশুশ্রম বন্ধ হয়েছে। তবে, আনঅফিশিয়াল গার্মেন্টসগুলোতে এখনও শিশুশ্রম আছে বলে মনে করেন তিনি। মি. মালিক জানান, বাংলাদেশ সরকারের নেয়া বিভিন্ন সোশ্যাল ওয়েলফেয়ার কর্মসূচী যেমন বয়স্ক ভাতা, বিধবা ভাতা, স্কুলে বিনামূল্যে খাবার প্রদান ইত্যাদি শিশুদের পড়ালেখা করানোর প্রতিবন্ধকতাকে দুর করেছে। আইন করে শিশুশ্রম বন্ধ করা যাবেনা, বরং এমন উদ্যোগগুলোই এটি বন্ধ করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে বলে জানান তিনি। প্রবাসী শ্রমিকদের বিষয়ে তিনি বলেন, যে মানুষগুলো জীবিকার তাগিদে প্রবাসে পাড়ি জমাচ্ছেন, তাদের থেকে নির্দিষ্ট খরচের থেকে কয়েক গুন বেশি টাকা নিয়ে তা ভোগ করছে মধ্যস্বত্বভোগীরা এবং যে খরচ করে তারা বিদেশে যান তা তাদের আয় থেকে তোলা কঠিন। এ মধ্যস্বত্বভোগীদের সাথে রাজনৈতিক মদদ আছে বলে জানান তিনি। পাশাপাশি তিনি উল্লেখ করেন যে, দেশে দক্ষ শ্রমিকের অভাব এবং বিশ্বের শ্রম বাজারে আমাদের শ্রমিকরা পরিচ্ছন্নতা কর্মী ছাড়া আর কোনো দক্ষ পদে কাজ করতে যেতে পারেনা, যা হতাশাজনক।

দেশের বিচার বিভাগের স্বাধীনতার বিষয়ে তিনি ২০০৭-০৮ এর তত্বাবধায়ক সরকারের কথা উল্লেখ করে বলেন, ঐ সরকারই এ বিভাগকে স্বাধীন করার বিষয়ে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল। এরপর আর কোনো সরকার এ বিষয়ে সদিচ্ছা দেখায়নি। এমনকি আইনজীবীরাই নিজেদেরকে নির্দিষ্ট দলের কেউ ভাবতে পছন্দ করেন বলে জানান তিনি। বিচার বিভাগের স্বাধীনতার বিষয়ে তাই সরকার ও আইনজীবী দুই পক্ষকেই সদিচ্ছা নিয়ে এগিয়ে আসতে হবে বলে বিশ্বাস করেন তিনি। বিচারপতি সিনহার বিষয়ে তিনি জানান, ব্যক্তি হিসেবে তিনি সবসময়ই বিচারকদের স্বাধীনভাবে মত ও রায় প্রকাশের জন্য অনেক চেষ্টা করেছেন, তবে শেষ পর্যন্ত তাঁর করুন পরিনতি হয়েছে যা অন্যান্য বিচারপতিদেরকে স্বাধীন বিচারবিভাগ নিশ্চিতে ভূমিকা পালনে নিরুৎসাহিত করবে। সুবিচারের বিষয়ে তিনি বলেন দেশে রাজনৈতিক মামলাগুলো ছাড়া অন্যন্য মামলাগুলো সঠিকভাবেই নিষ্পত্তি হচ্ছে। তাঁর মতে, যেসব মামলায় অনেক সময় লাগে তা অন্যান্য দেশেও লাগে, এটি আলাদা কিছু নয়। তিনি মনে করেন, দেশে প্রতি বছর হাজার হাজার মামলার রায় হচ্ছে, কিন্তু মিডিয়ায় কতোটি মামলার রায় আসেনি তা নিয়ে রিপোর্ট হলেও কয়টির রায় হলো তা নিয়ে রিপোর্ট হয়না।

দেশ ও জাতির বিভিন্ন জনগুরুত্বপুর্ণ আলোচনা শেষে আমরা আবার ফিরে এলাম শাহদীন মালিকের ব্যক্তি জীবনে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে পড়াশোনার অভিজ্ঞতা থেকে কোন দেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে সবচেয়ে বেশি শিখতে পেরেছেন এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি জানান যে ৭০ দশকের তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নে পড়াশোনা করে তিনি সবচেয়ে বেশি শিখেছেন। তাঁর মতে ব্রিটিশ ধারায় পড়াশোনা করার ফলে আমাদের মত দেশগুলো উচ্চমাধ্যমিকের পরে শিক্ষার্থীদেরকে একমূখী শিক্ষা প্রদানে করা হয়, ফলে অন্যান্য বিষয়গুলো নিয়ে তাদের জ্ঞান থাকেনা। এক্ষেত্রে মস্কোর আইনের পাশাপাশি বিভিন্ন ধরণের বিষয়ের ওপর পড়ানো জ্ঞান তাঁকে জানতে ও শিখতে সাহায্য করেছে। তবে আমেরিকাতে আইন নিয়ে পড়াশোনা করা অনেক কঠিন ছিল বলে জানিয়েছেন তিনি, একই বাসায় থাকলেও তখন তাঁর স্ত্রীর সাথে অনেক কম কম দেখা হতো। কিভাবে আইন পেশাকে নিজের স্বপ্ন হিসেবে ভাবতে শুরু করেছেন এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন এটি কখনও তাঁর স্বপ্ন ছিলোনা এবং এমনিই কিভাবে যেন হয়ে গেল তিনি জানেন না। তবে ২০০৩-০৪ সালের দিকে এসে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও আন্তর্জাতিক সংস্থার সাথে কাজ করার পর হঠাৎই তিনি উকিল হিসেবে প্র্যাকটিস করার সিদ্ধান্ত নিয়ে বসেন এবং ৫০ বছর বয়সে তিনি এ পেশায় কর্মজীবন শুরু করেন।

দেশের সুশীল সমাজের একজন প্রতিনিধি হিসেবে এবং সচেতন নাগরিক হিসেবে শাহদীন মালিক দেশকে ভবিষ্যতে কোথায় দেখতে চান এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি গনতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছে এমন একটি বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখেন। তিনি মনে করেন গণতন্ত্র না থাকলে উন্নয়ন হয়না, আর হলেও তা নির্দিষ্ট কিছু মানুষের উন্নয়ন হয়, সামগ্রিক হয়না। তিনি এমন একটি বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখেন যেখানে একে অন্যের গঠনমূলক সমালোচনা করতে পারবে, সবার বাক-স্বাধীনতা থাকবে, এবং এর মধ্য দিয়ে সামগ্রিক উন্নয়ন নিশ্চিত হবে। মি. মালিক জানান, আমেরিকাতে সার্বজনিন ভোটাধিকার নিশ্চিত হয়েছে ১৯৭৬ সালে জিমি কার্টারের নির্বাচনে, অন্যদিকে আমাদের এই ভু-খন্ডে আমরা ১৯৭০ এর নির্বাচনেই সার্বজনিন ভোটাধিকার নিশ্চিত করেছি এবং এখনও তা চর্চা করে যাচ্ছি। তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেন যে, এভাবে একদিন দেশে সঠিক গনতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হবে। একইভাবে বিচার বিভাগের কথা উলেখ করে জানান, আমাদের এ ভূ-খন্ডে আমরা ইউরোপের বহু দেশের আগে থেকেই বিচারালয়ে বিচারকার্য পরিচালনা করে আসছি এবং একই ধারায় একটি স্থিতিশীল প্রক্রিয়ায় তা অনুশীলন করে যাচ্ছি যা অন্যান্য অনেক উন্নত রাষ্ট্রেও নেই। তাই, এ দেশে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠিত হবে বলে আশাবাদী তিনি।

গুণী ব্যক্তি হিসেবে আইন পেশার পাশাপাশি শাহদীন মালিক বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন গবেষনাপত্র প্রকাশ করেছেন। ভবিষ্যৎ প্রজন্ম তাঁকে কিভাবে মনে রাখবে এ কথার জবাবে তিনি নিজেকে লেখক হিসেবে দেখতে চান বলে জানিয়েছেন। দৈনিক পত্রিকায় কলাম লেখার পাশাপাশি সামনের দিকে লেখালেখি করে যাবেন বলে জানিয়েছেন তিনি।

লুৎফর রহমান রিটন: শিশুদের অতি আপন শব্দ জাদুকর

লুৎফর রহমান রিটন: শিশুদের অতি আপন শব্দ জাদুকর

জনপ্রিয় লেখক ও ছড়াকার লুৎফর রহমান রিটনের জন্ম ১ এপ্রিল, ১৯৬১ সালে। পুরনো ঢাকার ওয়ারী এলাকায় তাঁর শৈশব অতিবাহিত হয়। শিক্ষাজীবনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে ১৯৮৯ খ্রিষ্টাব্দে আবুজর গিফারি কলেজ থেকে স্নাতক শেষ করেন। বাংলাদেশি ছড়াকার ও লেখক হিসেবে তিনি সত্তরের দশকে আত্মপ্রকাশ করেন। তাঁর শিশুতোষ ছড়া ও কবিতা বিংশ শতকের শেষভাগে জনপ্রিয়তা লাভ করেছে। তিনি ২০০১ খ্রিষ্টাব্দে জাপানে বাংলাদেশের কালচারাল এটাশে হিসেবে নিযুক্ত হয়েছিলেন। গুণী এই সাহিত্যিকের প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যা শতাধিক। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল: ধুত্তুরি, ঢাকা আমার ঢাকা, উপস্থিত সুধীবৃন্ধ, হিজিবিজি, তোমার জন্য, ছড়া ও ছবিতে মুক্তিযুদ্ধ, রাজাকারের ছড়া, নেপথ্য কাহিনী ইত্যাদি। নিজের সাহিত্যকর্মের জন্য ২০০৭ সালে তিনি বাংলা একাডেমী সাহিত্য পুরস্কার লাভ করেন। এছাড়াও তিনি সিকান্দার আবু জাফর সাহিত্য পুরস্কার, অগ্রণী ব্যাংক শিশু সাহিত্য পুরস্কার, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পুরস্কার, বাংলা একাডেমী সাহিত্য পুরস্কার সহ বহু পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন। বর্তমানে গত কয়েক বছর ধরে তিনি পরিবার নিয়ে কানাডায় বসবাস করছেন। নিজের ব্যক্তি ও সামাজিক জীবনসহ আমাদের সমাজ বাস্তবতার নানা আঙ্গিক নিয়ে লুৎফর রহমান রিটন কথা বলেছেন কবিতার সাথে অনুষ্ঠানে।

কেন এই প্রবাসজীবন বেছে নেয়া, এ প্রশ্নের জবাবে তিনি তাঁর ভাগ্যের পরিহাসের কথা জানান। ২০০১ সালে জাপানে যোগদানের পরপরই রাজনৈতিক রোষানলে পড়তে হয় তাঁকে, এমনকি তাঁর কূতনৈতিক পাসপোর্টও জব্দ করা হয়। এরপর নানা ভাবে তিনি কানাডায় গিয়ে পৌঁছান, যেখানে ৭ বছরের মতো তাকে রাজনৈতিক আশ্রয়ে থাকতে হয়েছে। যদিও এখন আবার সবই স্বাভাবিক, কিন্তু ঐ ৭ বছরে একটা শেকড় গজিয়ে গেছে বলে জানান তিনি। এখন এই লেখকের নিয়মিতই বাংলাদেশে আসা হয়, কিন্তু নিয়তির বিধানে এক অলঙ্ঘনীয় দূরত্ব তৈরি হয়েছে বলে জানান তিনি। এছাড়া মুক্তচিন্তাসম্পন্ন এই লেখক নিজের স্মৃতিকথা সম্পর্কিত লেখা নিয়েও খোলামেলা কথা বলেন। তাঁর এসব লেখায় তাঁর ব্যক্তিজীবন, পরিবেশ, অর্থনৈতিক অবস্থা তথা সামাজিক বাস্তবতা – সবই উঠে এসেছে। তিনি বলেন, নিজের আত্মজীবনীতে মি

থ্যা কিছু লিখবেন না বলে শপথ করেছিলেন। একসময় এদেশের মধ্যবিত্তদের মাধ্যমেই সংস্কৃতি সঞ্চারিত হত প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে। এমনই এক মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান তিনি। লেখক হওয়ার জন্য যখন সংগ্রাম করে যাচ্ছিলেন তখন তিনি কেন এপথে এলেন যেখানে তাঁরই অনেক বন্ধুর হাতে কলমের বদলে সন্ত্রাসের অস্ত্র ছিল, এ ধরনের নানা গঠনমূলক গভীর চিন্তার প্রতিফলন ঘটেছে তাঁর এই লেখাগুলোতে। চিরাচরিত আত্মজীবনীর সুন্দর-সুখী পরিবারের চিত্র না এঁকে তিনি তাঁর পরিবারের বাস্তবতা, তাঁর স্ত্রীর মানসিকভাবে নির্যাতিত হওয়ার ঘটনা, সব তুলে ধরেছেন অকপটে। কারণ তাঁর মনে হয়েছে, এগুলো নিয়ে না লিখলে আমাদের মেয়েরা নির্যাতিত হ

তেই থাকবে। আর অভ্যন্তরের ঘটনা বলে এধরনের নির্যাতনকে আজীবন চাপা দিয়ে রাখার অভ্যাসটাও যাতে আমাদের বদলায়, পারিবারিক ও সামাজিক বাস্তবতা যেন ইতিহাসে সঠিকভাবে উঠে আসে এই আশাই তিনি ব্যক্ত করেন।

তাঁর কাছে আমরা তাঁর ছোটবেলা থেকেই শিল্প-সাহিত্যের সাথে যুক্ত থাকার গল্প শুনতে পাই। একদিন ঘুড়ি উড়াতে গিয়েই আকস্মাৎ তাঁর হাত ধরে ফেলেন রোকনুজ্জামান খান, যিনি দাদাভাই নামেই অধিক পরিচিত ছিলেন। তখন তিনি ইত্তেফাকের শিশু-কিশোরদের উপযোগী কচিকাঁচার আসর বিভাগের পরিচালক। রোকনুজ্জামান খানের হাত ধরেই ধীরে ধীরে লুৎফর রহমানের ছবি আঁকা, গান গাওয়ার অনেকটা আনুষ্ঠানিক শিক্ষা শুরু হয়। তিনিও সম্পৃক্ত হয়ে যান কচিকাঁচার মেলার সাথে। দাদাভাই প্রায়ই তাঁর হাতে আঁকা ছবি ছাপতেন দৈনিকের পাতায়। এভাবেই ১৯৭২ সালের একদিনে, ৯-১০ বছর বয়সী লুৎফর রহমানের ছড়া ছাপা হয় দৈনিকে, যেটা তাঁর ভেতরকার প্রতিভাকে ভীষণভাবে নাড়া দিয়ে যায়। সে জন্যেই নিজের জীবনের গতিপথ বদলে শিল্প-সাহিত্যের বর্ণাঢ্য জগতে প্রবেশ করানোর কারিগর হিসেবে তিনি দাদাভাইকে নিজের গুরুতুল্য মনে করেন। নিজের চিত্রশিল্পী হওয়ার চেষ্টা এবং ব্যর্থতা নিয়ে তিনি বলেন, প্রত্যেকটা মানুষকেই নিজের ক্ষেত্র চিনতে হবে। প্রকৃতি সবাইকে কিছু না কিছু গুণ তথা দায়িত্ব দিয়ে পাঠিয়েছে। সে জন্যেই হয়ত আজ তিনি নিজে ছড়াকার হয়ে উঠেছেন এবং তাঁর চিত্রকর বন্ধুরাই তাঁর বইয়ের প্রচ্ছদ এঁকে দিচ্ছেন। এই ছড়াকার হয়ে ওঠার পেছনে রয়েছে ৪৮-৫০ বছরের নিরলস পরিশ্রম, নিজের মধ্যে শিল্প গ্রহন করার মত সক্ষমতা। অসংখ্য বই পড়ে তিনি বুঝেছেন যে, দুটি বিষয়ে কখনো ফাঁকি দিতে নেই, এক হলো সংসারের ক্ষেত্রে, আর দুই হল শিল্প-সাহিত্যের ক্ষেত্রে। যারা এগুলোতে ফাঁকি দেয় তারা মূলত নিজেদেরকেই ফাঁকি দেয় বলে মন্তব্য তাঁর।

শিল্প সৃষ্টিতে তাঁর বড় অনুপ্রেরণার জায়গা হল সত্যজিত রায় ও তাঁর “হীরক রাজার দেশে”। ছড়া দিয়ে ও ছন্দের মধ্য দিয়ে এত সুন্দর উপস্থাপন তাকে চমৎকৃত করে। সেই অনুপ্রেরণা থেকেই তিনি সামরিক শাসক এরশাদের আমলে “হবুচন্দ্র রাজার দেশে” নামের একটি নাটকও নির্মাণ করেছিলেন। নিজেকে সত্যজিত রায়ের মহাভক্ত হিসেবে

 পরিচয় দিতে তাই লুৎফর রহমানের বিন্দুমাত্র বাধে না। স্বয়ং সত্যজিত রায় অবাক হয়েছিলেন যখন তিনি ১৯৮৩ সালের এক সরাসরি সাক্ষাৎ এ জানতে পারেন যে ‘হীরক রাজার দেশে’র সকল দৃশ্য এই গুণি ব্যক্তির মুখস্তপ্রায়। এর কারণ হিসেবে তিনি বলেন, ছড়া নিয়েই তাঁর জীবন কেটেছে, তাই ছড়া বিষয়ক যেকোনো কিছু তাঁর অত্যন্ত আপন। অনেক পরিচয় থাকা সত্ত্বেও ছড়াকার পরিচয়েই তিনি সবচেয়ে সাচ্ছ্যন্দবোধ করেন। ছড়াকে এত ভালোবাসেন দেখেই যখন সবচেয়ে প্রিয় কোন লেখা সম্পর্কে জানতে চাওয়া হয় তখন অম্লমধুর দ্বন্দে পড়ে যান। সন্তানতুল্য লেখাগুলোর মধ্য থেকে কোনো একটাকে বেছে নেয়ার কঠিন পরীক্ষাটি তিনি দেশাত্মবোধক একটি ছড়া বেছে নেয়ার মাধ্যমে কেটে উঠেন। দীর্ঘ প্রবাসজীবনে দেশের প্রতি যে আকুতি সৃষ্টি হয় সেটাই তাঁর এই ছড়ার মাধ্যমে প্রকাশ পায়।

সুদূর প্রবাসে থাকলেও রিটন প্রতি বছর বইমেলার সময় নিয়মিত দেশে আসেন। বই মেলায় তাঁর একটি নিয়মিত কাজ হলো তরুণ লেখকদের জন্য নতুন নতুন লেখা সংগ্রহ করে সেগুলো পড়া এবং ভালো লেখকদের সাথে নিজে থেকে যোগাযোগ করে তাদেরকে উৎসাহ জানানো। তিনি মনে করেন, এখনকার তরুণদের মধ্যে সবচেয়ে ভালো ছড়া লেখেন রোমেন রায়হান। এছাড়াও সারওয়ারুল ইসলাম ও আহমেদ সাব্বিরের মতো তরুণদের লেখার প্রশংসাও ঝরে পড়ে তাঁর কন্ঠে। তিনি মনে করেন, এই লেখকরা যদি সাধনা করে যান তাহলে তাদের কাছে পাঠকরা খুব ভালো ছড়া উপহার পাবেন। কিন্তু ছড়া বা লেখালেখির পেছনে সাধনা করতে গেলে কর্মক্ষেত্রে একটু পিছিয়ে পড়তে হয়। ভালো লেখক যারা, তাদের প্রধান কাজই ছিল লেখা, আর চাকরি ছিল তাদের জীবনধারনের উপায় মাত্র। ঠিক একইভাবে, ভালো ছড়াকার হতে গেলে ২৪ ঘন্টার ছড়াকার হতে হবে বলে তিনি মন্তব্য করেন। এছাড়া একজন ছড়াকারকে সকল বিষয়ের জ্ঞান রাখতে হবে, সমসাময়িক পৃথিবীতে কি চলছে সেই ধারণা থাকতে হবে। তা নাহলে লেখকের লেখার জগত সীমাবদ্ধ হয়ে যাবে। যুগের সাথে তাল মিলিয়ে বিষয় এবং উপস্থাপন পরিবর্তিত না হলে লেখায় নতুন দিগন্ত আসবে না। পড়াশোনার মাধ্যমেই একজন শিল্পীর নিজস্ব ভঙ্গি সৃষ্টি হয়। তাই লেখক হওয়ার জন্য ও শিল্পী হওয়ার জন্য পড়াশোনার বিকল্প নেই। 


কথা বলতে বলতে এদেশের সিনেমা নিয়ে রিটন তাঁর আশাবাদ ব্যক্ত করেন। তিনি জানান, আমাদের তরুণ প্রজন্মের যারা সিনেমার হাল ধরেছে, তাদের কাজ তাঁকে মুগ্ধ করে। সিনেমাকে রন্ধনশিল্পের সাথে তুলনা করে তিনি বলেন, একটি সিনেমায় গল্প থেকে শুরু করে অভিনয়, ক্যামেরা ও পারিপার্শ্বিক সব কিছুর একটা সুষম সমন্বয় দরকার। হালের সিনেমা “হাওয়া”র প্রশংসাও তাঁর কণ্ঠে ভেসে আসে। তিনি বলেন, মানুষ যেখানেই থাকুক না কেন, সবসময় শেকড়ে ফিরে যেতে চায়। আর এই সিনেমাটি এর সুর ও আবহ সবকিছু দিয়ে সেটাই তৈরি করতে চেয়েছে। এটাকে আমাদের চলচিত্রশিল্পের একটি বড় মাইলফলক হিসেবে দেখেন তিনি এবং মনে করেন মোস্তফা সরওয়ার ফারুকী ও মেজবাউর রহমান সুমনদের মত পরিচালকদের হাত ধরে দেশের চলচ্চিত্র জগতে বিরাট পরিবর্তন আসছে।

নিজের লেখার মাধ্যমে ও ছড়ার মাধ্যমে শিশুদের হৃদয়ে জায়গা করে নেয়া এই বিনয়ী ছড়াকার মনে করেন, এত কিছু অর্জনের পরেও তিনি পরবর্তী প্রজন্মের জন্য তেমন কিছুই করতে পারেন নি। এমন কথা তাঁর শুদ্ধচিন্তা এবং সরল মনেরই পরিচায়ক। তিনি বলেন, মানুষ অনেক কিছু ভুলে গেলেও তাঁর শৈশবকে কখনও ভোলে না, শৈশবে পড়া বই কখনও ভোলে না। তাই তাঁর ছড়া পড়ে যদি একটি শিশু অল্প কিছু মূহুর্তও হাসে, সেই হাসির নেপথ্যে থাকা ব্যক্তি হিসেবে সেটাই তাঁর সান্ত্বনা হবে। এই ভালোবাসার বেশি কিছু তিনি চাননি এবং এই ভালোবাসাটুকু নিয়েই তিনি পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করতে চান। এমন বিশুদ্ধ মানসিকতার মানুষরা আরও দীর্ঘদিন আমাদের মাঝে থাকুক এবং আমাদের শিশুদের মুখে হাসি ফোটাক, এই কামনাই রইল।

গানে গানে জীবন : ডরথী বোস

গানে গানে জীবন : ডরথী বোস

গান মানুষের জীবনের কথা বলে, গান মানুষের প্রাণের কথা বলে। গানের মাধ্যমে মানুষ হারিয়ে যেতে পারে অন্য এক জগতে যে জগৎ তার একান্ত ব্যক্তিগত। তাইতো গানের শিল্পীরা নারী-পুরুষ ও যুবক-বয়স্ক নির্বিশেষে সবার কাছে বিশেষভাবে সমাদৃত হন। আজকে ঠিক এমনি একজন মানুষের কথা বলবো যে তার সুর দিয়ে জয় করে নিয়েছে জনমানুষের মন। গানে গানে যার বেড়ে ওঠা। আমেরিকাসহ দেশ-বিদেশে গানের জন্য সুপরিচিত একটি নাম ডরথী বোস।

ডরথী বোসের বেড়ে ওঠা রাজধানী ঢাকাতেই। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগ থেকে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করে উচ্চশিক্ষার জন্য সুদূর যুক্তরাষ্ট্রে পাড়ি জমান তিনি। সেখানে মনস্তত্ত্ব নিয়ে পড়াশোনা করেন এবং বর্তমানে স্বামী সন্তানসহ যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটন ডিসিতে অবস্থান করছেন তিনি।

ডরথী বোসের সঙ্গীতের হাতেখড়ি তার বাবার কাছেই। গানের চর্চাকে কখনো আদালাভাবে দেখেননি তিনি। কেননা, তার বেড়ে ওঠা গানের মাঝেই। ছোটবেলা থেকেই গান ও সুর শুনে শুনেই বড় হয়েছেন তিনি, তাইতো গান যে তাঁর একাডেমিক শিক্ষার অংশ নয় সেটি কখনোই উপলব্ধি করেন নি তিনি। মূলধারার শিক্ষার পাশাপাশি তিনি রবীন্দ্র সঙ্গীতের উপর প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা নিয়েছেন। টিভি খুললেই বিভিন্ন বাংলা গানের অনুষ্ঠানে দেখা যায় তাঁকে। এছাড়া, আমেরিকায় বাংলা ভাষাভাষী মানুষের কমিউনিটি অনুষ্ঠানে ডরথী বোস জনপ্রিয় একটি নাম। তিনি খুবই সংস্কৃতিমনা একজন মানুষ। তাইতো, পারিবারিক ও ব্যক্তিগত জীবন দুই জায়গাতেই বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতিকে তিনি লালন করে চলছেন প্রতিনিয়ত। বিদেশে থাকলেও দেশীয় সংস্কৃতি চর্চায় কখনো অবহেলা করেন না তিনি।

ডরথী বোস রবীন্দ্রচর্চার জন্য বিশেষভাবে খ্যাত। অন্যান্য গানের চর্চা করলেও রবীন্দ্রসংগীতের উপর তার রয়েছে প্রাতিষ্ঠানিক দক্ষতা। তাঁর এই রবীন্দ্র প্রীতি কিভাবে জন্ম নিলো এমন প্রশ্নের উত্তরে ডরথী বলেন ছোটবেলা থেকেই তাঁর গান শুনে শুনে বড় হওয়া। যখন গান শুনতো তখন তিনি বুঝতেনও না কী গান চলেছে। মায়ের কাছ থেকেই রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে জেনেছেন তিনি। তাদের বাড়িতে সবসময় ক্লাসিকাল গান বাজতো এবং গ্রামোফোনন ও রেকর্ড প্লেয়ার ছিলো তাদের বাসায়। নজরুল, শ্যামা সঙ্গীত, রবীন্দ্রনাথ অথবা পুরোনো দিনের সিনেমার গান বাজতো সবসময়। সেই শৈশব থেকে রবীন্দ্রনাথ শুনে শুনে বড় হতে হতে একটা সময় তাঁর মাঝে রবীন্দ্র প্রীতির জন্ম হয়েছে বলে জানিয়েছেন তিনি।

বর্তমানে ডিজিটাল যুগে বাস করছি আমরা সবাই। ইন্টারনেটের সহজলভ্যতার পাশাপাশি নেশাদ্রব্য থেকে শুরু করে অনেক কিছুই এখন আমাদের কাছে সহজলভ্য হয়ে উঠেছে। এছাড়া, প্রবাসে বসবাস করলেও আমরা চাই আমাদের সন্তানরা আমাদের সংস্কৃতি লালন করুক, অন্যদিকে সন্তানরা আরেকটি সংস্কৃতিতে অভ্যস্ত। দু’পক্ষের এই টানাপোড়নে হতাশার সৃষ্টি হয় বাচ্চাদের মাঝে। ডরথী বোস কেবল সংগীত শিল্পী নন তিনি একজন মনস্তত্ত্ব বিশেষজ্ঞ। একজন মা এবং মন বিষয়ক বিশেষজ্ঞ হিসেবে এই ব্যাপারে তাঁর অভিমত কী এই প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, “টিন-এজ বা কিশোর বয়সটা খুবই আবেগকেন্দ্রিক। প্রত্যেকটা পরিবারই জড়তাগ্রস্থ এবং সমস্যাবিহীন কোন পরিবার নেই। এছাড়া এখনও বাংলাদেশে কিছু ট্যাবু কাজ করে। শুধু দেশে নয় বিদেশেও এসব ট্যাবু রয়েছে। তারা হতাশার জন্য কোন পদক্ষেপ নিতে চায় না। তারা ভাবে তাদের সন্তানতো পাগল নয়। এছাড়া আমরা বুঝতেও পারি না কখন আমাদের কাউন্সিলর প্রয়োজন। হতাশায় ভোগা মানে পাগল হয়ে যাওয়া নয়, এটি ক্যামিকেল ইমব্যালেন্সের ফল এই ব্যাপারটি মানু্ষ বুঝে না। আমরা স্বীকার করি না আমাদের সন্তানদের সমস্যা আছে। তিনি বলেন, বাবা মা হিসেবে প্রথম দায়িত্ব হলো সন্তানের সমস্যা স্বীকার করা এবং সন্তানের মানসিক অবস্থা বোঝার চেষ্টা করা। সন্তানের সাথে খারাপ আচরণ না করে সময় নিয়ে তাদের কথা শোনা এবং বাচ্চাদের সান্থে সময় কাটানো।

যখনই পরিবার বাচ্চাদের কথা শোনেনা বা পরিবারের সাথে দূরত্ব সৃষ্টি হয় তখনই তারা মাদকাসক্ত হয়ে পড়ে বা বিভিন্ন ধরণের অনৈতিক কাজ করে। তিনি জোর দিয়ে বলেন, পিতামাতা ও সন্তানদের মাঝে যেন দূরত্বের সৃষ্টি না হয়। তার নিজেরও দুটো সন্তান আছে, তিনি প্রতিদিন নিয়ম করে সন্তানরা স্কুল থেকে ফেরার পথে তাদের খোঁজ খবর নেন। যেমন – স্কুল কেমন গেলো, কোন বন্ধুদের সাথে মিশে ইত্যাদি। বাচ্চারা কোনও ভুল করলে যাতে বাবা-মায়ের সাথে শেয়ার করতে পারে এমন একটা বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রাখার ওপর জোর দেন তিনি। তবে সেই বন্ধুত্বের অবশ্যই সীমাবদ্ধতা থাকবে বলেও মনে করেন তিনি। তিনি তাঁর ছেলেমেয়েদেরকে বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে নিয়ে যান। বিভিন্ন ধরনের সামাজিক অনুষ্ঠানে তিনি তার ছেলেমেয়েদের ভলেন্টিয়ারিং করানোর চেষ্টা করেন। এতে করে বাচ্চাদের মানসিক বিকাশ হয়। বিভিন্ন সংস্কৃতির সাথে যেমন পরিচিত হয় তেমনি নিজের সংস্কৃতির প্রতি সম্মান ও শ্রদ্ধাবোধও সৃষ্টি হয়। সবকিছুতে এক্টিভ রাখতে চান তিনি, এরপর সন্তানরা কতটুকু গ্রহন করবে সেটা তাদের ব্যাপার। একজন শিশুর সুস্থভাবে বেড়ে ওঠার সাথে প্যারেন্টিং খুবই গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করেন তিনি।

ডরথী বোস ছোটবেলায় কেমন ছিলেন এবং কী স্বপ্ন ছিলো এই প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ছোটবেলায় তিনি খুব একটা  দুষ্টও ছিলেন না আবার শান্তও ছিলেন না। তবে তিনি খুব পড়ুয়া ছিলেন। তাঁর ছোটবেলাটা ছিলো খুবই সুন্দর। পরিবারের সবাই মিলে চাঁদের আলোয় ছাদে গান গাইতেন তারা। লোডশেডিং হলে ডরথী বোসের খুশির সীমা থাকতো না। এখন তিনি এসব মিস করেন। ছোটবেলা থেকেই গানের প্রতি তার ছিলো অগাধ ভালোবাসা। তাই গান নিয়ে কিছু একটা করার স্বপ্ন ছিলো তাঁর। তাছাড়া আমেরিকায় থেকে যাওয়ারও ইচ্ছে ছিলো না। তিনি এখনো মনে করেন, যদি দেশে থাকতেন তাহলে হয়তো গানের  জন্য নতুন নতুন প্রকল্প হাতে নিতে পারতেন। গানের জগতে কিছু দিয়ে যেতে পারতেন তিনি।

ডরথী বোসের জীবনে এক নতুন দিগন্তের সূচনা করেছিলেন তার বাবা-মা। তার মা অনেক সংস্কৃতিমনা হওয়ার কারনে ছোটবেলা থেকেই নজরুল ও রবীন্দ্রনাথের সাথে পরিচয় ঘটে। আর গান কিভাবে গাইতে হবে সেই শিক্ষা পান বাবার কাছে। গানের স্বরলিপি শেখা তার বাবার কাছেই।

তিনি বলেন, একটা  গান তিনভাবে প্রসেস হয়। এক,লেখকের কাছে, যিনি গানের স্রষ্টা তিনি এক ভাবে উপলব্ধি করে গান লিখেন। দুই, গায়ক যিনি গান গায় তিনি নিজের মতো করে একটা অর্থ ধরে নিয়ে গায়। তিন শ্রোতা, যারা গানটি শুনেন এবং তাদের পরিস্থিতি অনুযায়ী গানের অর্থ খুঁজে বের করেন।

ডরথী বোস এমন ব্যস্ত একজন মানুষ। যিনি ঘর, সংসার, চাকরী, বাচ্চা সব সামলে নিজের রেওয়াজ করার জন্য সময় বের করেন। তাঁর কাছে সময়ের সঠিক ব্যবহার ও সময়ের বণ্টণ অনেক গুরুত্ব বহন করে। সময় অল্প কিন্তু আমাদের কাজ করতে হয় প্রচুর। অনেক চ্যালেঞ্জিং টাইমের মাঝে দিয়ে যেতে হয়। এরজন্য অবশ্য পার্টনারের সহযোগীতা খুব দরকার বলে মনে করেন তিনি। একার পক্ষে সবকিছু করা সম্ভব না বলে জানান তিনি।

ডরথী বোসের দেশের জন্য খারাপ লাগা কাজ করে কি না এই প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ছেড়ে গেলে আসলে মর্যাদা অনুভব করা যায়। বাইরে আছে বলেই দেশপ্রেমটা আরও গভীরভাবে হানা দেয়। ছেড়ে না গেলে বুঝতেই পারতেন না তার মনে এতো দেশপ্রেম কাজ করে। ২১ শে ফেব্রুয়ারি, ২৬ শে মার্চ ও ১৬ ডিসেম্বরের মতো বিশেষ দিনগুলোতে এই তারকা ব্যক্তি আরও বেশি আবেগপ্রবণ হয়ে ওঠেন।

আজ থেকে ঠিক ১০ বছর পর ডরথী বোস নিজেকে কোথায় দেখতে চায় এই প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, গানের মাঝে। এই জনপ্রিয় রবীন্দ্রসংগীত শিল্পী গানের মাঝেই বাকি জীবন পার করতে চান।

শফিক চৌধুরী: বাংলাদেশকে মহাকাশে পৌছে দেয়ার কারিগরদের একজন

শফিক চৌধুরী: বাংলাদেশকে মহাকাশে পৌছে দেয়ার কারিগরদের একজন

স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তীতে বাংলাদেশের জয় যেন শুধু স্থল বা জল পথেই সীমাবদ্ধ না থাকে, স্বপ্ন যেন আকাশ ছাড়িয়ে মহাকাশ ছুঁতে পারে সেই চেষ্টায় একাগ্রচিত্তে কাজ করেছেন একদল মানুষ। বলছি মহাকাশে বাংলাদেশের নিশান উড়ানো দেশের প্রথম স্যাটেলাইট – ‘বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১’ এর কথা। যার মাধ্যমে আন্তর্জাতিক যোগাযোগ ও ব্রডকাস্টিংয়ে আমাদের পরনির্ভরশীলতা কমে এসেছে। এই স্বপ্নযাত্রার বৈদেশিক পরামর্শক, শফিক চৌধুরীকে নিয়ে আমার আজকের আড্ডা। ৫০ বছরের বেশি সময় ধরে কর্পোরেট বিশ্বের নানা বিষয়ের ওপর পারদর্শীতা অর্জন করেছেন জনাব শফিক চৌধুরী। চট্টগ্রামের ছেলে শফিক চৌধুরি পড়াশোনা জীবনের শুরুতে ছিলেন বাংলাদেশের ক্যাডেট কলেজে, সেখান বিদেশে পাড়ি জমিয়ে পড়াশোনা করেছেন বার্মিংহাম ইউনিভার্সিটি, জর্জ ওয়াশিংটন ইউনিভার্সিটি ও হার্ভার্ডের মত বিশ্বসেরা প্রতিষ্ঠানে।

কিছুদিন পূর্বেই হার্টের অপারেশন হয়েছে শফিক চৌধুরীর। অসুস্থ্যতা সত্ত্বেও আগের মতই নিজের কর্মতৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছেন তিনি। তিনি জানান একজন সায়েন্টিস্ট হিসেবে বিজ্ঞানের ওপর আস্থা রেখে অপারেশন পরিচালনার ভার ছেড়ে দেন রোবটের ওপর। এই পদ্ধতিতে মাত্র ৬ সপ্তাহের মধ্যে সম্পূর্ণ সুস্থতা লাভ করে স্বাভাবিক কর্মজীবনে ফিরে আসেন তিনি।

এবার আমার ও প্রায় সকলের মূল আগ্রহ বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট সম্পর্কে জনাব শফিক এ চৌধুরীর কাছে জানতে চাইলাম। ‘ভারতীয় আইএসআরও’ বা ইলোন মাস্কের ‘স্পেস-এক্স’ আমাদের মাথার উপর কাজ করে যাওয়ার পরেও, ৩০০ মিলিয়ন ডলারের বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইটের কি আদৌ প্রয়োজন ছিল কিনা সে বিষয়ে উনার মতামত জানতে চাইলে প্রথমেই জনাব শফিক চৌধুরী জানালেন তিনি নিজেই বেশ অবাক হয়েছিলেন বাংলাদেশের মতো ছোট দেশে স্যাটেলাইটের কথা শুনে। দেশীয় না হয়ে আঞ্চলিক একটি স্যাটেলাইট হিসেবে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইটের যাত্রা শুরু হয় বলে জানান তিনি। এর ফলে বিদেশী নির্ভরশীলতা কমে এসেছে এবং দেশের অর্থ দেশেই থাকছে বলে অভিমত জানান তিনি। ব্যবসায়িক লাভের পাশাপাশি গৌরবের দিক থেকে চিন্তা করলেও এটি বিশ্বের দরবারে বাংলাদেশকে অনন্য একটি পর্যায়ে পৌছে দিয়েছে বলে মনে করেন তিনি। গার্মেন্টস শিল্পে বাংলাদেশ বিশ্ববাজারে শীর্ষ অবস্থানে আছে এ বিষয়টি উল্লেখ করে তিনি জানান এভাবে আমাদেরকে সকল ক্ষেত্রেই এগিয়ে যেতে হবে।

বর্তমানে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট -১ এর সামার্থের পঞ্চাশ শতাংশ ব্যবহৃত হচ্ছে কিন্তু তবুও নতুন করে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট -২ নির্মান প্রস্তুতির যৌক্তিকতা কতটুকু এ সম্পর্কে তিনি জানান এখন প্রথম স্যাটেলাইটের সামার্থ্যের পঞ্চাশ শতাংশের বেশিই ব্যাবহৃত হচ্ছে। বর্তমানে বাংলাদেশের ৩৬ টি টিভি স্টেশন এটি ব্যবহার করছে। স্যাটেলাইট ডিজাইনের খুঁটিনাটি সম্পর্কে আলোচনার সময় তিনি জানান, এর ডিজাইনে তারা ৪টি বিম ব্যবহার করেছেন। একটি বাংলাদেশের জন্য; যেটার পাওয়ার অনেক বেশি। যার মাধ্যমে মাত্র ৫০ সেন্টিমিটার এন্টেনা দিয়ে টিভি দেখা যাবে৷ আরেকটি বিমের কথা জানালেন, যা সার্কভুক্ত দেশগুলো কাভার করে, আরেকটি ইন্দোনেশিয়া ও অন্যটি ফিলিপাইন কাভার করে বলে তিনি জানান। সমস্যার কথায় তুলে ধরেন, বাংলাদেশের কারো তেমন স্যাটেলাইট নিয়ে জ্ঞান ছিল না। একদল তরুণকে স্যাটেলাইট সম্পর্কে আরো বিস্তারিত জানার সুযোগ করে দিয়ে বিদেশ পাঠানো হয়। তাদেরও একটু সময় লেগেছে সব কিছু ভালোভাবে বুঝতে। মাত্র ৩-৪ বছর হয়েছে, আরও সময় আছে বলে তিনি উল্লেখ করেন। বর্তমানে ইন্দোনেশিয়া ও ফিলিপাইনে কিছু ট্রান্সপন্ডার বিক্রির কথা চলছে বলে তিনি জানান। বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-২ এর বিষয়ে তিনি বলেন, এটি একটি রাজনৈতিক স্ট্যান্ড। বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট- ২, যেটি নিয়ে আলাপ আলোচনা চলছিল সেটি বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট ১ এর মতো না বলে জানান তিনি। ‘বিএস-২’ মূলত হবে আর্থ অবজারভেশন স্যাটেলাইট।

জনাব শফিক এ চৌধুরীর কাছ থেকে আমরা জানলাম, পৃথিবী যেমন ঘোরে, স্যাটেলাইট তেমন ঘোরে। বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট নর্থ সাউথ পোলে ঘোরে। কয়েকটি কন্সিলেশন থাকলে প্রতি ৪/৬ ঘন্টা করে ছবি তুলতে পারে এই ধরনের স্যাটেলাইট। যার মাধ্যমে কেউ অসুদপায়ে বর্ডার ক্রস করছে কি না, নদীর পানির ওঠা নামা খুব সহজে দেখা যাবে বলে তিনি জানান। এইটা নিয়ে গভর্মেন্ট টু গভর্মেন্ট আলোচনা চলছিল কিছুদিন, রাশিয়া সরকারের সাথে মূলত। এটা নিয়ে টাকা পয়সার কোনো সম্পর্ক থাকবে না, সেই বিষয়েও আমাদের জানান, মূলত একপ্রকার লেনদেন। জনাব শফিক জানালেন, ইউক্রেন যুদ্ধের পর মাননীয় প্রধানমন্ত্রী সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, ওই চুক্তিটা হবে না। এর ফলশ্রুতিতে দ্রুত সময়ের মধ্যে যে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-২ হচ্ছে না, তা তিনি পরিষ্কার ভাবে বুঝিয়ে বললেন। তবে আগামী নির্বাচনের আগে বর্তমান স্যাটেলাইটের সর্বোৎকৃষ্ট ব্যবহার নিশ্চিত হবে বলে তিনি আশাবাদ ব্যাক্ত করেছেন।

আমেরিকার আলাস্কাতে শফিক চৌধুরীর ‘আলাস্কা ডাটা বোর্ড’ নামে আরেকটি স্যাটেলাইট প্রজেক্ট রয়েছে। এটি ইলন মাস্কের স্পেস এক্সের সাথে তার প্রতিযোগিতা শুরু করবে কিনা বা মাথার ওপর স্টারলিংকের ৫৫টি স্যাটেলাইট থাকার পরেও এ প্রজেক্টের উদ্দেশ্য কী এসব বিষয়েও আলাপ করেছেন তিনি। তিনি জানান, ইলন মাস্ক অত্যন্ত উন্নত চিন্তার মানুষ এবং তার সবার কাছে ইন্টারনেট পৌছে দেয়ার চিন্তার প্রশংসা করেন তিনি। নিজের প্রজেক্টের বিষয়ে বলতে গিয়ে জনাব শফিক বলেন, স্টারলিংক সার্বজনীন নয়, তার প্রজেক্টটি এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। তার মতে, আলাস্কার মত বসবাসের জন্য কষ্টকর স্থানে সবার কাছে ইন্টারনেট পৌছে দিতে পারলে তা ঐ অঞ্চলের মানুষের অনেক উপকারে আসবে এবং শহরের বিকেন্দ্রীকরণের মধ্য দিয়ে বিভিন্ন অঞ্চলে উন্নতি ঘটবে।

স্যাটেলাইট ডিজাইনের পাশাপাশি বিভিন্ন খাতেই পদচারনা রয়েছে শফিক চৌধুরীর। বর্তমানে তিনি ও তার ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অফ হেলথ’র (এইআইএইচ) ডাক্তার বন্ধুসহ এডিএবিএটিই নামের একটি ক্লিনিক্যাল ডিভাইস নিয়ে কাজ করছেন। এ ডিভাইসের মাধ্যমে মেডিক্যাল ট্রায়ালে ব্যবহৃত বানরগুলোকে মেরে না ফেলে দ্বিতীয়বার ব্যবহার করা যাবে বলে জানান তিনি। বর্তমানে এটি পরীক্ষামূলক পর্যায়ে আছে বলে জানান তিনি। এছাড়াও, কোভিডের সময় থেকে তিনি নতুন মাল্টি পেশেন্ট ভেন্টিলেটর উদ্ভাবনের কাজ করে আসছেন। এটিও একটি মেডিক্যাল ডিভাইস যা দিয়ে একসাথে চারজন রোগীকে অক্সিজেন সাপ্লাই দেয়া যাবে বলে জানান তিনি।

দশ বছর পরে শফিক চৌধুরী তার জন্মভূমি বাংলাদেশকে কোথায় দেখতে চান এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি দেশের জনশক্তি নিয়ে ইতিবাচক প্রত্যাশা ব্যাক্ত করেন। তিনি দাবি করেন বাংলাদেশের মানুষ অত্যন্ত বুদ্ধিমান এবং সঠিক দিক নির্দেশনা পেলে এ দেশের তরুনরা অনেক দুর এগিয়ে যাবে। তবে গার্মেন্টস শিল্পের ওপর অতিমাত্রায় নির্ভরশীল হওয়া থেকে বেরিয়ে এসে বিভিন্ন খাতে বিনিয়োগ ও দৃষ্টি দেয়ার জন্য পরামর্শ দেন। তিনি মনে করেন, কোনো একটা খাত নিয়ে কাজ করতে গেলে সে বিষয়ের ওপর স্পেশালাইজড শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করা জরুরী।

শফিক চৌধুরী তার জীবনে বহু আইডিয়া ও প্রযুক্তি উদ্ভাবন করেছেন এবং এখনও করে যাচ্ছেন। তার কাজের অনুপ্রেরণা হিসেবে তিনি তার পছন্দের ব্যাক্তিত্ব বিল ক্লিনটনের জীবন থেকে পাওয়া একটি শিক্ষার কথা তুলে ধরেন। বিল ক্লিনটন থেকে তিনি শিখেছেন কিভাবে ব্রেনের দশটি ভাগকে কাজ ও সময় অনুসারে আলাদাভাবে ভাগ করে ব্যবহার করা যায়। তিনিও বিগত ১০ বছরে এটি রপ্ত করেছেন। এভাবেই তিনি একজন মাল্টি টাস্কিং মানুষ হিসেবে গড়ে উঠেছেন। কাজের ফাঁকে তিনি বাগান করতে পছন্দ করেন এবং রান্না বান্না করতে পছন্দ করেন। এছাড়াও, জনাব শফিক চৌধুরী অনুপ্রেরণা হিসেবে উল্লেখ করেছেন স্টিভ জবস, ইলন মাস্ক ও বিল গেটসের কথা। তাদের আবিষ্কার যেভাবে সময় বাঁচাচ্ছে ও সমাজের অগ্রগতিতে কাজ করছে তার প্রশংসা করেছেন তিনি।

সবার জীবনের শুরুটা গুরুত্বপূর্ণ। সেই জায়গাতে জনাব শফিকের কাছেও জানতে চাওয়া তার জীবনের শুরুর দিকের গুরুত্বপূর্ণ মানুষ সম্পর্কে। তিনি প্রথমেই জানালেন বাবা-মায়ের কথা। পাশাপাশি বললেন তার পরিবারের ঐতিহ্যের কথা, প্রায় ১৬০০ বছরের ইতিহাস। পরিবারে পড়ালেখার উপর জোর সবসময় ছিল বলে তিনি জানালেন। এখানে যেই বিষয়টি নজরকাড়ে, একসাথে খেতে বসে তার বাবার পড়ালেখা নিয়ে খোঁজ করা। তিনি তার বাবার এই উৎসাহের কথাটি বারবার করে উল্লেখ করেছেন।

আড্ডার মাঝে জনাব শফিক বলেছিলেন, রান্না করতে ভালোবাসেন, তাই জানতে চাওয়া কি ধরনের রান্না করা তার পছন্দের। এই প্রশ্নে যেন জনাব শফিক সাহেব একটু পুরাতন সময়ে ফিরে গিয়েছিলেন। পড়ালেখার সুবাদে বাড়ি ছাড়লেও মায়ের হাতের রান্না মিস করতেন তিনি। সাড়ে আঠারো বছরে বিদেশ পাড়ি জমানোর পর থেকেই নিয়মিত সাপ্তাহিক ছুটির দিনে দেশীয় রান্না করতেন তিনি। অনুষ্ঠান উপলক্ষে বিশেষ রান্না বা সাধারন যেকোনো রান্না করতে পছন্দ করেন তিনি। জনাব শফিক জানান যে দেশীয় চলচ্চিত্র দেখার তেমন একটা সুযোগ হয়ে ওঠেনা ওনার। তবে একটা সময় আরটিভি ও এনটিভিসহ বিভিন্ন চ্যানেলের অনুষ্ঠানগুলো উপভোগ করতেন তিনি। পাশাপাশি তার আলোচনায় উঠে আসে সরকারি কাজে বেতনের পাশাপাশি নির্দিষ্ট প্রজেক্টের লাভ্যাংশের অংশ কর্মরত ব্যক্তিদের সাথে শেয়ার করার মাধ্যমে বা অন্য কোনো ভাবে ইনসেনটিভ দেয়া প্রয়োজন।

ব্যক্তি শফিক চৌধুরী একজন বরেণ্য ও কৃতি মানুষ হিসেবে তার জন্মভূমি বাংলাদেশের জন্য কী কী অবদান রেখে যাচ্ছেন এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি ক্যাডেট কলেজের শিক্ষার্থীদের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও বুয়েটে ভর্তি হওয়ার পরিমান বাড়ানোর লক্ষ্যে একটি ই-লার্নিং সেন্টার গড়ে তোলার কথা জানান। পাশাপাশি ২০২২ সালে তিনি একই আদলে “স্যালুট টু বাবা” ই-লার্নিং সেন্টার গড়ে তুলেছেন স্কুলের শিক্ষার্থীদের জন্য। স্কিল উন্নয়নের জন্য উন্নত প্রযুক্তি ও বিভিন্ন কোর্সের জন্য কাজ শুরু করেছেন তিনি। অত্যন্ত বিনয়ী ও প্রচারবিমুখ শফিক চৌধুরী আশা রাখেন যেন তাঁর মৃত্যুর পরেও মানুষ তাঁকে একজন আদর্শ ও ভাল মানুষ হিসেবে মনে রাখেন।